ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

হাইওয়ে | রাবেয়া বসরী

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৫
হাইওয়ে | রাবেয়া বসরী

বাস ছাড়ার সাথে সাথে মিরা মোবাইলে তাকিয়ে দেখল রাত এগারটা বেজে দশ মিনিট। মোবাইলে কয়েকটা গান সিলেক্ট করে প্লে লিস্ট বানিয়ে ইয়ারফোন কানে দিয়ে চোখ বন্ধ করে মিরা।

গান শুনবার মতো মনের অবস্থা নেই এখন ওর। তবুও মাথাটা এলিয়ে দিয়ে গান শোনার চেষ্টা করে। সারাদিনের ঝড়টা যেন বয়ে যায় আরো একবার মাথার ভেতর। দৃশ্যগুলো, মানুষের সেই ভয়ংকর মূর্তিগুলো একের পর এক ভেসে যাচ্ছে চোখের সামনে, যেন কোনো চলচ্চিত্র চলছে মনের পর্দায়। গানের কথা সুরের বদলে যেন শত সহস্র মানুষের নির্মম চিৎকার এসে পৌঁছায় ওর কানে। আতংকে সিঁটিয়ে যায় মিরা। ভলিয়্যুম বাড়িয়ে দেয় গানের। চারপাশে তাকায় ভয় নিয়ে যেন এখানেও সবাই তাড়া করে আসছে! জানালার পাশে বসে দেখে শহরের বাতিগুলো নিভে আসছে। কিংবা বাসটা শহর ছেড়ে আঁধার ঘেরা অচেনা শহরে এগিয়ে চলছে। পরিচিত একটা পারফিউমের গন্ধ এসে নাকে লাগে। কেমন যেন আচ্ছন্ন লাগে সবকিছু মিরার কাছে। দু’ ঘণ্টা পরেই বাসটা শহর ছাড়িয়ে হাইওয়েতে গিয়ে পড়ে। সকালেও কি ভাবতে পেরেছিল রাতে এভাবে একা বাসে চড়ে অজানা শহরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে হবে! রাত দশটার দিকে এসে এমন করে বাসের টিকিট কাটতে হবে! নাহ! সব পেছনে ফেলে এসেছে মিরা। নিজেকে শাসন করে বলে, আর ওসব মনে করবে না। যা কিছু ছেড়ে এলো, তা কি আদৌ ছিল কখনো মিরার কিংবা মিরা কি ওদের হতে পেরেছিল এই জীবনে! জীবনের এইসব হারিয়ে ফেলার মুহূর্তগুলো বড় অদ্ভুত। এই মুহূর্তগুলো না এলে জীবনে কখনো জানাই হতো না, হারানোর মতো কিছু হারায় নি আদতে। যা গেছে, তা চলে গিয়ে কোনো বিপর্যয় তৈরি করে না। আর তেমন কোনো কষ্টের বোধ কিংবা শূন্যতার অভাব বোধেরও জন্ম দেয় না। বরং জীবনে এমন বহু সময় আসে যখন মনে হয়, ওটা বড় বেশি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। হারিয়ে গেছে যাক কিংবা ফেলে এসেছি থাক। নাই বা পাওয়া হলো! আবার এমনও হয় জীবনে, যা নেই, তাই-ই যেন আছে চিরকাল ধরে। না পেলে বোধহয় এত গাঢ়ভাবে পাওয়া হতো না জীবনে! এও এক চরম আইরনি জীবনের! থাকাটা যেমন আনন্দের আবার দুর্ভোগও বাড়ায়, তেমনি না থাকাটাও কষ্টের আবার স্বস্তিরও!



জানালার পাশে বসে দেখে শহরের বাতিগুলো নিভে আসছে। কিংবা বাসটা শহর ছেড়ে আঁধার ঘেরা অচেনা শহরে এগিয়ে চলছে। পরিচিত একটা পারফিউমের গন্ধ এসে নাকে লাগে। কেমন যেন আচ্ছন্ন লাগে সবকিছু মিরার কাছে। দু’ ঘণ্টা পরেই বাসটা শহর ছাড়িয়ে হাইওয়েতে গিয়ে পড়ে। সকালেও কি ভাবতে পেরেছিল রাতে এভাবে একা বাসে চড়ে অজানা শহরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে হবে! রাত দশটার দিকে এসে এমন করে বাসের টিকিট কাটতে হবে! নাহ! সব পেছনে ফেলে এসেছে মিরা।



বাসটা হঠাৎ করেই থেমে যায়। কিছু মুহূর্ত কেটে গেলে মিরা দেখে, একে একে সবাই বাস থেকে নেমে যাচ্ছে। মিরা বুঝে উঠতে পারে না। অচেনা পথে অচেনা এতসব মানুষের ভিড়ে এমন রাতে কী করবে একা একা! পাশে বসে থাকা মানুষটা বলে ওঠে, কী হলো আপনি নামবেন না? বাস নষ্ট হয়েছে, সারতে সময় নিবে। আপনার সাথে কেউ নেই? মিরা বাসে ওঠার পর সেই যে জানালার দিকে মুখ রেখে বসেছিল চোখ বন্ধ করে, পাশে এসে কে কখন বসল কিছুই খেয়াল করেনি। লোকটার কণ্ঠস্বরে মিরা চমকে ওঠে। অনেক বছর পর সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে সব এলোমেলো লাগে। কিন্তু তা কী করে সম্ভব বলে মিরা বিড়বিড় করে। লোকটার শেষ কথায় ভয় পেলেও মুখে তা প্রকাশ করে না। মিরা না তাকিয়েই বলে, নামছি আপনি নামুন।

একে একে সব যাত্রীর সাথে মিরাও নেমে আসে, পথের কিনারে এসে দাঁড়ায়। দেখে, বাসটা হাইওয়েতে যেখানে থেমেছে, একদিকে কোন এক মফস্বল শহরের সীমানা এসে শেষ হয়েছে আর অন্যদিকে বিস্তৃত খোলা প্রান্তর। মাঘ মাসের শুরু এখন। চারিদিক কুয়াশা জমে আছে। তাকিয়ে থাকলে রাতের আঁধারে কুয়াশায় কেমন মায়া লাগে চোখে। এদিক ওদিক জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে সবাই আর কিছু সময় পরপর বাসের ড্রাইভার আর হেল্পারকে তাগাদা দিচ্ছে জলদি বাস সারাবার জন্য। মিরা তাকিয়ে দেখে, পাশের সিটের লোকটা মিরার আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে আর একটার পর একটা সিগ্রেট ধরিয়ে যাচ্ছে। মিরা বুঝতে পারে না লোকটার কী মতলব। পাশ থেকে মিরা দেখেছে, লোকটা কেমন করে যেন বাঁকা এক হাসি হাসছে! ভাবে, লোকটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছে মিরা একাই এসেছে। ওর সাথে কেউ নেই। মিরা লোকটার দিকে আড়চোখে তাকায়। লোকটা পেছন ফিরে আছে। মিরার আবার কেমন কেমন যেন সন্দেহও হয়।

শীতের রাত। মিরার গায়ে গরম কাপড় বলতে শুধু একটা চাদর। গত দশটা বছর তো এই চাদরেই শীতকে মানিয়ে নিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পরেই মিরার চারপাশ আঁধার করে আসতে থাকে। মিরা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নিজেকে বলে, ও কিছু না। সারাদিন অনেক ঝড় ঝাপটা গেছে বলে হয়ত শরীর দুর্বল লাগছে। পানিও পড়েনি পেটে সারাদিনে একবারের জন্য। মিরার কাছে সব কেমন গাঢ় অন্ধকার লাগে। চোখ বুঁজে আসতে চায়। চারপাশের প্রত্যেকের কথা যেন অস্পষ্ট স্বরে পৌঁছায় কানে। মিরা নিজেকে মনে মনে ধমক দেয়। নিজের হাতের মুঠি শক্ত করে। এরপর যে কী হলো! লোকটা মিরার দিকে ফিরতেই আর পারেনি দাঁড়িয়ে থাকতে। জ্ঞান হারিয়ে এলিয়ে পড়ে যায় মাটিতে।

কিছু সময় পর মুখে পানির ঝাপটা এসে পড়ে। মিরা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে ওর দিকে কেমন করে সবাই তাকিয়ে আছে। শুনতে পায়, কে একজন বলছে জ্ঞান ফিরেছে মেয়েটার। তাকিয়ে দেখে সেই লোকটাই হাতে পানির বোতল নিয়ে পাশে বসে আছে। আরো দু’তিনজন মহিলা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। একজন বলে, আপনি তো ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। নার্ভ শ্যাটার্ড করেছিল। সারাদিনে বোধহয় কিছু খাওয়াও হয়নি। মিরা গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে উঠে বসলে লোকটা বলে, আপনি বসুন। আবার দাঁড়াতে যাবেন না। বাস আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। আমার ব্যাগে কিছু শুকনো খাবার আছে। আমি নিয়ে আসছি। মিরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মামুনের দিকে। কী বলছে এইসব! মিরাকে চিনতে পারেনি মামুন! দশ বছরে কি মানুষের মুখ এত বদলে যায়! মিরা তাকিয়ে দেখে, মামুন হাতে একটা বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে এদিকে আসছে। মিরা বুঝতে পারে না কী করবে। মামুন কি সত্যি সত্যিই চিনতে পারেনি নাকি চিনতে পারছে তবু মনে দ্বিধা রয়ে গেছে। হয়ত মেলাতে পারছে না দশ বছর আগের মিরার সাথে। অথবা চিনেও না চেনার ভান করছে! মিরা দাঁড়িয়ে যায়। মামুন এগিয়ে কাছে এসে বলে, আপনি এখন কেমন ফিল করছেন? কিছু খেয়ে নিন। তখনই পেছন থেকে বাসের হেল্পার ডেকে ওঠে যাত্রীদের বাসে উঠে যাবার জন্য। বাস ঠিক হয়ে গেছে। মিরা তাকায় মামুনের দিকে। এ কী করে সম্ভব! একদম অবিকল আগের মতোই আছে। যেন দশ বছরে একটুও বয়সের ছাপ পড়েনি। মিরাকে ওভাবে চুপচাপ তাকিয়ে থাকতে দেখে মামুন একটু অবাক হয়। বলে, চলুন বাসে উঠে খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। মিরা কোনো কিছু বলতে পারে না। মিরা যেন হাঁটতে ভুলে গেছে, কথা বলতে ভুলে গেছে। আচ্ছা মিরা কি কোনোদিন কথা বলেছিল পৃথিবীতে! মামুন তাকিয়ে দেখে সবাই উঠে গেছে বাসে। সবাই ভাবছে মামুনই হয়ত মিরার সাথে এসেছে। মামুন অস্বস্তি বোধ করে। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। আবার অনুরোধ করে মিরাকে বাসে গিয়ে বসার জন্য। মিরা কিছু না বলে চুপচাপ এগিয়ে যায় বাসের দিকে। বাসে উঠে তার সিটের সামনে গিয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয়। পরম শান্তিতে জানালার পাশে গিয়ে বসে। মামুন অবাক হয়ে যায় মিরার কাণ্ড দেখে।

বাসটা ছেড়ে দিতেই মামুন মিরার দিকে আবার বিস্কিটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে মোবাইলে সময় দেখে নেয়। রাত তিনটা বাজে। মিরা বলে, আমার খিদে নেই। আপনি রেখে দিন। মামুন আর কথা বাড়ায় না। ওপাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে। এপাশে মিরা চারদিকে তাকিয়ে দেখে বাসের সব বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। সবাই চোখ বুঁজে আছে। বাসে সবাই হয়ত ক্লান্ত কিংবা শীতের এমন রাতে সবাই আরামে ঘুমোতে চাইছে। আর কাউকে তো মিরার মতো জীবন নিয়ে ছুটে পালাতে হচ্ছে না, আর কেউ তো এমন করে দশ বছর পরে কারো দেখা পেয়ে রাতটাকে স্বপ্ন বলে ভাবছে না! মিরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। দেখে,পথে কত ছোট বড় নদী, ফসলের ক্ষেত, খোলা প্রান্তর আঁধার কুয়াশায় ডুবে আছে আবার কোথাও অসংখ্য গাছের সারি একটার সাথে অন্যটা গা লাগিয়ে পথের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের ফাঁকে, পাতার ফাঁকে ফাঁকে আঁধার এসে জমা হয়ে আছে। কেমন রহস্যময়। চারিদিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে মিরার। যেন পৃথিবীতে কখনো আলো এসে পৌঁছেনি। চিরকাল এমন করেই আঁধারে ডুবে আছে পৃথিবী। এমন আঁধারে কাছের মানুষ যেন আরো কাছে আসে, কাছাকাছি থাকে হাত ছুঁয়ে। আঙুলে আঙুল ঠেকায়! আঁধারটাকে যেন হঠাৎ খুব মিষ্টি লাগে মিরার কাছে। আবার মামুনের দিকে তাকায়। ঘুমিয়ে পড়েছে মামুন। মামুনের শরীরের ওম এসে পৌঁছায় মিরার শরীরে। সব যেন ভুলে গেছে মিরা। যেন পৃথিবীতে কখনো কোনো দুঃখ কষ্ট ছিল না। যেন মামুন কখনো হারিয়ে যায়নি। মিরা হয়ত মামুনের সাথেই দূরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে। মিরা শান্তিতে চোখ বোঁজে।

ছয়টার দিকে বাসটা থামে একটা হোটেলের সামনে। পাশেই হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলছে দূরপাল্লার সব যানবাহন। এরপর আর যাত্রা বিরতি নেই। অতএব সবাই খাবার জন্য নেমে যায়। মিরা মামুনকে ডেকে তোলে। মিরা অবাক হয় মামুন ওকে কেন চিনতে পারছে না! ওরা দুজনে একসাথেই সেই হোটেলে গিয়ে চোখ মুখে পানি দিয়ে একটা টেবিলে খেতে বসে। মিরা ভাবে, মামুন যদি ওকে চিনে নিয়ে কথা বলে তো ঠিক আছে, নতুবা নিজ থেকে কিছুই বলবে না। মিরাকে এমন আলোয় দেখে মামুন এবার যেন ভাষা হারায়। তবু প্রকাশ করে না। খাবারের অর্ডার দেয়া হয়ে গেলে মামুন বলে, আপনার নামটা কিন্তু জানা হলো না। মিরা তাকিয়ে হেসে বলে এই প্রশ্ন তো আমিও আপনাকে করতে পারি। মামুন বলে, ঠিক আছে আমিই বলছি। তখন খাবার চলে আসে। মামুন খেতে খেতে নিজের পরিচয় দেয়। মিরা একের পর এক প্রশ্ন করে কত কিছুই না জানতে চায় আর মামুন উত্তর দেয়। কিভাবে দশ মিনিট চলে গেল, আবার ওদিকে বাস ছেড়ে দিবে। মামুন বলে, আপনি কথায় কথায় নিজের পরিচয় কাটিয়ে গেলেন কিন্তু! আপনি বাসে গিয়ে উঠুন। আমি একটা সিগ্রেট ধরাব। মিরা আশ্চর্য হয়, মামুনের এই অভ্যাস তো ছিল না! মিরা বলে, আমার কোনো সমস্যা নেই। আমার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালোই লাগছে। মনে মনে বলে, যতক্ষণ কাছে আছো, কেন দূরে গিয়ে বসে থাকব, যদি আবার হারিয়ে যাও! মামুন বলল, কিছু বললেন নাকি। মিরা মাথা নাড়ে। ভোর হচ্ছে। চারদিকে কুয়াশার ভেতর থেকে যেন শীতকালের ভোর জেগে উঠছে। মিরার কাছে স্বপ্নের মতো লাগতে থাকে সবকিছু। আচ্ছা, জীবন এত অসহ্য সুন্দর হতে পারে! মিরা মামুনের পাশে এই অচেনা হাইওয়ের পথে হাঁটতে থাকে ক্ষণিকের জন্য। মিরার মনে হয়, জীবন বোধহয় এভাবেই দেখা দেয় হঠাৎ হঠাৎ। শুধু আমরাই জানতে পারি না, কখন কোথায় কিভাবে দেখা দেবে জীবন—কার সাথে!



মাঘ মাসের শুরু এখন। চারিদিক কুয়াশা জমে আছে। তাকিয়ে থাকলে রাতের আঁধারে কুয়াশায় কেমন মায়া লাগে চোখে। এদিক ওদিক জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে সবাই আর কিছু সময় পরপর বাসের ড্রাইভার আর হেল্পারকে তাগাদা দিচ্ছে জলদি বাস সারাবার জন্য। মিরা তাকিয়ে দেখে, পাশের সিটের লোকটা মিরার আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে আর একটার পর একটা সিগ্রেট ধরিয়ে যাচ্ছে। মিরা বুঝতে পারে না লোকটার কী মতলব। পাশ থেকে মিরা দেখেছে, লোকটা কেমন করে যেন বাঁকা এক হাসি হাসছে! ভাবে, লোকটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছে মিরা একাই এসেছে। ওর সাথে কেউ নেই।



আবার বাস ছাড়ে। এগিয়ে চলে সব পেছনে ফেলে। মানুষ, গাছ, স্মৃতি সব পেছনে পড়ে থাকে। হঠাৎ মামুন মিরু বলে ডেকে উঠলে মিরা চমকে ওঠে। মামুনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে ভোরের আলো এসে পড়েছে মামুনের মুখের ওপর। দেখে, মামুনের চোখে কী করুণ এক ছায়া! মিরাকে কাছে টেনে নিলে মিরার দশ বছরের ঘুম ভেঙে যেন মামুনের বুকে লুটিয়ে পড়ে মুখ ঘষতে থাকে। মামুন মিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, কাঁদে না। এই যে আমি আছি। আর আমি হারিয়ে যাব না। যে বিধাতা আমাদের এই আজকের রাত লিখছেন, তিনিও হয়ত কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাবেন গল্পের এই পর্যায় এসে। থমকে যাবেন! মিরা মামুনকে বলে, তবে যা যা শুনেছিলাম সবটুকুই মিথ্যে! মামুন বলে, যেমন আমিও তোমাকে ভুলই বুঝেছিলাম। শুধু নিজের ভুল বুঝতেই অনেক বছর কেটে গেলে আর তোমার কাছে ফিরে যাবার পথে পা বাড়াতে পারিনি। মিরা বলে, থাক ওসব কথা। আচ্ছা তুমি আমাকে চিনতে পেরেছিলে শুরুতেই তাই নাহ! মামুন হাসে শুধু। সত্যিই তো এমন কথার উত্তর কি থাকতে পারে কিংবা মামুন দিতে পারে এমন কথার উত্তর! মামুন মিরাকে চিনবে না কেন... মামুন যদি মিরাকে না চেনে তো আর কে চিনবে... অনেকদিন আগে যে ওদের দুজনের পথ একসাথে মিশেছিল। মামুনের ঠিকানা হয়ে গিয়েছিল মিরার ঠিকানা। সেই সময়টাকে যদি মামুন ভুলে যায়, মিথ্যে বলে অবিশ্বাস করে তবে যে মিরার সব মিথ্যে হয়ে যাবে পৃথিবীর কাছে! সেই সময়েই যে কী এক ঝড় এলো, যেমন হঠাৎ করে মামুন এসেছিল তেমনি সেই ঝড়ে মিরাকে একা ফেলে কোথায় যে হারিয়ে গেল! একবারও ভাবল না মিরার কথা!

মিরা মামুনের দিকে তাকিয়ে বলে, আজ আমরা যে শহরেই যাই না কেন, রাতে ঠিক বারোটার পর আমরা হাঁটতে বের হব, ঠিক আছে? অচেনা শহরের পথে পথে কোনো এক শীতকালের রাতে হেঁটে যাওয়া, টঙের দোকান থেকে চা কিনে খাওয়া... মামুন বলে, একি মিরা তুমি তো দেখছি একেবারেই বদলাওনি। আগের মতোই আছো! মিরা খুব উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, বলে, নাহ! আচ্ছা শোন, আমরা না রোজ সন্ধ্যেবেলা নদীর ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখব, প্রত্যেক মাসে একবার করে সমুদ্রস্নানে যাব, না, আমরা রোজ ভোর দেখব একসাথে। সকালবেলা হেঁটে বেড়াব। না, তাও না, আমরা দুজন অনেকদূর চলে যাব! কোনো এক পাহাড়ের দেশে। কোনো এক মিশনারি স্কুলে বাচ্চাদের পড়াব আর পাহাড়ের গায়ে বসে রাতের বেলা আকাশের তারা গুনব, ঠিক আছে? নিভৃতে জীবন কাটিয়ে দেব একসাথে! আচ্ছা না থাক, কিচ্ছু করতে হবে না, তুমি শুধু আমার কাছাকাছিই থেকো! মামুন হেসে মিরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই জোরে ব্রেক কষে বাসটা থামে।

মিরার ঘুম ভেঙে যায়। তাকিয়ে দেখে, চারিদিক অন্ধকারের রাত। পাশের সিট শূন্য পড়ে আছে। কেউ নেই সেখানে। মিরার চোখ এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খোঁজে। কিন্তু কেউ নেই। মিরার চোখ ভিজে ওঠে। ঝাপসা চোখে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে, পাঁচটা বাজছে। সবগুলো গান কখন সব একে একে বেজে থেমে গেছে, একটা রাত কিভাবে শেষ হয়ে আসছিল কিছুই যেন মিরা জানতে পারেনি। আবার চারিদিকে তাকায়, বাসে সবাই ঘুমোচ্ছে মৃত মানুষের মতন। মিরার চোখ কাঁদতে থাকে। অথচ মিরা যেন অসাড়। অন্ধকার রাতটাকে বড় অশরীরী মনে হয় মিরার কাছে। মিরা ভাবে, এভাবে স্বপ্ন ভেঙে দেবার কালে বিধাতাও কি অসাড় হয়ে পড়ে কিংবা বিধাতার কি কালি ফুরিয়ে যেতে পারে না! এ বিধাতার কেমন ইচ্ছে! আজ কেউ নেই বলেই কি এতটা আছে! মিরার আবার চোখ বুঁজতে ইচ্ছে করে, এতে যদি বিধাতা নিজে আবার চোখ মেলেন! আবার যদি মিরা মামুনকে দেখতে পায়! মিরা মামুনের সাথে পরিচিত হবার আগের জীবনের কিছুই মনে করতে পারে না আর চাইলেও আবার মামুন চলে যাবার পর কিভাবে এত বছর কেটে গেল, কত কী যে হলো জীবনে, শুধু মামুনের ফিরে আসা ছাড়া, তাও ঠিক ঠিক মনে করতে পারে না, যেন মিরা শুধু সেই কটা দিনই বেঁচে ছিল যখন মামুন ছিল, যেন এর আগে পরে আর কোনো জীবন নেই আর কোনো বেঁচে থাকা নেই, এই দশ বছর যেন মুহূর্তেই কেটে গেছে আর সেই ছয়মাস কি এক বছরই ছিল জীবনের দীর্ঘতম দিনরাত্রি! মিরার মনে হয়, মামুন ছিল, সত্য, এখন নেই, তাও সত্য, তবে মিথ্যে কী!

মিরাকে নিয়ে বাসটা আবার এগিয়ে চলে সামনের দিকে। মিরা ভাবতে চায় না কী অপেক্ষা করে আছে সামনের দিনগুলোতে। জানালায় বাইরে তাকিয়ে দেখে, ভোর হচ্ছে।



বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।