পর্ব ১০ পড়তে ক্লিক করুন
বিলাতি নারীর পোশাক আশাক |
ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে বিলাতিদের ভারত ভ্রমণের ওপর ছোট ছোট পুস্তিকার সন্ধান পাওয়া যায়। ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত এমনই একটি পুস্তিকার নাম ‘রিয়েল লাইফ ইন ইন্ডিয়া’ অথবা ‘দ্য কমপ্লিট ইন্ডিয়ান হাউসকিপার অ্যান্ড কুক’।
এক বছর কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই ভারতে থাকতে হলে যেসব জিনিসপত্র সঙ্গে রাখাকে জরুরি বলে ধরা হয়েছিল সেগুলো হলো: ৬ সেট নাইট গাউন(সিল্ক এবং সূতির) গরম এবং শীত ভেদে, ৬ পিস পেটিকোট, ২ সেট শীতের কাপড়, ২ সেট ঘরে পরার কাপড়, ৬ সেট সামার টি গাউন, ৪ সেট টেনিস গাউন, এক সেট পকেট চিরুনী, রুমাল, ২ জোড়া ব্যায়াম করার জুতা, ২ জোড়া বুট, এক জোড়া টেনিস খেলার জুতা, ২ জোড়া ঘড়ে পরার জুতা ইত্যাদি
‘দ্য কমপ্লিট ইন্ডিয়ান হাউসকিপার অ্যান্ড কুক’ পুস্তিকাটিতে তেমন একটি ফর্দ চোখে পড়ে। একজন বিলাতি যখন ভারতে যাবেন, তখন তিনি অবশ্য প্রয়োজনীয় যেসব জিনিসপত্র সঙ্গে নেবেন তার একটা তালিকা এই পুস্তিক থেকে পাওয়া যায়। এক বছর কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই ভারতে থাকতে হলে যেসব জিনিসপত্র সঙ্গে রাখাকে জরুরি বলে ধরা হয়েছিল সেগুলো হলো: ৬ সেট নাইট গাউন(সিল্ক এবং সূতির) গরম এবং শীত ভেদে, ৬ পিস পেটিকোট, ২ সেট শীতের কাপড়, ২ সেট ঘরে পরার কাপড়, ৬ সেট সামার টি গাউন, ৪ সেট টেনিস গাউন, এক সেট পকেট চিরুনী, রুমাল, ২ জোড়া ব্যায়াম করার জুতা, ২ জোড়া বুট, এক জোড়া টেনিস খেলার জুতা, ২ জোড়া ঘড়ে পরার জুতা ইত্যাদি।
এদিক থেকে বিলাতি নারীরা ছিল খুব সচেতন। তারা পুস্তিকায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিনিসপত্রগুলো আগে থেকেই নিজেদের সংগ্রহে এনে রাখতেন। এ কথা সত্য যে, সে সময়ে ইউরোপিয়ান কাপড় বা তৈজষপত্র ভারতের বাজারে এত সহজে পাওয়া যেত না। তবে বিলাতি নারীদের জানা ছিল, ভারতের দর্জিরা খুব দক্ষ এবং দর্জি বাড়িতে কাপড়ের মাপ ঠিকঠাকমতো জমা দিতে পারলে অনেকটা বিলেতের মতোই অবিকল নকল করে ভালো কিছু কাপড় তারা তৈরি করে দিতে পারবে। সে কারণে অনেক বিলাতি নারী বিলেত থেকে আনা কাপড়গুলো অবিকল নকল করে ভারতীয় দর্জি দিয়ে বানাতে ভালোবাসতেন। তবে এক্ষেত্রে বিলাতি নারীদের মনে একটি শঙ্কা এবং সেই সাথে মনোবেদনাও সব সময় কাজ করত যে, তারা হয়ত খোদ বিলেত থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। সে কারণে ভারতে অবস্থানরত বিলাতি নারীরা সবসময় তাদের বিলেত থেকে আসা আত্বীয়স্বজনদের কাছ থেকে আধুনিক পোশাকের ডিজাইন, ছবি, বা নমুনা জানার জন্যে উদগ্রীব হয়ে থাকতেন।
১৮৫৮ সালে মিনি ব্লেন নামের এক বিলাতি নারী বিলেতে থাকা তার মাকে ভারত থেকে লেখা চিঠিতে জানাচ্ছেন, “সিসিকে(মিনির বোন) বলো যে, সে কখনো আমার চিঠিতে লেখা প্রশ্নের উত্তরগুলো ঠিকমত দেয় না। এমনকি সে আমাকে এটাও জানায় না, সে কিভাবে তার চুলের স্টাইল করছে। এই তথ্যগুলো আমার জানা খুব জরুরি। ” (ওমেন অব দ্য রাজ: দ্য মাদারস, ডটারস, ওয়াইভস অ্যান্ড ডটারস অব দি ব্রিটিশ এমপায়ার ইন ইন্ডিয়া। মারগারেট মেকমিলান, রেনডম হাউস ট্রেড, ২০০৭, পৃষ্ঠা ৭১)
ভারতে অবস্থানরত বিলাতি নারীরা প্রসাধন-সচেতন ছিলেন। এটি ছিল সামাজিক মর্যাদা ও পারস্পরিক প্রতিযোগিতার একটি জায়গা। বিলেত থেকে আনা অত্যাধুনিক অলঙ্কার দিয়ে নিজেকে সজ্জিত করা ছিল তাদের স্বপ্ন। পাশাপাশি বিলাতি নারীরা তাদের পোশাকের বিষয়ে আরো বেশি সচেতন ছিলেন এ কারণেই যে, পোশাক দিয়ে তারা নিজেদের—ভারতীয় নারীদের থেকে আলাদা করে রাখতেন।
১৮৫৬ সালে মিসেস ওয়ালেস ডানলোপ ভারত ভ্রমণে এসে বিলাতি কায়দায় মাথায় টুপি পরেন নি বলে সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন। মাথায় কায়দা করে বিলাতি টুপি পরা এবং একজন বিলাতির—অন্য আরেকজন বিলাতির সঙ্গে দেখা হলে টুপি খুলে কুশল জিজ্ঞেস করা ছিল সে সময়ের সামাজিক ভদ্রতা। আরেকটা বিষয় হলো, টুপি ছিল সে সময়ের উচ্চবিত্ত বিলাতি সমাজের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় একটি বস্তু। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে খোদ বিলেতে সতের শতকের প্রথম দিকে টুপি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ইংরেজ সমাজে একটা কথা খুব প্রচলন ছিল, “যদি তুমি নিজেকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাও এবং অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাও, তাহলে মাথায় কায়দা করে টুপি পরো। ”
সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বলতে আধুনিক মনস্ক হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছিল। ১৭০০ সালের দিকে বিলেতে ‘মিলিনার’ নামের একধরনের টুপি ব্যাপক জনাপ্রিয়তা লাভ করে। সেই সময় আদালত, কোর্ট-কাচারি থেকে শুরু করে সর্বত্র এই টুপির ব্যবহার শুরু হয়। জানা যায় ইতালির মিলান শহর থেকে একদল বণিক এই টুপি ইংল্যান্ডের মাটিতে জনপ্রিয় করেছিলেন। সেই থেকে টুপির নাম হয়ে যায় মিলিনার টুপি। সেই সময়ের মিলিনার টুপির একটি বিজ্ঞাপন হুবহু তুলে ধরছি, “Popular sailor shape, with a slight mushroom droop, covered with any color straw flat velvet, birds, and fancy wool finish.”
এবার ভাবুন, এমন বিজ্ঞাপন পড়ে বিলাতি নারীরা টুপি না পরে কি থাকতে পারে? বিলাতি নারীরা যখন ভারতবর্ষে আসতে শুরু করলেন ততদিনে তাদের সবার মাথায় সেই টুপিটি স্থায়ী আসন নিয়েছে। ভারতে টুপি পাওয়া যাবে কি যাবে না সেই শঙ্কা থেকে তারা সবাই বিলেত থেকেই অন্তত বছর দুয়েকের জন্য গোটা দশেক টুপি সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। টুপির পরপরই যে বিষয়টি চলে আসে তা হলো, বিলাতি নারীদের চুলবিন্যাস। চুল পরিচর্যার জন্য সময়ের অভাব ছিল না তাদের। চুলের বিভিন্নরকম বাহারি ছাঁট সেই সময়ের বিলাতি নারীদের জীবনে একটি অবশ্য প্রয়োজনীয় ও পালনীয় অংশ ছিল।
পোশাক আশাকের দিক থেকে বিলাতি নারীরা সবসময়ই সচেতন ছিলেন। বিশেষ করে, কোনো ভারতীয় নারীর সঙ্গে তুলনা করার পরিবেশ তৈরি হতে পারে—এমন কোনো পোশাক তারা কখনোই পরতেন না। নিজেদের ব্যক্তিত্বে নিজস্বতা ফুটিয়ে তোলার জন্যে তারা ভারতীয় নারীদের তুলনায় আলাদা ধরনের পোশাক আশাক পরতেন। বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে লম্বা বিশাল আকৃতির লেজ বিশিষ্ট সাদা গাউন পরা বিলাতি নারীদের জন্য একটি ঐতিহ্যগত বিষয় ছিল। পোশাকের সঙ্গে লম্বা লেজ থাকায় অনেক ভারতীয় এটিকে ‘বিলাতী নারীর লেজ’ বলেও টিপ্পন্নি কাটত।
তবে গয়না গাটির দিক থেকে তারা ভারতের রাজা মাহারাজাদের স্ত্রী বা কন্যাদের সমতুল্য কখনোই হতে পারত না। এই নিয়ে বিলাতি নারীদের চাপা ক্রোধও ছিল বৈকি! তবে বিলেতে তারা যত না বেশি সাজগোজ নিয়ে মশগুল ছিল ভারতে আসার পর তা যেন আরো এক কাঠি বেড়ে গিয়েছিল। ভারতে নিজেদের ‘উচ্চ শ্রেণী’ হিসেবে পরিচিত করে তুলবার জন্য বিলাতি নারীরা সবসময় অতিরিক্ত পরিমাণেই সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত। ১৭৮০ সালে সোফিয়া গেল্ডবোর্ন নামের একজন বিলাতি নারী—যিনি পরবর্তীতে ‘হার্টলি হাউস’-এর নায়িকা হয়েছিলেন—তার এক বন্ধুকে বিলাতি নারীদের কলকাতাস্থ জীবন নিয়ে লিখছেন, “তারা ভারতে যত না বেশি কাপড় চোপড় পরে নিজ দেশে বিলেতে ততটা পরতেন না। ”
পর্ব ১২ পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫