ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ছায়া ও কায়ার মায়াবিস্তার | অপূর্ব সাহা

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৬
ছায়া ও কায়ার মায়াবিস্তার | অপূর্ব সাহা

বাতাসীর শরীরের গঠন বেশ অদ্ভুত। টিপিক্যাল বাঙালি নারীদের মতো নয়।

সাধারণত গ্রিক দেবীদের দেহসৌষ্ঠব ভাস্করেরা যেভাবে ভাবে অনেকটাই তার কাছাকাছি। যেমন অতিমাত্রায় চিকন কোমর, মৃদু মাসল, উন্নত স্তন, গাঢ় ধূসর ত্বক, লম্বাটে কপোল, গাঢ় বাদামী রঙের দীর্ঘ চুল ইত্যাদি; কিন্তু এই তথ্যগুলো জানা নাই বাতাসীর; বাতাসী শুধু এই জানে সে আলাদা এক শরীরী গঠন নিয়ে জন্মেছে। সে মায়ের শরীর দেখেছে, বোন এবং বন্ধুদের শরীর দেখেছে; সব আলাদা, তার থেকে একেবারে আলাদা। তবে আলাদা হোক আর না হোক শরীর দেখতে তার ভালো লাগে। যেমন নিজেরটা, তেমন অন্যেরটা। ছোটবেলায় কলতলায় গোসল করার সময় মায়ের শরীর দেখত সে; মায়ের সেই জিরজিরে নিষ্প্রাণ নিরস শরীরে ভালো লাগার মতো তো কিছু ছিল না; তবে কেন সে দেখত লোভীর মতো? উত্তর জানা নাই বাতাসীর।

একদিন পারুল আপা মানে বড় বোন—ভরা গাঙের মতো যৌবনবতী-ঘন-গভীর আমবাগানে অকস্মাৎ তার শরীর নিয়ে খেলেছিল; আপার ধনুকের ছিলার মতো টনটনে শরীরটা আজও চোখে গেঁথে আছে তার। বাতাসী তখন কিশোরী। সে কী ভালো লাগা!



মাসকয়েক হলো, আলী আকবর সম্ভবত—সম্ভবত কেন, নিশ্চিত, রিকশা চালানোর কাজটা হারিয়েছে। হারানোরই কথা। শরীর প্রতিবাদ জানিয়েছে না? এখন সম্ভবত সে ভিক্ষা করে, আর ভিক্ষার টাকা দিয়ে গাঁজা-চরস এইসব খায়। খাবেই তো। বিদায়ী শরীরের শোক ভোলার আর উপায় কী?
ক্যান কাজ করতি পারবা না?
আমার শইলে ব্যাধি। এই প্রথমবার সে স্বীকার করে। যেন আমি অপরাধ করেছি এই যে আমাকে ধরো, মারো, বিচার করো, জেল-ফাঁসি যা ইচ্ছা দাও। আমার আর প্রতিরোধের শক্তি নাই



কিন্তু আপা তো বাঁচেনি; বিয়ে হওয়ার পর শ্বশুরবাড়ির লোকজন আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে আপাকে। কী বীভৎস সেই পোড়া দেহটা; না, পোড়া দেহটা তার ভালো লাগেনি। একদম ভালো লাগেনি। দেহটা তো কাঁথার মতো করে অসংখ্য ফোঁড়ে সেলাই করা থাকে; আর সেই সেলাইয়ের একটামাত্র প্রধান গিঁট্টু থাকে যা সেলাইগুলোকে স্থিত করে রাখে; আগুনে পুড়ে গেলে দেহের সেই গিঁট্টুটা খুলে যায় আর সেলাইগুলো এলোপাতাড়ি আলগা হয়ে যেতে থাকে। অন্তত আপার শরীরটা দেখে বাতাসীর তাই মনে হয়েছিল।

কিন্তু টগর আপার ব্যাপারটা আলাদা। ওর গিট্টুটা খুলে যায় নি। ওর হয়েছিল কী—দেহসুতোগুলো পচে যেতে যেতে কমজোরি হতে হতে শেষমেষ বিশ্লিষ্ট হয়ে গিয়েছিল; একটা আরেকটার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। ফলত দেহে কোনো বাঁক ছিল না, কোন বাঁধ ছিল না, একটা আলুথালু অতিকায় মেঘখণ্ডের মতো দেহটা পড়ে ছিল উঠোনে। সেই কবে টগর আপা মানে তার মেঝ-আপা পাচার হয়ে গেল। বিয়ের পরে পরেই। জনশ্রুতি আছে, স্বামীই তাকে মুম্বাই নিয়ে গিয়ে বেচে দিয়ে এসেছিল; শার্শা থানার লক্ষণপুর গ্রামে বিয়ে হয়েছিল আপার। পয়মন্ত সংসার ছিল, তবু কেন যে...পরে বুঝেছে বাতাসী সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে পাচার হয়ে যাওয়াটা ডাল-ভাতের মতো ব্যাপার। স্বামী স্ত্রীকে পাচার করে, বাপ মেয়েকে, ভাই বোনকে।

তারপর কতদিন কেটে গেছে। মানুষ ভুলেই গিয়েছিল টগর আপাকে। টগরের স্বামী আক্কাস মোল্যা লোক দেখানো কান্নাও থামিয়ে দিয়েছিল। হঠাৎ এনজিও’র লোক এসে বলে, পাওয়া গেছে টগরকে, তবে বেঁচে নেই সে। কী করে পাওয়া গেল? মুম্বাইয়ের এক মানব-পাচার নিয়ে কাজ করা এনজিও একটা লালবাতি এলাকা থেকে মুমূর্ষু টগরকে উদ্ধার করে। ক্ষয়কাশে অর্ধেকটা ক্ষয়ে গেছে তখন। ফুসফুসে জমে গেছে অনেক জল। তারা তাদের নিজেদের আশ্রয়কেন্দ্রে টগরকে রেখে চিকিৎসাও করে, কিন্তু বাঁচাতে পারে না। মৃত টগর তখন পাসপোর্টহীন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু আদালত বলে, না, সে অপরাধী না, অপরাধের শিকার; তাকে দেশে প্রত্যাবাসন করা হোক। অবশেষে বাংলাদেশের একটা স্থানীয় এনজিও’র সহায়তায় টগরের লাশ দেশে প্রত্যাবাসন করা হয়। দেহসুতোগুলো পচেগলে গেছে, দেহে কোনো বাঁক নেই, কোনো বাঁধ নেই, একটা আলুথালু অতিকায় মেঘখণ্ডের মতো নিথর দেহ; সর্বাঙ্গ অসৌন্দর্যে ভরা।

তবে সৌন্দর্য দেখেছে সে কানুর শরীরে। আফরোজা কানু। টগর আপার স্বামী আক্কাস মোল্যার দুঃসম্পর্কের বোন। যশোর থেকে ঢাকায় এসে ওর কাছেই তো উঠেছিল প্রথম। দিনমজুর বাপটা সদ্য মারা গেছে তখন; ভাইরা খেতে-পড়তে দিতে গিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করতে শুরু করেছে। ওইরকম একটা ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে কানু তাকে আশ্রয় দেয় রাজধানী শহরে তার ডেরায়।

বস্তির একটা ঘরে একা থাকত কানু। বলত গার্মেন্টে চাকরি করে, কিন্তু আসলে যে কী করত জানে না বাতাসী। তবে টাকা পয়সার অভাব ছিল না তার। ভালো জামা-কাপড় পরত, দামি কসমেটিকস ব্যবহার করত, পার্লারে চুল কাটাত। আর রাতে বাতাসীর শরীর নিয়ে খেলত। শরীরী প্রক্রিয়ায় যেতে ভালো লাগত না বাতাসীর, তবে কানুর নিরাবরণ দেহটা তাকে চুম্বকের মতো টানত। ডিম-লাইটের আলোয় কী অসম্ভব যে সুন্দর দেখাত। ঘুম ফেলে স্বপ্ন ফেলে খালি দেখতে ইচ্ছে করত। কিন্তু পিষ্ট হতে ভালো লাগত না, দম বন্ধ হয়ে আসত। ভয় ও ঈপ্সা। এই দুটো জিনিস তাকে এতটাই উতলা করে তুলত যে সে বাসাবাড়িতে কাজ করতে গিয়ে কাচের গ্লাস ভেঙে ফেলত, চুলা বন্ধ করতে ভুলে যেত। ভালো লাগছিল না ওই ভালো-লাগা আর মন্দ লাগার দ্বৈরথ। তাই বুঝি পালানোর জন্য অনেকটা তড়িঘড়ি করে সে আলী আকবরকে বিয়ে করে ফেলল!

রিকশাচালক আলী আকবর পরিশেষে তাকে এই বস্তিতে এনে ফেলে। পলাশীর বস্তি। গমগমে বস্তি; জীবন আর নোংরা মিলিয়ে এক জমাটি উৎসব। কিন্তু দেহ নাই। বাতাসীর নিজস্ব জীবনে দেহের জায়গায় দেহ-আকৃতির কতিপয় শূন্যতা। না নিজের দেহ, না আলী আকবরের দেহ। কী ব্যাপক শূন্য অন্ধকার, কী বীভৎস দেহহীনতা। নিজেকে দেখার কোনো নিজস্ব জায়গা নেই এখানে। শরীরী প্রতিবিম্ব ফেলার কোনো একান্ত আয়না নেই এখানে, কোনো ফুরসত নেই। আর বিয়ের আগে দেখা সেই ক্ষীপ্র, দুরন্ত আলী আকবর বিয়ের পর দেখতে দেখতে কেমন দেহহীন হয়ে গেল। রক্তহীন মাংসহীন হাত দিয়ে সে বাতাসীকে ধরে, ছোঁয়াছেনা করে...আরো কী কী করে...একটা শিশুও জন্ম নেয়। কিন্তু তারপর আর হাতটাও থাকে না। দুটো হাতের জায়গায় ঝুল ঝুল করে ঝুলতে থাকে শীর্ণ অন্ধকার। শিশুর বয়স আট মাস। এই আট মাসে আলী আকবর একেবারে শূন্য হয়ে গেছে।

আর দেখো না, চারদিকের পৃথিবাটাও কেমন আগাপাশতলা হাট হয়ে গেল! শুধু বেচাকেনা। কেউ হাকছে দাম, কেউ কিনছে পণ্য। সেই দামের কোনো গাছপাথর নাই; পণ্য তৈরি হচ্ছে আর হাটের ভেতর ঢুকে অগ্নিশর্মা হয়ে ফুঁসছে টগবগ করে। আগুনে হাত দেবে বলে মানুষ সর্বস্ব খরচ করে লোহার হস্তবর্ম কিনছে। কিন্তু সবাই না। তাহলে কী করে তারা তাদের হাত বাঁচাবে, শরীর বাঁচাবে পণ্যের ঝাঁঝ থেকে? শরীর তো কোন ধারণা না, বস্তু। তার খাদ্য লাগে। তবেই তো তার সৌন্দর্য ফোঁটে। ফুলের মতো একটু একটু করে ফোঁটে; গাঁদাফুলকে কি মরুভূমিতে ফোঁটানো যায়?

অথচ দেখো, জ্বরের ঘোরে কন্যাশিশুটা থেকে থেকে কঁকিয়ে উঠছে। ওর খাদ্য নাই, ওষুধ নাই। এক সপ্তাহ ধরে জ্বর। এনজিওরা এই বস্তিতে ফ্রিতে কনডম দেয় আরো কী কী সব দেয়, কিন্তু রোগের ওষুধ দেয় না। আজ একজন আপাকে বলেছিল বাতাসী, আমার মায়েটারে একটু দ্যাখেন না, আপা।
কী হয়েছে ওর?
জ্বর।
আমরা তো জ্বর নিয়ে কাজ করি না।
কী নিয়ে কাজ করেন আপনারা?
এইচআইভি এইডস।
ও।
তুমি টেস্ট করিয়েছো? মেয়ের জ্বর তো ভালো কথা না। তোমার এইচআইভি থাকলে সেটা সন্তানের মধ্যেও যেতে পারে। আমাদের ভিসিটি সেন্টার আছে, কালই সেখানে আসো। টেস্ট করাও।
সেই থেকে মেজাজটা খিঁচে আছে। মেয়েটার হপ্তা ধরে জ্বর। ভালো একজন ডাক্তার দেখানো দরকার। পয়সা নাই।
এখন নিশ্চয় অনেক রাত। ক’টা বাজে? ঘড়ি নাই।
কে যায়?
আমি কুদ্দুস।
কুদ্দুস সম্ভবত এ বস্তির একমাত্র ঘড়িধারী ব্যক্তি। ভালোই হলো। সময়টা জানা যাবে।
কয়ডা বাজে ভাই?
সোয়াদশ।
কুদ্দুস গির্জার ঘণ্টা ধ্বনির মতো সময় নির্দেশ করে হারিয়ে যায়। আর তারপরই একটা ছায়া বিস্তৃত হতে শুরু করে ঘরের দরজায়। শীর্ণ ছায়া; ছায়া এবং কায়ার মাঝে মূলত কোনো তফাৎ নাই। ধীরে ধীরে কায়া স্পষ্ট হয়। আজ কায়াটাকে বড় বেশি ভঙ্গুর মনে হচ্ছে, যেন ভেতরে ঘুণের বাসা, আলতো আঘাতেই ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়বে।

আলী আকবরের একটা খুব কঠিন অসুখ হয়েছে। অসুখটা যে কী জানে না বাতাসী তবে স্বরূপটা বোঝে। বুঝেছে কিছুদিন হলো। ফাতেমার জন্মের পর থেকে এই ক’মাস সে বাতাসীর শরীরের ধারেকাছে ঘেঁষেনি; কেন? কারণ খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে সেদিন একটা ইঙ্গিত পেয়ে গেছে বাতাসী। বাথরুমে প্রশ্রাব করতে ঢুকেছিল আলী আকবর; পাশেই টিপকলে কাপড় ধুচ্ছিল বাতাসী। হঠাৎ একটা জান্তব চিৎকার করে আলী আকবরকে লুঙ্গিসমেত পুরুষাঙ্গ চেপে ধরে শেয়ালের কামড় খাওয়া কুত্তার মতো ধেয়ে বের হতে দেখা যায়। তারপর ঘরে ঢুকে যন্ত্রণায় কঁকাতে থাকে।
এক মুহূর্ত চিন্তা করে বাতাসীও ঢুকে পড়ে ঘরে।
তোমার কী হইছে?
আমার কিছু হয় নাই। পচা মরিচের মতো নিজের ঝাঁঝে নিজেই কাতর আলী আকবর।
তাইলে এত্ত এত্ত ওষুধ খাও ক্যান? মগা ইউনানীর গাদা গাদা দাওয়াই নজর এড়াতে পারেনি বাতাসীর। জংধরা তোবড়ানো ট্রাঙ্কের মধ্যে তাদের নিঃশব্দ বসবাস।
জলের ছিটে পাওয়া আগুনে তেঁতে ওঠা কড়াইয়ের মতো ছ্যাৎ করে উঠে আলী আকবর উত্তর দেয়, খাব। যত খুশি খাব। তোর বাপের টাকায় খাই? তুই মুক বন্ধ রাখ।

মুখ তো বন্ধ রাখা যায় সহজে; কিন্তু মন কি বন্ধ রাখা যায়? বন্ধ রাখা যায় চৈতন্যের প্রবাহ? এ বস্তির উত্তর কোণার অধিবাসী গোলাপী সব শুনে বলেছিল, আলী আকবরের সিফিলিস হয়েছে; মরণ ব্যাধি। ডাক্তার দেখা নাইলে তুইও গেছিস!

বাতাসী এখন কোল থেকে জ্বরদগ্ধ ফাতেমাকে বিছানার ওপর নামিয়ে দিয়ে, একটা বালিশের কঙ্কাল তার মাথার তলে গুঁজে দিতে গেলে একরত্তি বাচ্চাটা ওয়াও-ও-ও-ও-ও করে কেঁদে ওঠে। কাঁদুক। স্বামী এবং নিজের মাঝখানের শূন্যতায় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলিয়ে দেয় সে। প্রশ্নটা ঝুলেই থাকে। আর সেই প্রশ্নের নিচে বাচ্চাটার দেহখানা একটা অলৌকিক আলো বিচ্ছুরণ করতে শুরু করে। সে আলোর রঙ আলাদা, আমাদের পৃথিবীর আলোর রঙের মতো নয়। অন্য পৃথিবীর আলো। আলোর তরঙ্গগুলো কেঁপে কেঁপে কিছু একটা বলতে চায়। বাতাসী কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করে। কী বলে ওই মাসুম আলো? ...যখন আমি ভিন্ন পৃথিবী থেকে পরিস্ফুট হতে শুরু করেছি, বিচ্ছুরিত হতে শুরু করেছি, পৃথিবীর আলোর সাথে ঐক্য গড়তে শুরু করেছি, তখন তোমরা আমায় মৃত্যুদণ্ড দিতে চাও? তোমরা তোমাদের জীবনের প্রয়োজনে আমাকে বপন করেছো, জীবনের অপ্রয়োজনে তাকে বিনষ্ট করা কি ইনসাফ হবে?

আলী আকবর তৃতীয় পৃথিবীর মানুষ, সেই আলোকে আলোর তরঙ্গায়িত কথাগুলোকে পাত্তা না দিয়ে তেরচাভাবে হেঁটে যায় ঘরের অন্য কোণে, যেখানে মাটির কলসিতে পানি রাখা আছে। একটা মেলামাইনের রঙচটা গ্লাসে একাই পানি ঢালে। একাই খায়। যেন মুসাফির। একা পৃথিবীতে এসেছে, একাই ফিরে যাবে।

ওষুধপত্তর কিছু আনলে?
ফাতেমা কান্না থামায়; অলৌকিক আলোর বিকিরণও থেমে যায়।
আলী আকবর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দৃষ্টির মরাতাপে বাতাসীকে ভস্ম করে দেয়ার ব্যর্থচেষ্টা করে বলে, ওষুধ কি গাছে ধরে? নাকি আকাশ দিয়া পড়ে? এহন থিক্যা খাওন বন্ধ, ওষুধ তো মেলা দূর...আমি আর কাম করবার পারুম না।

মাসকয়েক হলো, আলী আকবর সম্ভবত—সম্ভবত কেন নিশ্চিত, রিকশা চালানোর কাজটা হারিয়েছে। হারানোরই কথা। শরীর প্রতিবাদ জানিয়েছে না? এখন সম্ভবত সে ভিক্ষা করে, আর ভিক্ষার টাকা দিয়ে গাঁজা-চরস এইসব খায়। খাবেই তো। বিদায়ী শরীরের শোক ভোলার আর উপায় কী?
ক্যান কাজ করতি পারবা না?
আমার শইলে ব্যাধি। এই প্রথমবার সে স্বীকার করে। যেন আমি অপরাধ করেছি এই যে আমাকে ধরো, মারো, বিচার করো, জেল-ফাঁসি যা ইচ্ছা দাও। আমার আর প্রতিরোধের শক্তি নাই।
দড়িছেঁড়া বালতির মতো অতল কূপের অন্ধকার গহ্বরে পড়ে যেতে যেতে বাতাসী বলে, এ্যাখন কী হবে?
কী হবে?
কী হবে?
আমি তো শ্যাষ।
কী করব আমি? প্রশ্ন বাতাসীর। যদিও যা করে বাতাসীই করে। চারটা বাসায় বুয়ার কাজ করে মাসে প্রায় তিন হাজার টাকা রোজগার করছে। কিন্তু কী হয় ওতে? এই ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো একটা ঘরের ভাড়া দিতেই তো অর্ধেকটা চলে যায়। আর তিনটা পেটের আধার? হয় না, হয় না।

বাতাসীর প্রশ্নের উত্তর দেয় আলী আকবর—ক্লান্তি উষ্মা, দ্বেষ, জীবন-বিতৃষ্ণা সব মিলেমিশে তার বাকযন্ত্রে আর্তনাদ করে ওঠে একটা শ্বাপদ: নাইট কর। ওই গতরের কী দাম আছে অ্যা? ঘরে বসে গতরের পাব্বন করে কী লাভ হবেরে? তোর গতর সুন্দর মানি। খাওন না দিলে ওই গতর চিরে চিমসে হবে...

এবার মৃত্যু ঘটে বাতাসীর। নিষ্প্রাণ পড়ে থাকে দেহটা। ফাতেমার পাশে। অনেকক্ষণ। যেন একটা যুগ। যেন একটা শতাব্দী, যেন একটা কাল, মহাকাল...তারপর ফের প্রাণ পায় দেহটা। নড়ে ওঠে। শুরু হয় আলোর বিচ্ছুরণ। অন্য রঙের অন্য পৃথিবীর আলো।

টুংকি আর গোলাপিদের সাথে নাইট করতে বের হয় বাতাসী। রূপের যেন বান ডেকে গেছে শরীরে; রূপ না থাকলে রূপজীবীনি হবে কেমনে?

টুংকি বলে, বাতাসীরে আইজ বাতাসের মতোই লাগছে, কেমন পলকা, শোলার মতো, সোন্দর। হাত দিলেই ভাইঙ্গা যাবে।
বাতাসী বলে, হ। আমি আজ নতুন হাওয়া।
গোলাপি বলে, হাওয়া? আমি তো জানি হাওয়া হচ্ছে পৃথিবীর পরথম মাইয়া-মানুষ।
বাতসী বলে, হুম। পৃথিবীর শেষ মাইয়া-মানুষও ওই হাওয়াই।
তারপর ওরা ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের রাজধানী নামক হাটের ভেতর। মুক্ত বাজারের ভেতর ওরা ছিটিয়ে পড়ে। বড় চাঁদ উঠেছে আকাশে, অনেক জোছনা রাস্তায়, অলিতে-গলিতে।
দোয়েলচত্বরে দুজন যুবকের মুখোমুখি হয় বাতাসী।
তোমার রেট?
তুমরা দু’জন?
হ্যা।
কোথায় নিয়ে যাবা তুমরা?
তোপখানা রোড।
সারারাত?
হুম।
পনেরোশ’ টাকা লাগবে।
পাবে।
হাত বাড়ায় বাতাসী। একটি ছেলে পকেট থেকে ৫০০ টাকার একটি নোট বের করে বাতাসীর হাতে দিলে তার মনে হয় হাতের ভেতর একটা গুলিভরতি সাব-মেশিনগান এসে গেছে; শরীর ব্যোপে সন্তরণ করতে শুরু করে একটা ধাতব শক্তি।
বাকিডা?
সকালে পাবে।
বিশ্বাস করে বাতাসী। ছেলে দু’জন উচ্ছৃঙ্খল নয় আর দেখে বোঝা যায় ধনবান। টাকা নিয়ে খ্যাচরামি করবে না। শক্তি সঞ্চালনের ধারায় যোগ হয় সুখ-প্রবাহ। ফাতেমাকে সে কালই একজন ভালো ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে। জোছনা আর সোডিয়াম আক্রান্ত রাস্তায়, একটা নষ্ট-ভ্রষ্ট দৃশ্যপটে, একটা নিরাপত্তাবোধের চাপবলয়ের ভেতর বাতাসী শরীরে এক অব্যাখ্যাত অনুভূতি বোধ করে। ডাস্টবিনের জঞ্জালের মধ্যে সোনার মাকড়ি খুঁজে পাওয়ার মতো এক অনুভূতি।

ওরা থেমে থাকা গাড়িতে উঠে পড়ে। যুবকদ্বয় বসেছে পেছনের সিটে, তাকে বসতে দিয়েছে সামনে চালকের পাশে। ইচ্ছে করলে দু’জনের মাঝখানে বসিয়ে তাকে তারা মথিত করতে পারত; কেননা বিক্রিত পণ্যের ওপর বিক্রেতার আর কোনো অধিকার থাকে না। কিন্তু তা করেনি। পুলকিত হয় বাতাসী। যুবকদ্বয় অদ্ভুত; দু’জনেররই মেয়েদের মতো লম্বাচুল। পরনে জিন্স আর লম্বা ফতুয়া। দুজনেরই দীর্ঘ পেটানো শরীর।

গাড়ি গিয়ে থামে তোপখানা রোডে একটা হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের সামনে। ওরা লিফটে অনেক উপরে উঠে যায়। চাবি দিয়ে একটা ফ্লাটের লক খুলে ভেতরে ঢোকে। আর কেউ নেই। শুনশান বাসা। উচ্চবিত্তীয় আসবাবে ভরতি। বাতাসী ভাবে, যুবকদ্বয়ের একজন এ বাসার ছেলে, অন্যজন তার বন্ধু। বাসার অন্য সদস্যরা হয়ত বিদেশ বা অন্য কোথাও ট্যুরে গেছে। সেই ফাঁকে বখাটে ছেলে তার বন্ধুকে নিয়ে মৌজ করছে। কিন্তু যুবক দু’জনের চোখদুটো অদ্ভুত। লাল লাল, কেমন নেশা ধরা। উদাসীন। এরা কারা? বাতাসীর চেনা ভুবনের মানুষ এরা নয়; মনে হয় অন্য ভুবনের মানুষ।
যুবকদের একজন অন্যজনকে বলে, চল্ কিছু খেয়ে নিই।
চল্। উত্তর দেয় অন্যজন। বাতসীর দিকে ফিরে সে বলে, তুমিও চলো।
এতক্ষণে ক্ষিধেটা টের পায় বাতাসী। ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে।
খুব খায় ওরা তিনজন। আর এই ভোজনপর্বে বাতাসী ওদের দু’জনের বেশ কাছাকাছি চলে আসে।
একজন বলে, আমার নাম চারু। বেশ অদ্ভুত নাম। কখনো শোনেনি বাতাসী। অন্যজন বলে, আমি সব্যসাচী। এ নাম আরো অদ্ভুত!
তুমি?
বাতাসী।
তুমি আমাদের আসল নাম বলতে পারো। আমরা অন্য কাস্টমারদের মতো না।
আমি আসল নামই বলিছি।
ও।

ওরা খাওয়া শেষ করে একটা ঘরে এসে ঢোকে। এটা কারো শোবার ঘর। পরিপাটি বিছানা। বিছানার উল্টো দিকে বিশাল সাইজের একটা ড্রেসিং টেবিল। এত স্বচ্ছ আয়না কখনো  দেখেনি বাতাসী। ঘরের অন্যপাশে একটা খোলা জানালা। গ্লাস একদিকে সরানো, পর্দাটাও ওঠানো। হু হু করে বাতাস ঢুকছে ঘরে। বাতাসের বেগ দেখে বাতাসীর মনে হয় এটা বারো কিংবা চোদ্দতলা হবে।

ওদের একজন বলে, তুমি বিছানার ওপর উঠে বসো। বাতাসী নির্দেশ মতো বসে। খাটে পা ঝুলিয়ে। আয়নায় চোখ পড়ে; আয়নার প্রতিবিম্বে ওটা কে? তুই তো অনেক সুন্দর রে বাতাসী। তুই তো সেই গ্রামে দেখা সরস্বতীর প্রতিমার মতো সুন্দর।
যুবকদ্বয় ফ্লোরের ওপর হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। একজন ফতুয়ার পকেট থেকে দুটো সিগারেট বের করে সামনে রাখে। বাতাসী জানে ও দুটোতে গাঁজা পুরা আছে।
অন্যজন বলে, তুমি তোমার পোশাকগুলো খুলে ফেলো।
বাতাসী কিছুক্ষণ স্থাণুর মতো বসে থাকে। কী করবে? কিছু তো করার নাই। ওর শরীর তো এখন বিক্রি হয়ে যাওয়া পণ্য। বিক্রি হয়ে যাওয়া পণ্য, এটা মনে হতেই অড়ষ্ঠতা কেটে যেতে শুরু করে। ওইরকম স্বচ্ছ আয়নায় নিজেকে অনাবৃত দেখার লোভ বিস্তার লাভ করতে শুরু করে।

তারপর সে কম্পিত হাতে একটা একটা করে আবরণ উন্মোচন করে। আয়নায় তাকিয়ে দেখে, অপরূপ অপরূপ! এই রকম একটা শরীরী-সম্পদ সে অবহেলা করে নষ্ট করে ফেলছে! খাদ্যের অভাবে ভুগিয়ে ভুগিয়ে চিড়ে-চিমসে করে ফেলছে? এ তো অন্যায়, ঘোরতর অন্যায়।
খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে নগ্ন বসে থাকে বাতাসী প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে। নিজের সৌন্দর্যে নিজেই জ্বলেপুড়ে যেতে যেতে। যুবক দু’জন ফ্লোরে বসে স্টিক ধরিয়ে টানছে আর ওকে দেখছে মাঝে মাঝে। অদ্ভুত তো!
আচ্ছা তোমরা কে গো? তোমরা কী করো?
একজন বলে, আমি শিল্পী। ছবি আঁকি।
অন্যজন বলে, আমি ভাস্কর। মূর্তি বানাই।
প্রথমজন বলে, তুমি ওভাবেই বসে থাকো। আমরা তোমাকে ছোঁব না।
অন্যজন বলে, আমরা রাতভর তোমাকে দেখব।
বাতাসী বলে, আজব তো! আমারে শুধাই এই জন্যি টাকা দিবা?
হুম।
আমারে কী দেখবা?
একজন উত্তর দেয়, তোমারে না তোমার শরীরটা দেখব শুধু।
অন্যজন বলে, না না। শরীরের ভেতর দিয়ে তোমাকেও দেখব।
একজন বলে, ঠিক দেখব না। পাঠ করব। পাঠ করা বোঝ? মানে পড়া। মানুষ যেমন বই পড়ে, আমরা তোমার শরীর তেমন করে পড়ব।
অন্যজন বলে, তুমি কি জানো যে তুমি একটা অসম্ভব সুন্দর শরীরের মালিক?
বাতাসী মিথ্যে বলে, না জানিনে। তোমরা ভারী কঠিন মানুষ। কঠিন কথা কও। বাতাসী বলে আর অসম্ভব এক আনন্দে ভেসে যেতে থাকে।
একজন বলে, না আমরা খুব সহজ মানুষ। জটিল জিনিসকে সহজ করে প্রকাশ করার জন্য তোমার সাহায্য নিচ্ছি। অন্যায় করছি, পাপ করছি। সহজ মানুষেরা সহজে পাপ করে।

আর ঠিক তখন বিদ্যুৎ চলে যায়। ঘন অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘরে। অন্ধকারে তিনটি অনঢ় শরীর, নিস্তব্ধ। কয়েক সেকেন্ড, তারপরই চুই চুই করে জোছনা ঢুকতে শুরু করে জানালা দিয়ে। তারপর হু হু করে ঢুকে পড়ে জোছনা। বাতাসী তাকায় আয়নায়। একটা ভাস্কর্য; অর্ধেক নারীমূর্তি। একফালি মুখমণ্ডল। একটি স্তন। অর্ধেকটা কোমরের বাঁক।

যুবক দু’জনের কেউ একজন হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে। মাই গড! মাই গড! এই রকম একটা ভাস্কর্যের স্বপ্ন দেখছি সেই জন্মের পর থেকে..

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৬

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।