ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বিশ্বের সুদর্শনতম ডুবে মরা পুরুষ | গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ | অনুবাদ: মনজুর শামস

অনুবাদ গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৬
বিশ্বের সুদর্শনতম ডুবে মরা পুরুষ | গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ | অনুবাদ: মনজুর শামস

সাগরের জল ভেঙে ভেঙে চুপিচুপি এগিয়ে আসতে থাকা কালো এবং ফুলে ওঠা বেশ বড়সড় বস্তুটাকে প্রথম যে ছেলেপেলের দল দেখতে পেল তারা নিজেদের এই ভাবনাতেই মেতে থাকতে দিল যে এটি একটি শত্রু-জাহাজ। এরপর তারা দেখল, এর কোনো পতাকা বা মাস্তুল নেই এবং তারা তখন ভেবেই নিল এটি নির্ঘাত একটি তিমি।

কিন্তু যখন এটি তীরে এসে ঠেকল, তারা ছুটে গিয়ে সাগরতলের আগাছার দঙ্গল, জেলিফিশের শুঁয়ো, মাছের উচ্ছিষ্ট এবং ডুবে যাওয়া জাহাজের এটা-সেটা সরাল, তখনই কেবল তারা দেখতে পেল যে এটি আসলে একজন ডুবে মরা মানুষ।

সারাটা বিকেল তারা তাকে নিয়ে খেলল, তাকে বালুতে কবর দিল এবং আবার তাকে সেখান থেকে খুঁড়ে তুলল। এরপর বড়দের একজন তাদের এমন কাণ্ডকারখানা দেখে ফেলল, আর তক্ষুণি সে গ্রামে বিপদের খবরটা চাউর করে দিল। যে লোকেরা তাকে গ্রামের সবচেয়ে কাছের বাড়িটিতে বয়ে নিয়ে এলো, তারা বেশ বুঝতে পারল যে তাদের এ পর্যন্ত জানা যে কোনো মরা মানুষের চেয়ে এই লোকটির ওজন অনেক বেশি, প্রায় একটা ঘোড়ার মতোই হবে ওজন এবং তারা একে অন্যকে বলাবলি করতে থাকল যে লোকটি হয়ত অনেক বেশি সময় ধরে পানিতে ভেসে ছিল এবং এজন্য তার হাড্ডিতে পর্যন্ত পানি ঢুকে গেছে। তাকে বয়ে এনে মেঝেতে শোয়ানোর পর তারা বলল, সে অন্য সকল মানুষের চেয়ে লম্বা, কারণ বাড়িটিতে কোনোমতে তার জায়গা হয়েছে, কিন্তু তারা এও ভাবল—মরে যাওয়ার পরেও বেড়ে ওঠার ক্ষমতা থাকা বোধ করি কোনো কোনো ডুবে মরা মানুষের স্বভাবেরই অংশ! তার সারা দেহে সমুদ্রের জলো গন্ধ এবং তার আকৃতি দেখেই কেউ কেবল ধরে নিতে পারে এটি আসলে একজন মানুষের লাশ, যেহেতু তার গায়ের চামড়া কাদা ও মাছের আঁশের আস্তরণে আবৃত ছিল।



তারা সংগোপনে যার যার পুরুষকে তার সঙ্গে তুলনা করতে থাকল, ধরেই নিল যে এই লোকটি এক রাতে যা করত তা তারা তাদের সারা জীবনেও করতে অক্ষম এবং তারা তাদের হৃদয়ের গভীরে তাদের পুরুষদের শেষমেশ এই ভেবে বাতিল করে দিল যে তারা হচ্ছে সবচেয়ে দুর্বল, সবচেয়ে অধম এবং দুনিয়ার সবচেয়ে অকম্মা। তারা যখন চরম বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে এইসব আজগুবি ভাবনায় বিভোর ছিল তখন তাদের ভেতরে সবচেয়ে বয়স্ক মহিলা, যিনি সবচেয়ে বেশি বয়সের বলেই অন্যদের চেয়ে বেশি সহানুভূতির সঙ্গে ডুবে মরা লোকটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন এবং তার সেই দরদভরা দৃষ্টিতে ভাবাবেগের চেয়ে সহানুভূতিই বেশি ছিল—একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘তার মুখখানা এস্তেবান নামের একজনের মতো



মরা মানুষটি যে আগন্তুক তা জানার জন্য তারা এমনকি তার মুখটা পর্যন্ত ধুয়ে পরিষ্কার করল না। গ্রামটিতে রয়েছে মাত্র বিশের চেয়ে কয়েকটি বেশি কাঠের বাড়ি, যে বাড়িগুলোতে রয়েছে ফুলহীন পাথুরে শুকনো উঠোন এবং মরুভূমির মতো গুহার শেষমাথা পর্যন্ত এই উঠোনগুলো বিস্তৃত। ডাঙার পরিমাণ এতই কম যে মায়েরা সব সময়ই খুব ভয়ে ভয়ে কাটায় এই বুঝি তাদের শিশুদের বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল এবং এই কয়েক বছরে তাদের অল্প যে কয়েকজন মারা গেছে তাদের পাহাড় থেকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়েছে। কিন্তু এদিন সমুদ্রটা ছিল শান্ত ও অবারিত এবং সাতটি নৌকাতেই তাদের সব পুরুষের জায়গা হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং তারা যখন ডুবে মরা লোকটিকে খুঁজে পেল তখন তারা সবাই সেখানে উপস্থিত আছে কিনা বোঝার জন্য স্রেফ একে অন্যের দিকে এক নজর তাকিয়ে দেখাটাই ছিল যথেষ্ট।

সেদিন রাতে তারা আর সমুদ্রে কাজে গেল না। প্রতিবেশী গ্রামগুলো থেকে কেউ হারিয়ে গেছে কিনা খুঁজে দেখার জন্য পুরুষেরা যখন বেরিয়ে গেল, মহিলারা তখন রয়ে গেল ডুবে মরা লোকটিকে সেবা-যত্ন করার জন্য। ঘাসের ন্যাতা দিয়ে ঘষে ঘষে তারা তার দেহ থেকে মাটি পরিষ্কার করল, তার চুলে এবং দেহের নানা জায়গায় আটকে থাকা সাগরতলের নুড়ি-পাথরগুলো ছাড়িয়ে দিল এবং মাছের আঁশ ছাড়ানোর সরঞ্জাম দিয়ে তারা ঘষে ঘষে তার দেহের ময়লার কঠিন আস্তরণ তুলে ফেলল। এসব করতে গিয়ে তারা খেয়াল করে দেখল তার দেহের ওপরে থাকা লতা-পাতা এসেছে দূরবর্তী মহাসাগর থেকে এবং এগুলো খুব গভীর জলের আর তার পরনের কাপড়-চোপড় এমনভাবে ছিঁড়ে ফালিফালি হয়ে গেছে, যেন সে কোরালের গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে তার দেহতরী নিয়ে পাল খাটিয়ে এসেছে! তারা আরো খেয়াল করে দেখল, সে খুব গর্বের সঙ্গে তার মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে, কারণ ডুবে মরা অন্য লোকদের মতো তাকে দেখতে মোটেও বিষণ্ণ লাগছিল না। জলে ডুবে বা ওই ধরনের কোনো বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়ে মরে যাওয়ার পর যাদের লাশ সাগরে ভাসতে ভাসতে আসে, বা যারা নদীতে ডুবে মারা যায় তাদের দেখতে যেমন নিঃস্ব লাগে তাকে তেমনটি লাগছিল না। কিন্তু তাকে সাফ-সুতরো করার পরেই কেবল সে কেমন মানুষ তা তারা বুঝে উঠতে পারল এবং তাতে তাদের তো চরম বিস্ময়ে একবারে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়! তারা এ পর্যন্ত যত মানুষ দেখেছে তাদের ভেতর সে যে কেবল সবচেয়ে লম্বা, সুপুরুষ এবং সবচেয়ে সুগঠিত পুরুষ ছিল তা-ই নয়, বরং যখন তারা তার দিকে তাকিয়ে দেখছিল তাদের তখন এমনকি কল্পনাতেও কুলাচ্ছিল না তার মহিমা।

সারাটা গ্রাম খুঁজেও তারা তাকে শোয়ানোর মতো অত বড় কোনো বিছানা পেল না, রীতি অনুযায়ী শেষকৃত্যের আগে গ্রামের লোকেরা মৃতের চারপাশে জড়ো হয়ে যে শোক প্রকাশ করবে তার জন্য উপযুক্ত কোনো টেবিলও পেল না। গ্রামের সবচেয়ে লম্বা লোকটির ছুটির দিনে কব্জি ডুবিয়ে ভুঁড়িভোজের জন্য তৈরি করা ঢিলেঢালা প্যান্ট তার অনেক খাটো হবে, সবচেয়ে মোটা লোকটির সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পরার জন্য তৈরি ঢোলা শার্টও তার গায়ে অনেক ছোট হবে, আর গ্রামের সবচেয়ে বড় পা যার, তার জুতোও তার পায়ে ঢোকানো যাবে না। তার বিশাল আকার আর সুন্দর চেহারায় মুগ্ধ হয়ে গ্রামের মহিলারা ঠিক করল নৌকার পাল কেটে তার জন্য প্যান্ট তৈরি করবে এবং বিয়ের কনের ব্রাবান্ট লিনেন পোশাক কেটে শার্ট তৈরি করে দেবে—যাতে মৃত্যুতেও তার আত্মসম্মান অটুট থাকে। তারা যখন গোল হয়ে বসে সেলাই করছিল এবং সেলাইয়ের ফাঁকে ফাঁকে মৃতদেহটির দিকে তাকাচ্ছিল তখন তাদের মনে হচ্ছিল যে এর আগে কখনো একই গতিতে এমনভাবে বাতাস বয়নি, সেই রাতের মতো সমুদ্রও কখনো এমন অস্থির হয়ে ওঠেনি এবং তারা ধরেই নিল—এই পরিবর্তনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে এই মৃত লোকটির সম্পর্ক রয়েছে। তারা ভেবে নিল যে এই সুদর্শন লোকটি যদি তাদের গ্রামে বাস করত তবে অবশ্যই তার বাড়ির দরজাগুলো হতো সবচেয়ে চওড়া, ঘরের ছাদ হতো সবচেয়ে উঁচু, এবং তার ঘরের মেঝে হতো সবচেয়ে মজবুত, তার খাট তৈরি করতে হতো জাহাজের মাঝ-কাঠামোকে লোহার বল্টু দিয়ে জোড়া লাগিয়ে এবং তার স্ত্রী হতো সবচেয়ে সুখী মহিলা। তারা কল্পনা করে নিল, তার নিশ্চয়ই এমন ক্ষমতা ছিল যে—সে স্রেফ নাম ধরে ডেকে সমুদ্র থেকে মাছকে তুলে আনতে পারত এবং সে তার জমিতে এতই কাজ করত যে পাথর ফেটে ঝরনা বয়ে যেত—যাতে সে সাগরের পাথুরে ঢালে ফুলের গাছ লাগাতে পারে। তারা সংগোপনে যার যার পুরুষকে তার সঙ্গে তুলনা করতে থাকল, ধরেই নিল যে এই লোকটি এক রাতে যা করত তা তারা তাদের সারা জীবনেও করতে অক্ষম এবং তারা তাদের হৃদয়ের গভীরে তাদের পুরুষদের শেষমেশ এই ভেবে বাতিল করে দিল যে তারা হচ্ছে সবচেয়ে দুর্বল, সবচেয়ে অধম এবং দুনিয়ার সবচেয়ে অকম্মা। তারা যখন চরম বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে এইসব আজগুবি ভাবনায় বিভোর ছিল তখন তাদের ভেতরে সবচেয়ে বয়স্ক মহিলা, যিনি সবচেয়ে বেশি বয়সের বলেই অন্যদের চেয়ে বেশি সহানুভূতির সঙ্গে ডুবে মরা লোকটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন এবং তার সেই দরদভরা দৃষ্টিতে ভাবাবেগের চেয়ে সহানুভূতিই বেশি ছিল—একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘তার মুখখানা এস্তেবান নামের একজনের মতো’।

সত্যিই তাই। তার যে আর কোনো নাম থাকতে পারে না তা নিশ্চিত হতে তাদের বেশির ভাগেরই তার দিকে কেবল আরেকবার তাকানোই যথেষ্ট ছিল। তাদের ভেতর সবচেয়ে একগুঁয়ে ছিল সবচেয়ে কম বয়সের মেয়েটি, সে আরো কয়েক ঘণ্টা নিজের ভাবনার ঘোরের ভেতরই রইল। তারা যখন তাকে তার জামা-কাপড় পরিয়ে এবং বিশেষভাবে তৈরি চামড়ার জুতো পরিয়ে ফুলের মাঝে শুইয়ে দিল, তখন তার মনে হলো লোকটির নাম হয়ত লতারো। কিন্তু এটি ছিল এক নিষ্ফল বিভ্রম। পালের কাপড়, অর্থাৎ ক্যানভাসের পরিমাণ যথেষ্ট ছিল না, যেনতেন করে কাটা আর বাজেভাবে সেলাই করা তার জন্য তৈরি করা প্যান্টটা খুবই আঁটসাঁট হয়ে গেল এবং তার হৃৎপিণ্ডের লুকানো শক্তিতে পটপট করে তার শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেল। মাঝরাতের পর সমুদ্রের শোঁ শোঁ গর্জন আর থাকল না এবং সমুদ্র তার নেতিয়ে পড়া শ্রান্ত-অবসন্ন দশায় ফিরে এলো। সে যে এস্তেবানই ছিল সে ব্যাপারে সর্বশেষ সংশয়ীও এক সময় একেবারে চুপ মেরে গেল। যে মহিলারা তাকে পোশাক পরিয়েছিল, চুল আঁচড়ে দিয়েছিল, তার নখ কেটে দিয়েছিল এবং কামিয়ে দিয়েছিল—তাকে মাটির ওপর দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় তারা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল এবং তারা তাদের মমতার গভীর থেকে উঠে কাঁপুনি কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখতে পারছিল না। আর তখনই কেবল তারা বুঝে উঠতে পেরেছিল যে এই বিশাল বপু নিয়ে সে নিশ্চয়ই খুব অসুখী ছিল—যেহেতু এমনকি মৃত্যুর পরেও তার বিরাট দেহ তাকে ভীষণ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। তারা তাকে তার জীবনে দেখতে পাচ্ছিল—দেখতে পাচ্ছিল দরজার ভেতর দিয়ে পাশ ঘেঁষে যেতে হচ্ছে বলে সে খুঁত ধরে মুখে নিন্দার খই ফোটাচ্ছে, কড়িকাঠে মাথায় ঠোকা খাচ্ছে, কোথাও বেড়াতে গেলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে তার সিন্ধুঘোটক মার্কা নরম গোলাপি মোটা দুটি হাত দিয়ে কী করবে—যে বাড়িতে বেড়াতে গেছে সেই বাড়ির বাড়িওয়ালি যখন তাকে বসতে দেয়ার জন্য সবচেয়ে মজবুত চেয়ারটা খুঁজছে এবং ভীষণ ভয়ে ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলছে—এস্তেবান, দয়া করে এখানে বসো এবং সে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বলছে—না ম্যাডাম, অত ব্যস্ত হবেন না, আমি যেখানে আছি ভালোই আছি, তার গোড়ালিতে ছিলে যাওয়া যন্ত্রণা এবং সে যেখানেই বেড়াতে যাক না কেন—স্রেফ বসে পড়ে চেয়ার ভাঙার লজ্জা এড়াতে তাকে সেই একই কথা বলে যেতে হয়—ব্যস্ত হবেন না ম্যাডাম, আমি যেখানে আছি ভালোই আছি এবং হয়ত কখনো সে জানতেই পারে না যে, যারা তাকে বলে, ‘যেও না এস্তেবিয়ান, কমপক্ষে কফি তৈরি করা পর্যন্ত অপেক্ষা করো’—তারা পরে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘যাক, হাবড়া গবেটটা শেষমেশ ভেগেছে তা হলে! কী চমৎকার, সুদর্শন বুদ্ধুটা চলে গেছে!’

ভোরের আলো ফোটার একটু আগ পর্যন্ত মহিলারা মরদেহটার পাশে এই ধরনের সব ভাবনাতেই মগ্ন ছিল। তাকে যাতে রোদের বিরক্তি সইতে না হয় সেজন্য পরে যখন তারা একটি রুমাল দিয়ে তার মুখটি ঢেকে দিয়েছিল তখন তাকে দেখে এতটাই চিরমৃত মনে হচ্ছিল, এতটাই অরক্ষিত মনে হচ্ছিল, এতটাই তাদের পুরুষদের মতো লাগছিল যে কান্নার প্রথম দমকটা উথলে উঠল তাদের হৃদয়ের গভীর থেকেই। কান্নাটা শুরু করল কম বয়সী মহিলাদের একজন। অন্য মহিলারাও দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে এক সময় বিলাপ জুড়ে দিল এবং যতই তারা ফুঁপিয়ে উঠতে লাগল ততই তাদের আরো বেশি বেশি কান্না পেতে লাগল, কারণ ডুবে মরা লোকটি এরই মধ্যে তাদের কাছে এস্তেবানের চাইতেও বেশি কিছু হয়ে উঠেছিল, আর সেজন্যই তারা এত বেশি কান্নাকাটি করছিল—যেহেতু সে ছিল আরো বেশি দুর্গত, সবচেয়ে শান্ত, এবং পৃথিবীর সবচেয়ে পরোপকারী, হতভাগা এস্তেবান! সুতরাং পুরুষরা যখন এই খবর নিয়ে এলো যে ডুবে মরা লোকটি আশপাশের কোনো গ্রামেরই নয়, তখন মহিলারা তাদের কান্নার ভেতরেও কিছুটা যেন বিজয়ানন্দ অনুভব করল।

‘সকল প্রশংসা ঈশ্বরের’, তারা হাঁপ ছেড়ে বলে উঠল, ‘সে আমাদের!’

পুরুষেরা ভাবল এই বাড়াবাড়ি নারীসুলভ লঘুচিত্ততা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই লোকটা আশপাশের গ্রামের কেউ কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে রাতেরবেলায় তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান চালাতে হয়েছে বলে তারা সবাই ভীষণ ক্লান্ত ছিল, আর তাই কাঠখোট্টা-শুকনো-গুমোট বাতাসহীন দিনে সূর্য তেজ ছড়াতে শুরু করার আগেই এই আগন্তুকের ঝামেলা থেকে তারা মুক্ত হতে চায়। হাতের কাছে তারা যা জঞ্জাল পেল—অর্থাৎ নৌকার সামনের একটি মাস্তুল এবং ছিপে গাঁথা মাছ ডাঙায় তোলার জন্য বড়শিযুক্ত একটি লাঠি লাশটির সঙ্গে দড়ি দিয়ে ভালো করে বেঁধে নিল, যাতে তারা সমুদ্রতীরের খাড়া পাহাড়ে পৌঁছার আগ পর্যন্ত এগুলো লাশটির ভার সইতে পারে। তারা লাশটির সঙ্গে মালটানা জাহাজের একটি নোঙর বেঁধে দিতে চেয়েছিল, যাতে এটি সহজেই গভীরতম ঢেউয়ের ভেতর ডুবে যায়, যেখানে মাছেরা চোখে দেখতে পায় না এবং ডুবুরিরা স্মৃতিকাতরতায় মরে যায়, এবং পাজি স্রোত তাকে যেখান থেকে আবার তীরে নিয়ে আসতে পারবে না, যেমনটি হামেশাই ঘটে থাকে অন্যান্য লাশের ক্ষেত্রে। কিন্তু যতই তারা তাড়াহুড়া করছিল ততই মহিলারা সময় নষ্ট করার ফিকির করছিল। তারা চমকে ওঠা মুরগির মতো হেঁটে বেড়াচ্ছিল আর তাদের গলার হারের লকেটগুলো বুকের ওপরটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দোল খাচ্ছিল, তাদের অনেকে ডুবে মরা লোকটির একপাশে একটি ক্রুশ রাখতে বলছিল যাতে তার ওপর দিয়ে মঙ্গল-বায়ু বয়ে যায়, কেউ কেউ আবার অন্যপাশে একটি কব্জি-কম্পাস রেখে দিতে বলছিল, এবং অনেক কসরত করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পর এক মহিলা পথ থেকে সরে এসে বলে উঠল, আরে, দেখো তো!—তোমরা যে আমাকে মরা মানুষটার ওপরে ফেলেই দিচ্ছিলে ধাক্কিয়ে! পুরুষেরা তাদের কলজের ওপর ভরসা হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছিল এবং রাগে গজরাতে গজরাতে বলছিল—একজন অচেনা মানুষের জন্য কেন খামাকা এই গির্জার মূল বেদির মতো সাজসজ্জা? কতগুলো পেরেক দিয়ে তাকে গাঁথা হয়েছে তার ওপর এবং কত কলস পবিত্র জল ছিটানো হয়েছে তার গায়ে তাতে কী এসে-যায়? হাঙরেরা তো তাকে সেই একইভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে, নাকি? কিন্তু মহিলারা তাদের পবিত্র স্মৃতি হিসেবে এইসব ফালতু জিনিস মরা লোকটার ওপর জড়ো করতেই থাকল, সামনে-পেছনে ছোটাছুটি করতেই থাকল, চোখের পানি না ফেললেও দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে হোঁচট খেতে থাকল, আর এভাবেই স্রোতে ভেসে আসা একটি লাশের জন্য, একজন ডুবে মরা মানুষের জন্য—যে কিনা কারো কেউ নয়, যে কিনা নিছকই বুধবারের এক টুকরো ঠান্ডা মাংস (জেলেরা সাধারণত বৃহস্পতিবার সাগর থেকে ফিরে আসে, তাই বুধবার নাগাদ সব রসদ প্রায় শেষ হয়ে যায়, ঠান্ডা-বাসি হয়ে যায়)। এমন বাড়াবাড়ি রকমের ত্রস্তব্যস্ততার পর শেষমেশ পুরুষেরা শবযাত্রা শুরু করল। মহিলাদের ভেতর একজন, কেউ কোনো পাত্তা দিচ্ছিল না বলে এতক্ষণ যে মনে মনে খুব অপমান বোধ করছিল, এবার সে এগিয়ে এসে মৃত লোকটির মুখের ওপর থেকে রুমালটি সরিয়ে দিল এবং পুরুষেরা রুদ্ধশ্বাসে যাত্রা শুরু করল।

সে ছিল এস্তেবান। তাকে চেনার জন্য এটা আর তাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়ার দরকার নেই। তাদের যদি স্যার ওয়াল্টার র‌্যালি (তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ অভিযাত্রী) সম্পর্কেও বলা হতো, এমনকি যদিও তারা হয়ত তার মার্কিন উচ্চারণভঙ্গিতে মুগ্ধই ছিল, তার কাঁধে বসা ম্যাকাও পাখি, তার নরখাদক মারার ব্লান্ডারবাসের (এক ধরনের সেকেলে গাঁদা বন্দুক, যেগুলোতে গুলি করার অনেকগুলো ছিদ্র থাকত এবং অল্প দূরত্বে একসঙ্গে অনেকগুলো গুলি করা যেত) জন্য চমৎকৃত হতো, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের দুনিয়াতে একজনই এস্তেবান থাকতে পারত, এবং এই হচ্ছে তাদের সেই এস্তেবান, একটা স্পার্ম তিমির মতো হাত-পা ছড়িয়ে আছে, জুতোহীন, শিশুদের খাটো হয়ে যাওয়া প্যান্টের মতো একটি প্যান্ট পড়ে আছে, নখগুলো পাথরের মতো শক্ত, যা কাটতে হতো ছুরি দিয়ে। তার মুখের ওপর থেকে রুমালটি তাদের সরিয়ে নিতে হয়েছিল এটা দেখতে যে—সে যে এত বড়, বা এত ভারী বা এত সুদর্শন সেজন্য সে লজ্জিত, এবং সে যদি জানত এমনটি ঘটতে চলেছে তা হলে ডুবে মরার জন্য আরো ভেবেচিন্তে বিবেচনা করে জায়গা বাছাই করে নিত, সত্যি বলছি, আমি হলে এমনকি পাল তোলা স্প্যানিশ গ্যালিওন জাহাজ থেকে নোঙর খুলে এনে আমার গলায় বাঁধতাম এবং সমুদ্রপাড়ের কোনো খাড়া পাহাড়ের ঢাল থেকে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে পানিতে পড়তাম সেই ধরনেরই কারো মতো—যারা চায় সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলুক, এই ক্লান্তিকর-বুধবারের মরদেহ হয়ে যারা মানুষকে বিপর্যস্ত করে তুলতে চায় না, তোমরা মানুষেরা যেমনটি বলো—পচা এক টুকরো ঠান্ডা মাংস দিয়ে অন্য কাউকেই বিব্রত না করা, যাতে আমার কোনোকিছুই যায়-আসে না। তার স্বভাবে এতটাই সত্যনিষ্ঠতা ছিল যে, এমনকি সবচেয়ে আস্থাহীন পুরুষেরাও, যারা সাগরে অন্তহীন রাতগুলোতে এই ভাবনায় মনে মনে বিধ্বস্ত হতে থাকে যে তাদের স্ত্রীরা এখন আর তাদের স্পপ্নেও দেখে না—তারা স্বপ্নে দেখে ডুবে মরা মানুষদের, এমনকি তারা এবং অন্য যারা এখনো শক্ত আছে তারা তাদের অস্থিমজ্জায় এখনো কেঁপে ওঠে এস্তেবানের এই সততায়।

এভাবেই একজন পরিত্যক্ত ডুবে মরা মানুষের জন্য তারা তাদের ভাবনার পরিধির মধ্যে থেকে—তাদের জীবনের সবচেয়ে চমকপ্রদ শেষকৃত্য অনুষ্ঠানটি পালন করল। যে কয়েকজন মহিলা পাশের গ্রামগুলোতে ফুল আনতে গিয়েছিল তারা অন্য কয়েকজন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো—যারা তাদের যা বলা হচ্ছিল তা বিশ্বাস করতে পারছিল না, এবং তারা যখন মৃত মানুষটিকে দেখল তখন আরো ফুল আনতে ফিরে গেল, এবং তারা আরো আরো বেশি করে ফুল আনতে থাকল—যতক্ষণ না এত বেশি ফুল এবং এত বেশি মানুষ জমে গেল যে সেখানে হাঁটাই এক মুশকিলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। শেষ সময়ে এসে একজন এতিম হিসেবে তাকে পানিতে ফিরিয়ে দিতে তারা মনে ভীষণ কষ্ট পেল এবং তারা তাদের সেরা মানুষদের ভেতর থেকে তার জন্য একজন বাবা ও একজন মা, এবং চাচি, চাচা, চাচাতো ভাই-বোনও বেছে নিল, সুতরাং এভাবে তার মাধ্যমে পুরো গ্রামবাসী একে অন্যের আত্মীয় হয়ে গেল। নাবিকদের ভেতর যারা দূর থেকে কান্না শুনল তারা ভুল পথে চলে গেল এবং লোকে শুনতে পেল তাদের একজন নিজেকে মূল মাস্তুলের সঙ্গে বেঁধে ডানাওয়ালা সেইসব নারীদের নিয়ে কল্পকাহিনী স্মরণ করেছিল, যাদের গান নাবিকদের মুগ্ধ করে সর্বনাশের পথে নিয়ে যেত। দুটি ভিন্ন উচ্চতার এলাকার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তাকে কাঁধে নিয়ে ওঠার জন্য যখন তারা সুবিধামতো একটি পথ খুঁজছিল তখন তাদের নারী ও পুরুষেরা এই প্রথমবারের মতো তাদের জনমানবশূন্য পথ, তাদের উঠোনের নীরস-শুষ্কতা সম্পর্কে এবং ডুবে মরা মানুষটির চমৎকারিত্ব ও সৌন্দর্যের দেখা পেয়ে তাদের স্বপ্নের সঙ্কীর্ণতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল।

তারা তাকে একটি নোঙর ছাড়াই চলে যেতে দিল, যাতে সে ইচ্ছে করলেই আর যখনই ইচ্ছে করবে তখনই আবার ফিরে আসতে পারে, এবং অনেক শতাব্দীর ভগ্নাংশ ধরে তার দেহটি অন্তহীন গহ্বরে পড়া পর্যন্ত তারা সবাই তাদের নিশ্বাস বন্ধ করে রাখল। তারা সবাই যে আর বর্তমানে নেই, তারা যে আর কখনোই বর্তমানে থাকবে না—তা বোঝার জন্য তাদের আর একে অন্যের দিকে তাকাতে হলো না। কিন্তু তারা এও জানত যে তার পর থেকে সবকিছুই বদলে যাবে, তাদের ঘরে থাকবে বড় বড় দরজা, উঁচু ছাদ, এবং এর চাইতে শক্ত মেঝে, যাতে এস্তেবানের স্মৃতি কড়িকাঠের সঙ্গে ঠোকা না খেয়ে সব জায়গায় বিচরণ করতে পারবে এবং ভবিষ্যতে ফিসফিসিয়ে কেউ যাতে বলতে সাহস না পায় যে বিশালদেহী উজবুকটা শেষমেশ মারা গেছে, খুবই খারাপ, সুদর্শন হাবাগোবাটা অবশেষে মারা গেছ, কারণ তারা তাদের বাড়ির সামনের দিকটা উজ্জ্বল রঙে রঙ করে নিতে যাচ্ছে যাতে এস্তেবানের স্মৃতি চির অম্লান হয়ে থাকে এবং তারা তাদের বাড়ির পেছন দিকটা ভেঙে খুঁড়ে নেবে যাতে পাথরের মাঝ দিয়ে ঝরনা বয়ে যেতে পারে এবং পাহাড়ে ফুলের গাছ লাগিয়ে দেবে যাতে ভবিষ্যত বছরগুলোতে বড় বড় যাত্রীবাহী জাহাজ থেকে যাত্রীরা ভোরবেলায় খোলা সাগরে বাগানের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে জেগে উঠতে পারে, এবং ক্যাপটেন তার ক্যাপটেনের পোশাক পরে ব্রিজ থেকে নেমে আসতে পারে তার গ্রহ-নক্ষত্রের উন্নতি নির্ণয়ের মধ্যযুগীয় যন্ত্র, তার ধ্রুবতারা, এবং তার যুদ্ধের পদকের সারি সমেত এবং, দিগন্তে উপকূলরেখা থেকে উঠে আসা উঁচুভূমির গোলাপগুলো দেখিয়ে চৌদ্দটি ভাষায় বলে উঠতে পারে—ওদিকে তাকাও, যেখানে বাতাস এখন এতটাই শান্তশিষ্ট যে তা বিছানার নিচে ঘুমাতে চলে গেছে, ওইদিকে তাকাও, যেখানে রোদ এত উজ্জ্বল যে সূর্যমুখী ফুলগুলো বুঝতে পারছে না কোন দিকে ফিরবে, হ্যাঁ, ওইদিকে, ওটাই এস্তেবানের গ্রাম।



বাংলাদেশ সময়: ১৭৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৬

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।