জন্মের পর মানুষ বাদে যে প্রাণীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়, সে হলো গুঁইসাপ। মফস্বলে ছিলাম তখন।
সাম্পান ভিলায় ঢুকতেই একটা বারান্দা। বারান্দার দু’পাশে সিমেন্ট দিয়ে বসার জায়গা করা। ভেতরে পরপর দুটো ঘর। পেছনের ছোট্ট উঠোনের শেষমাথায় রান্নাঘর। রান্নাঘরটা মাটির। পেছনে একটা বাঁশঝাড় ছিল। ঝাঁড়ের ভেতর একটা ডোবা। সেখানেই থাকত গুঁইসাপের দল। মাঝে মাঝে হানা দিত আমাদের রান্নাঘরে। কখনোবা কলপাড়ে। লড়াই যখন প্রতিদিনের হয় তখন আর তা লড়াই থাকে না। হয়ে যায় স্বাভাবিক। রোজ রোজ গুঁইসাপ দেখে সবাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আর আমি তো ভয় কী জানার আগেই পরিচিত হয়েছি খড়খড়ে দেহের ওই প্রাণীটার সঙ্গে। আমার কাছে ওরা হয়তো ছিল ভিন্ন গড়নের মানুষ।
শান্ত ভাই বলল—বৌ হবি?
- হ্যাঁ।
- আমার বৌ?
- হ্যাঁ।
- আচ্ছা বড় হয়ে নে, তারপর লাল শাড়ি পরিয়ে নিয়ে যাব তোকে।
- আচ্ছা।
শোবার ঘরের পশ্চিমপাশের জানালা দিয়ে বাঁশঝাড়টা দেখা যেত। দেখা যেত ওদেরও। গুঁইসাপের কথা বলছি। মিতুল বুবু ওদের দেখিয়ে ভাত খাওয়াতেন আমাকে।
সামনের বিশাল উঠোন পেরিয়ে বড় রাস্তা। রাস্তার সঙ্গে লাগোয়া দুটো ঘাট। একটাতে তাল গাছ ফেলা আর অন্যটা শান বাঁধানো। কী যে অদ্ভুত সুন্দর সেটা।
আমি রোজ বিকেলে লাল প্যাঁ-প্যুঁ শব্দ করা জুতো পায়ে নাচতে নাচতে যেতাম সেখানে। একা না। যেতাম নিহার কাকার হাত ধরে। ওই যে বলেছিলাম উঠোনের ওপর দুটো বাড়ি। আমাদেরটা বাদে আরেকটা যে বাড়ি সেটাই নিহার কাকার। নিহার কাকার তিন মেয়ে। বড় মেয়ে লাভলি আপা। আর ছোট দু’জন জমজ। দিতি আর দিনা আপা।
লাভলি আপা খুব আদর করতেন আমাকে। রোজই বাড়ি এসে আমাকে নিয়ে যেতেন তাদের বাসায়। রোজ রোজ সাজিয়ে দিতেন আমাকে। কখনো শাড়িও পরিয়ে দিতেন। উনার সঙ্গে থেকেই অাইলাইনার নামক সাজের উপকরণের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। আমার বোনদের সেটা ছিল না। মিতুল বুবুরা কাজল পরত। লাভলি আপা যেখানেই যেতেন নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন আমাকে। মা অবশ্য সবসময় যেতে দিতেন না। মাঝেমাঝে দিতেন। লাভলি আপার মাও খুব ভালোমানুষ ছিলেন। কাকীমা ভালো কিছু রাঁধলেই মা’র জন্য নিয়ে আসতেন।
মা প্রায়ই বলেন, ‘পুতুল ছোটবেলায় ভীষণ দুষ্টু ছিল। দরজা খোলা পেলেই দৌড়ে বেরিয়ে যেত। ’ আমারও মনে হয় আমি ভীষণ চঞ্চল ছিলাম। দরজা খোলা পেলেই এক দৌড়ে চৌরাস্তার মাথায়!
বাড়ির উঠোনটা ছিল বিশাল। সুপাড়ি বাগান ছিল একপাশে। স্কুল থেকে ফিরেই তুতুল বুবু মোটা শলার ঝাড়ুটা নিয়ে উঠোনে নামত। এমাথা থেকে ওমাথা ঝাড়ু দিত। একটা বাঁশের ঝুড়িতে পাতা আর ময়লা রেখে দিত। বিকেলে ঝকঝকে উঠোনে এক্কা দোক্কা খেলার ঘর কাটত দিতি আপা। কোমরে ওড়না বেঁধে লাফাতে শুরু করত। আমার তুতুল বুবুও তাই। আমার বড় দুই বোন। মিতুল আর তুতুল। মিতুল বুবু কলেজ ছাড়া বেরই হয় না ঘর থেকে। আর তুতুল বুবু সন্ধ্যা অব্দি উঠোনে খেলতে পারে। এরপর মায়ের ডাকাডাকি শুরু হয়। ঘরে এসে পড়তে বসার জন্য। আমারও পড়াশোনা ছিল। কিন্তু ওই আতা গাছে তোতা পাখি অব্দি। বই পড়া শেষ তো ছিঁড়ে ফেলে দাও তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলাম। এর মধ্যে দরজা খোলা পেলে দৌড়ের বিষয়টি তো আছেই।
সামনের বারান্দার পরের ঘরটায় বসে তুতুল বুবু পড়ত। মাটিতে বসে নিচু টি-টেবিলে বই রেখে ঝুলে ঝুলে পড়ত। মিতুল বুবু কখনো পড়ত, কখনো বাতি নিভিয়ে শুয়ে থাকত। কাছে গেলেই বলত—সোনাপুতুল কথা বলো না, মাথা ব্যথা।
মিতুল বুবুর একটা ব্যাপার ছিল। আমাদের খাটের পাশে সে মস্ত লম্বা একটা চেলাকাঠের ফালি রেখে দিত। রাতে কোনো শব্দ পেলেই ওই লাঠি নিয়ে দরজা খুলত, চারপাশ দেখত। অবশ্য কারণও ছিল। চোরের যা উপদ্রব ছিল বলার মতো না। তারপর বাবাও ঢাকা থাকতেন। মফস্বলে কেবল আমারা মা-মেয়েরাই ছিলাম। নিরাপত্তার ব্যাপার ছিল। মাঝে মাঝে অবশ্য মামা আসতেন। এসে খোঁজখবর নিতেন। বাজারও করে দিতেন। সবচেয়ে বেশি খোঁজ রাখতেন নিহার কাকা আর তার পরিবার। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে, মানে উঠোনের ওপর থেকেই সোনাপুতুল বলে ডাক দিতেন কাকা। উড়ন্ত ফড়িংয়ের মতো এক ঝটকায় তার কোলে উঠে যেতাম আমি। আমাকে নিয়েই ঘরে ঢুকতেন। মাঝে মাঝে মা চা বানিয়ে নিহার কাকা আর কাকীমার ঘরে নিয়ে যেতেন। মাও সেখানে বসেই চা খেতেন কখনো। নিহার কাকা তার কাপ থেকে পিরিচে চা ঢেলে আমাকে দিতেন। আমি খেতাম। নিহার কাকা চা খাওয়ার সময় সুড়ুৎ করে শব্দ হতো। আমার বিরক্ত লাগত। মাঝে মাঝে কাকা আমাকে রাগাতেই ইচ্ছে করে শব্দ করতেন।
- উফ কাকা শব্দ করো না তো!
- কেন রে?
- বিরক্ত লাগে।
- আর তুই যে লাল জুতো পড়ে প্যাঁ-প্যুঁ করিস তখন শব্দ হয় না!
একদিন বিকেলে এভাবেই চা খাচ্ছিলাম আমরা। ছোট জানালা দিয়ে দেখলাম বিপুল ভাইয়ের সঙ্গে বাইকে চড়ে একটা ছেলে। কাঁধে ব্যাগও আছে ছেলেটার। কখনো তাকে দেখিনি। বিপুল ভাই নিহার কাকার বড় ছেলে। উনি বেশিরভাগ সময় লাল টি-শার্ট আর কালো জিন্স পরতেন। টি-শার্টটা ইন করা থাকত, চোখে সানগ্লাস। সে সময়কার স্মার্ট ছেলে।
বিপুল ভাই আর ওই ছেলেটা ঘরে ঢুকল।
- খালা কেমন আছো?
- শান্ত, একাই এলি?
- হ্যাঁ খালা। মা এলো না।
আরো কিছু কথাবার্তায় বুঝলাম কাকীমার বোনের ছেলে শান্ত। ১৫-১৬ বয়স হবে। তুতুল বুবুর মতো। ধবধবে ফর্সা। ঝরঝরে চুল। চোখটা বিড়ালের চোখের মতো ঘোলা। চা খাওয়া হয়ে গেছে। মা কাপ-পিরিচ গুছিয়ে আমাকে নিয়ে চলে এলেন।
আমি আমাদের বারান্দায় বসে আছি। বারান্দা থেকে বিপুল ভাইয়ের ঘরের জানালা দেখা যায়। দেখলাম শান্ত ছেলেটা বসে আছে। খুব হাসছে। সামনে কেউ কথা বলছে বোঝা গেল। কিন্তু কে সেটা দেখা যাচ্ছে না। নিয়মমাফিক দিতি আর দিনা আপা এক্কা-দোক্কা খেলতে উঠোনে এসেছে। আজ দু’জনেই খুব সেজেছে। খুব বলতে চুলটা একটু বেশি পরিপাটি। দু’জনেই টিপ পরেছে। খেলার ঘর কাটাই ছিল উঠোনে। এখনো স্পষ্ট। কিন্তু আজ তারা বিপুল ভাইয়ের জানালার সামনে ঘর কাটার যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে। অনেকক্ষণ দিতি আপা তুতুল বুবুকে ডাকল খেলার জন্য। বুবুও আজ খুব মনোযোগী অঙ্ক করায়। সে আজ খেলবে না শুনে মনে হলো দিতি-দিনা দু’বোন খুশিই হয়েছে। আমি এসব খেলায় দুধভাত। মাঝে মধ্যে দু’একটা লাফ দিতে দেয় ওরা। কাজেই সিঁড়িতে বসে রইলাম রোজকার মতো।
আজ ওরা বড্ড হাসছে। হাসির চেয়ে শব্দ বেশি। কারণে-অকারণে ভুল করে জানালার দিকে ঘেঁষে যাচ্ছে। একটু পর বিপুল ভাই স্মার্টলি ঘর থেকে নেমে বাইক নিয়ে বের হলো। যাবার সময় আমাকে বলল—যাবি নাকি সোনাপুতুল? দিঘিতে?
- যাব না।
- ঠান্ডার মধ্যে খালি পায়ে কেন? স্যান্ডেল পর।
- আচ্ছা।
বাইকে ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে চলে গেলেন বিপুল ভাই। বিপুল ভাই বেরিয়ে যাওয়ার পর দিতি-দিনার খেলার জোর বেড়ে গেল আরো। পাখনা থাকলে উড়েই যেত বোধহয়। মাগরিবের আজান পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যেই। আমাদের বাইরের লাইট জ্বালানো হয়েছে। মানে মা এখনই ঘরে ঢুকতে বলবেন। এমন সময় শান্ত ভাই বের হলো ঘরে থেকে।
- কী করিস তোরা? এটা কোনো খেলা হলো?
দিতি আপা লাল হয়ে গেলেন। আঙুল নাচিয়ে বললেন—শোনো যেটা বোঝো না, সেটা নিয়ে কথা বলবে না।
দিনা আপা বললেন—শান্ত ভাই, দিতির সাথে কথা বলো না। সে বেশি বোঝে।
শান্ত ভাই হেসে চারপাশে তাকিয়ে আমাকে আবিষ্কার করল।
- তোমার নাম পুতুল?
- হ্যাঁ।
- খেলো না তুমি?
- পারি না।
- ও
- কে পড়ছে ভেতরে?
- তুতুল বুবু।
- ও আচ্ছা। তোমার বুবু খেলে না?
- খেলে, আজ তোমাকে দেখেছে তাই বাইরে বের হয়নি।
- তাই?
- হ্যাঁ।
পরদিন থেকে শান্ত ভাইয়ের সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব হলো। শান্ত ভাই আমাকে কাঁধে চড়িয়ে সারা উঠোন উড়োজাহাজ উড়োজাহাজ খেলল। বিকেলে দিতি-দিনার সঙ্গে পা মিলিয়ে এক্কা-দোক্কাও খেলল। তারপর আমাকে নিয়ে ঘাটে গিয়ে পা ধুয়ে দিল, নিজেও ধু’লো। এরপর লাভলি আপা যখন আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিলেন তখন শান্ত ভাই এসে টিপ পড়িয়ে দিল আর চুল আঁচড়ে দিল।
শান্ত ভাই বলল—বৌ হবি?
- হ্যাঁ।
- আমার বৌ?
- হ্যাঁ।
- আচ্ছা বড় হয়ে নে, তারপর লাল শাড়ি পরিয়ে নিয়ে যাব তোকে।
- আচ্ছা।
কাকীমা আর লাভলী আপা হেসে গড়াগড়ি গেলেন আমার উত্তর শুনে। এরপর থেকে নিহার কাকা কাজ শেষে বাড়ি ফিরেই উঠোনের ওই প্রান্ত থেকে ডাক দিতেন বৌমা আছে বাড়িতে! আমি ফড়িংয়ের মতো এক ঝটকায় নিহার কাকার কোলে চড়তাম।
শান্ত ভাই অনেকদিন ছিল সেখানে। পুরো সামার ভ্যাকেশন কাটিয়েছে তার খালার বাড়িতে। তুতুল বুবুর সাথে তার একটা ভাব হতে পারত যদি বুবু লজ্জা পেয়ে ছোটাছুটি না করত। এদিকে দিতি-দিনা দু’বোনের সাজগোজ বাড়তে লাগল দিনে দিনে।
একদিন ভোরে মা ঘুম থেকে ডাকল—পুতুল, শান্ত চলে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে আছে। ডাকছে তোমাকে।
আমি অাধখোলা চোখ নিয়ে বারান্দা গলিয়ে সিঁড়িতে এলাম। শান্ত ভাইয়ের কাঁধে ব্যাগ। বিপুল ভাই বাইকে স্টার্ট দিচ্ছেন। নিহার কাকারা সবাই বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। শান্ত ভাই বললেন—বৌ, চলে যাচ্ছি ঢাকায়।
- কেন?
- স্কুল খুলে গেছে যে।
- আর আসবে না?
- আসব। আবার ছুটি হলে। তুই আমাকে দেখতে যাবি না?
- না যাব না। তুমিও যেও না ঢাকা।
শান্ত ভাই আমাকে এক হাতে কোলে নিলেন। তার কাঁধের ওপাশ থেকে দিতি আর দিনা আপার কাঁদকাঁদ চোখ দেখলাম আমি। আমারও মন খারাপ। শান্ত ভাই মাকে বললেন—খালা, ওকে বড় রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যাই? বিপুল ভাই আবার দিয়ে যাবে।
মা বললেন—এত সকালে নিয়ে যাবে?
বিপুল ভাই বললেন—খালা আমি শান্তকে বাস ধরিয়েই বাসায় আসব। পুতুলকে দিয়ে যাব।
মা—আচ্ছা। যাও। তাড়াতাড়ি দিয়ে যেও।
বিপুল ভাই বাইক চালাচ্ছেন। তারপর বসেছি আমি। আর আমার পেছনে শান্ত ভাই।
পেছন থেকে আমার গাল টেনে সে বলল—বরকে একাই পাঠিয়ে দিচ্ছিস ঢাকায়? আমাকে রান্না করে দেবে কে?
- জানি না।
- তোর জন্য কি নিয়ে আসব?
- জানি না।
- লাল শাড়ি?
- আচ্ছা।
- তাহলে পরেরবার আমার সাথে ঢাকা যাবি। কেমন?
- আচ্ছা।
বিপুল ভাই খুব হাসলেন আমাদের কথপোকথনে। বড় রাস্তায় নেমে শান্ত ভাই আমাকে আর ধরল না। বিপুল ভাইকে একবার জড়িয়ে ধরে রাস্তার ওপার চলে গেল। আমার দিকে তাকাল না পর্যন্ত। একটা বাস এলে উঠে পড়ল সে। বাসটা চলে গেল। শান্ত ভাই চলেই গেল।
তার প্রায় আটমাস পর আমাদের বাড়িতেও গোছগাছ চলছে। উঠোনের ওপারের রাস্তায় দুটো ট্রাক দাঁড়িয়ে। বাড়ির সমস্ত আসবাব আর জিনিসপত্র তোলা হচ্ছে ট্রাকে। ঢাকা যাচ্ছি সবাই। পাকাপোক্তভাবে। মালপত্র আজই যাবে। আমরা যাব কাল। সারাদিন কাকীমা মাকে সঙ্গ দিলেন। দিতি-দিনা আর লাভলী আপা আমাদের কাছে বসে রইল সারাক্ষণ।
ঢাকায় আমাদের বাড়িটা একতলা। বাড়ির কাজ তখনও শেষ হয়নি। উঠোনটা মাটির ছিলো। পাকা করা হচ্ছে। দরজায় বসে সারাক্ষণ দেখতে লাগলাম মিস্ত্রিদের কাজ। তুতুল বুবু ক্যাসেট প্লেয়ারে সোলসের ‘আজ দিন কাটুক গানের’ এপিঠ-ওপিঠ দিনরাত ধরে বাজাতে লাগল। আমার অার কিছুই করার নেই।
এ বাড়ির দরজা জানালাগুলোও সাম্পান ভিলার মতো সবুজ রঙের। প্রথম প্রথম রাতে ঘুম হতো না। সারাক্ষণই কী করি কী করি মনে হতে লাগল আমার। উঠোনের একপাশে একটা শিউলি গাছ ছিল। ভোরবেলা পুরো উঠোন সাদা হয়ে থাকত ফুলে। মিতুল আর তুতুল বুবু পাল্লা দিয়ে শিউলি ফুলের মালা গাঁথত। যে যত বড় মালা বানাতে পারে!
একদিন বিকেলে বাবার খাটে ঘুমিয়ে আছি। অনেক কথাবার্তার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দেখি মা, বাবা আর মিতুল বুবু স্বজোরে কথা বলছেন। হাসাহাসির শব্দ। সামনের চেয়ারে কে যেন বসে আছে। কাঁধের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। এক হাতে ভর দিয়ে উঠে দেখি শান্ত ভাই!
লাইটের আলোতে তার চুলগুলো চকচক করছে। কথা বলতে বলতে বিড়াল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল—সোনাপুতুল!
আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম।
- এদিকে আয়।
আমি কাছে গেলাম। অামার ঝুঁটি ধরে শান্ত ভাই বলল—চলেই এলি একেবারে? এবার দিঘিপার গেলে আমি কার সঙ্গে খেলব?
- তুমি এখানে এসে খেলবে আমার সাথে।
- না আসব না। তোর আর আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে বৌ।
- কে বলেছে? যাও!
- তোর জন্য একটা জিনিস আছে।
- কী?
সোনালী রঙের একটা প্যাকেট আমার হাতে দিল শান্ত ভাই।
হাতে নিয়েই বললাম—খুলি?
- খুলবিই তো!
ছটফটিয়ে প্যাকেটটা খুলতে গিয়ে ছিঁড়েই ফেললাম। ছেঁড়া প্যাকেট থেকে বেরিয়ে এলো টুকটুকে লাল ছোট্ট একটা শাড়ি।
সেই শাড়িটা ছিল বহুদিন অব্দি। বহুদিন...। কিন্তু ওইবারই ছিল শান্ত ভাইয়ের সাথে শেষ দেখা। হয়তো বা আজীবনের জন্যও শেষ। সাম্পান ভিলা থেকে অামরা চলে আসার বছর তিনেক পর নিহার কাকারাও দিঘিপারের বাড়ি ছেড়েছেন। ওনারাও ঢাকায় থাকেন এখন। একবার নিহার কাকা এসেছিলেনও অামাদের বাড়ি। কিন্তু যোগাযোগটা মিলেমিশে একাকার ওঠেনি দিঘিপার থাকার সময়ের মতো। মাঝখানে পেরিয়ে গেছে ১২বছর। এতটা সময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল সাম্পান ভিলা, নিহার কাকা আর শান্ত ভাইয়ের সঙ্গে।
মাঝে মাঝে নিজে নিজেই ভাবি—সাম্পান ভিলা কি বদলে গেছে, না আছে ঠিক আগের মতোই। বিশাল উঠোনটা যা পাড়ি দিতে খুব দৌড়াতে হতো সেটা কি একমুঠো সমান ছোট্ট হয়ে গেছে? হয়তো বাঁশঝাড়টা নেই। ডোবা বলতে হয়তো গভীর গর্তটাই আছে। জলহীন গর্তটায় না জানি জন্মেছে কত অজানা উদ্ভিদ। নিহার কাকার আধপাকা চুলগুলো নিশ্চয়ই রূপালী হয়ে গেছে। শান্ত ভাই, সে কেমন আছে। বৌকে হয়তো তার আর মনেই নেই। এসব ভেবে কখনো গায়ে কাঁটা দেয়। খড়খড়ে দেহী গুঁইসাপ দেখলে গায়ে কাঁটা দিত যেমন। স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে পাই না আশ্রয় করার মতো কোনো বিড়াল চোখ।
অবুঝ স্মৃতি ধূসর হয়ে গেলেও অনুভূতি এত স্পষ্ট হয় কেন...?
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৬