অন্তরীক্ষপথে
১.
নিজেকে দেখার পর আরও কি মলিন ছিল কিছু! চিরঠাঁই তুমি এই পথ ধরে কখন গিয়েছ চলে তারপর, অর্ধক্ষমাহীন কোনো ধুলোভেজা দিঘিদের সাথে হয়ে ওঠে ক্ষিণ শ্বাস।
মাঝে মাঝে নীরবতা ভালো দীর্ঘ বন্ধনের পাশে— মানুষ দুঃখের শেষে মেহেদি পাখির কথা বলে।
বিগত মুখের চেয়ে কোথাও শরীর নেই আর ওপারে সোনার ঘ্রাণ অলিভের গাছ বেয়ে একা—
২.
সাপের চলার পাশে এইসব নীরবতা ভালো। যেটুকু পথের মায়া কোনোদিন রূপছায়া হয়ে ঈষৎ মহুয়াময়। যদি অলক্ষের কারুছাপ তোমাকে ফেরায় দেহে; অন্ধের শরৎ কি শেষ হবে ভূমিকায়! যেদিকে ধরমপুর একা, শব্দহীন অশ্রুভার ফিরে আসে মাটির বিরহে।
এই শীষ বধির ছিল যেখানে একাগ্র ঘেমে ওঠে তারা; যেন দুঃখের সমাপন: বহুদূর অন্ধকার। কিছুটা নোঙর তবু ফেলে যাই সহদুপুরের ছায়ায়। কোথাও মরা পাতা ভুলে গেছে বিমানের রঙ।
শ্রেষ্ঠাংশের ভূমিকায় হায় জননীর ঘুম, সহস্র ঊর্দ্ধের থেকে প্রতিদিন নেমে আসে পশুদের ডাক— ক্রমশ পাখির কাছে এই গান: চিরদূর হাওয়া।
৩.
এদিকে তেমন কেউ আসে না। একটি লিচুগাছ পাতার মর্মরে একা। দূরে গন্ধরাজ ঘিরে কয়েকটা শিশু ধীরে ধীরে মা খেলছে। দৈবাৎ প্রশ্ন করি— শূন্যতায় ভাসমান যে দেয়াল, কীভাবে ঢেকে রাখে গান!
উড্ডীন পাতার শব্দে দুঃখ ও সন্তাপ বাজে। কে কবে প্রথম হেঁটেছিল এই পথে! কার পাশে প্রথম মালতি ঝরে বহন করে নীরবতা! ওপারে বাউলের দেশ—
গান থেমে গেলে অন্তরীক্ষপথে কেঁপে ওঠে দূরবাঁশিঢেউ। অশ্রুর কুন্তল ঘিরে কেউ একজন বলে যায় ‘প্রদীপ নিভুক তবে! ঊর্ধ্বের অমিয় দেশে যারা চলে গেছে চিরপথ হয়ে অজ্ঞাত সর্বের শেষে একাকী ধুলির দক্ষিণায়’।
৪.
যে তার মর্মে লীন হয়ে একা নিভৃতে কাঁপে ঠিক কতটুকু পাওয়া হলো সেসব! এই যে পথ— চিরপথ, সে-ও তো কেবল দু’-একবার উঁকি দিয়ে গেলো। না হলো তার গানের নিস্তব্ধতাটুকু শোনা না হলো ছায়ার বাইরে এসে সেই অন্তরজনের পাশে দাঁড়ানো!
যদি কোনো দিন মৃদু কোনো কামরাঙা ফুলের সাথে দেখা হয় অন্তত বলা যেতো— এই আমার হিংসাপত্রের লিপি। একে আরেক বার জাগাও হে মহা ফুল, যেখানে মা তেলের কাছে জমা দেন তার সমস্ত দুপুর—
৫.
জানালার কাছে রোজ একটা বন্ধন আসে। পাতা ঝরে গেলে যেমন গাছেরা নিঃশব্দে কথা বলে নাবিকের সাথে। অরূপ স্তব্ধতা নতুন পাখির গান। কেননা মানুষ, শব্দ পেরোবে বলে ফুলেরও শত্রু হয়। সে-ই স্পর্শ করে ধ্যান— যে অনাথ আদ্যপান্ত ডুবে গেছে দুধকুশি-তারাদের সাথে—
—গাছ আদতে কিছু নয় বড় জোর বুধ কী বৃহস্পতিবার!
চিরদূর আবছায়া হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে সুরে। তবু অন্তর্গত মর্মর ভেসে আছে হাওয়ায়। যারা চলে গেছে মনোহেম ধরে; সেই সব অশ্বের ধ্বনি অন্তরীক্ষপথ—
৬.
এই যে থাকা অথবা না থাকা স্তব্ধতার মাঝে কোনো ঠাট্টাই নেই যেন!
অনেক উড্ডীন ঘিরে কত রণ-ঝিলমিল পাতা। বরং দু’দিক থেকে একান্ত নদীপার, গর্ভ-কঠিন এই ধানখেত। এসব ঠেলে ঠুলে যাওয়া যাবে জ্যোতিষীর কাছে; তখনো হাত ভীষণ তামাশা প্রিয়।
প্রবণতা এইটুকু, আমাকেও যেতে হয় ফল টিপে টিপে মানুষ যেভাবে গেছে বন্ধনের মতো একা।
৭.
যেন কোনোদিন যাওয়া হবে না ব্রিজের ওপার! মীন থেকে মীনে তারও অধিক সমুদ্র লেগে আছে হিংসায়—
মৃতরা অদ্ভুত উঁচু— ক্ষণিক বাবলা গাছ মনে হয় ক্রন্দসী ধুলোয়!
নিজের ভেতরে ঢুকে শুধু বন্ধন শুধু নীরব ঊর্ধ্বলোক— যতটা স্তব্ধতা লেবুগাছটির। দেখার সহস্র পরে যে হাওয়া বয়ে যায় খরময়ূরের ডানা যেন একটি বার নত হই সেই উড্ডীনে, আমর্ম তারায়।
৮.
সহজ বিষের থেকে কিছুকাল শ্বেতপাথরের কথা বলে আধো তারাদের সাথে শব্দময় এ নিক্ষেপ— ভাবি, অচেনার শূন্যস্থানে কে এসে দাঁড়াবে! ধুলোর জীবাশ্ম ঘিরে বহুদিন ফেলে আসি ছায়া। জলের গভীরে দু’টো মাছ একা একা কথা বলে আবার উত্তর দেয় তারাই ! অমৃতের অশ্রুসভায় কেন কাঁপে পশমের অনধিক স্মৃতি!’
—একদিন মরে যাওয়া শ্রেয় মৃত বন্ধুদের সাথে!
যাবার জায়গা থেকে যিনি একা— একান্ত গমন ভেবে দাঁড়িয়ে থাকেন ইশারায়, সেই জন ভুল হয় শরীর বলে— একটি প্রাচীন শুধু পথশেষ-সহোদর !
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৬
এসএনএস