শিরোনামের প্রথম অংশটি আশি পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থের নাম। লিখেছেন, এই সময়ের আরেক সাংবাদিক হাসান শান্তনু।
পাঠশেষে আরও তিনটি শব্দ সামনে ভেসে উঠবে, ‘সাংবাদিকতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু’। যাকে বলে, ‘লেখকের যেখানে শেষ, পাঠকের সেখানে শুরু’।
বলা যায়, এই পাঁচটি শব্দের (‘সাংবাদিক বঙ্গবন্ধু’ ও ‘সাংবাদিকতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু’) সামষ্টিক রূপরেখা এ গ্রন্থ। এর চিত্রায়ন তিনি করেছেন পাঁচটি অধ্যায়ের মাধ্যমে।
শুরুর প্রশ্নে ফিরে যাওয়া যাক। গ্রন্থে প্রশ্নটির উত্তর লেখক দিয়েছেন তিনটি জায়গায়। প্রথম অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব রাজনীতির মঞ্চে দৃপ্ত কণ্ঠে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বক্তব্য দেন, পাকিস্তানি শাসকদের সাংবাদিক ও গণমাধ্যম নির্যাতনের ঘটনার কঠোর প্রতিবাদ জানান, আবার মঞ্চ থেকে ফিরে পত্রিকার কার্যালয়ে বসে লেখালেখিও করেন’। (পৃষ্ঠা: ০৯)
একই অধ্যায়ে ‘সাপ্তাহিক নতুন দিন’র আলোচনাসূত্রে লেখক লেখেন, ‘পত্রিকাটিতে শেখ মুজিব নিজেও সাংবাদিকতা করেন বলে তথ্য পাওয়া যায়’। (পৃষ্ঠা: ১৭)
তৃতীয়টির পটভূমি লাহোর। তৎকালীন মুসলীম লীগের সভাপতি খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে বৈঠকের পর ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে ১৯৫২ সালে পাঠানো চিঠির একটি লাইন ছিলো, ‘রিপোর্ট পাঠাইলাম’। (পৃষ্ঠা: ২১)
লেখক লিখেছেন, ‘ওই চিঠি পড়ে কোনো কোনো বঙ্গবন্ধু গবেষক বলেন, প্রতিবেদনটি হয়তো সাংবাদিক বঙ্গবন্ধু নিজেই সাজিয়েছিলেন ইত্তেফাকের জন্য’। (পৃষ্ঠা: ২০-২১)
এ গ্রন্থে সাংবাদিক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ড এভাবেই চিত্রিত হয়েছে। এটি ঠিক, আক্ষরিক অর্থে ‘সাংবাদিক’ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে পুরোপুরি পাওয়া যাবে না, ভাবার্থে মিলবে। তবে সেটির দৃশ্যমান পূর্ণপ্রকাশ ঘটে, ‘সাংবাদিকতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু’ শব্দত্রয়ীতে। সেটির ব্যপ্তি আরও বিশাল।
সেই বিশালতার ধারণা খানিকটা লেখক দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সাংবাদিক আবেদ খানের একটির লেখাংশ হাজির করে, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এটা বিশ্বাস করতেন যে, সংবাদপত্রকে ঠিকমতো পরিচর্যা করলে তা এক বিশাল সংগঠকের ভূমিকা পালন করতে পারে। তুখোড় সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী শেখ মুজিব সেই যুব সমাজের অন্যতম নেতা হিসেবে সুস্পষ্টভাবে অনুভব করেছিলেন যে, রাজনৈতিক দর্শনকে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে হলে সাংবাদমাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই’। (পৃষ্ঠা: ৪০)
আবেদ খান যথার্থই লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুর এই ‘সাংবাদিকতার দর্শন’কে তথ্য-উপাত্ত-ইতিহাস-নথিসমেত তুলে ধরেছেন লেখক। বলা ভালো, ছড়ানো ফুলগুলোকে সাজিয়ে মালা গেঁথেছেন। অধ্যায়গুলোর নামকরণও সেদিক দিয়ে স্বার্থক।
প্রথমটিই যেমন, ‘নতুন দিনের সাংবাদিক শেখ মুজিব’। ‘নতুন দিন’ এখানে সাপ্তাহিক পত্রিকা। মেটাফোরিক্যালিও তিনি তখন বাংলার রাজনীতিতে তিনি নতুন দিনের সাংবাদিক। ‘তখনকার দৈনিক, সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটতো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, আদর্শ বা দর্শনের ভিত্তিতে’। সে ধারাবাহিকতায় পশ্চিম পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক নীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সংবাদমাধ্যমগুলোর বিপরীতে প্রকাশিত হয় নতুন দিন (১৪ এপ্রিল, ১৯৫৬)। বঙ্গবন্ধু এর মূল মালিক ছিলেন। ১৯৫৮ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়।
তৃতীয় অধ্যায়ে দেখিয়েছেন, ‘রাষ্ট্রপিতা মুজিব মিল্লাত পত্রিকার বিক্রেতা!’ চতুর্থ অধ্যায় ‘ইত্তেফাক ও বঙ্গবন্ধু’তে যেনো পরিপূর্ণরূপে দেখা দিলেন জাতির পিতা। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের মুখপত্র সাপ্তাহিক ইত্তেফাক মওলানা ভাসানীর হাতঘুরে ১৯৫৩ সালে দৈনিক হয়ে মানিক মিয়ার হাতে আসার পর থেকে সেটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে বঙ্গবন্ধুর যে ভূমিকা, তাতে তার ‘সাংবাদিকতার দর্শন’ আরও গাঢ়ভাবে ফুটে ওঠে। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন সেইসব আত্মত্যাগ আর প্রচেষ্টার কথা। লেখকও গ্রন্থের ৫০-৫১ পৃষ্ঠায় হাজির করেছেন সেই অংশ। কোন পরিস্থিতিতে নিরুপায় মানিক মিয়াকে করাচি যাওয়া থেকে আটকালেন, কীভাবে টাকা-অফিস-কর্মী জোগাড় হলো, কীভাবে সবাই মিলে একে জনপ্রিয় করে তুললেন- সবই লিখেছেন তিনি।
পঞ্চম তথা শেষ অধ্যায় ‘বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায় সাহিত্য পত্রিকা স্বদেশ পত্রিকার সেসময়কার কার্যক্রম সম্পর্কে আরেকটু আলোচনা থাকলে ভালো হতো। তবে এটি অবশ্যই গ্রন্থের ‘ত্রুটি’ হিসেবে চিহ্নিত হয় না।
এভাবেই বঙ্গবন্ধু নিপীড়িত-শোষিতদের অধিকার আদায়, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জন বা সবশেষে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নানাভাবে পত্রিকা প্রকাশ ও সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কখনও মালিক, কখনও সাংবাদিক, কখনও পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি, কখনও পরিবেশক, কখনও উৎসাহদাতা, সাহসের বাতিঘর, উদ্যোক্তা, প্রেরণা, আদর্শ ও অভিভাবক ছিলেন তিনি। তার জীবনের বর্ণাঢ্য এসব দিক অনেক পাঠকের কাছে অনাবিষ্কৃত ছিলো, লেখক দক্ষতার সঙ্গে সেই আকরগুলো তুলে এনেছেন।
ঝরঝরে গদ্যের সুপাঠ্য এ গ্রন্থটির একটি ভালো দিক হলো, এটি তথ্যনির্ভর ও গবেষণালব্ধ গ্রন্থ হওয়া সত্ত্বেও তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত নয়। যেটি এ জাতীয় অধিকাংশ বইয়ের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। কখনও লেখকের বয়ান, কখনও গুণীজনের বক্তব্য পড়তে পড়তে হাজির হচ্ছে জাতির পিতার কথা। মনে হবে, তিনি নিজেই যেনো উপস্থিত থেকে বলছেন। লেখকের ‘তথ্য’ ব্যবহারের পরিমিতিবোধ প্রশংসনীয়। কখন ইতিহাস কথা বলবে, কখন গুণীজন, মাঝখানে রেফারেন্স, এর সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক জুড়ে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী এবং সেটির সঙ্গে লেখকের বয়ানের যে সুসমন্বয়, সেটিও আলাদা করে প্রশসংসার দাবি রাখে। বঙ্গবন্ধুর সাংবাদিকতার দিকটিই শুধু নয়, সেসময়কার গণমাধ্যম, তার ভূমিকা ও পথচলা জানতেও গ্রন্থটি প্রয়োজনীয়। একঝলকে সেই সময় ও এর বাস্তবতা তুলে ধরে সুনিপুণভাবে।
আলোচনার প্রসঙ্গ ধরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখক কয়েকটি প্রস্তাবও রেখেছেন। এর মধ্যে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (যেমনটি বিভিন্ন দেশে তাদের নেতাদের নিয়ে রয়েছে) এবং তার উপর লিখিত বইপত্রগুলো ইংরেজিসহ প্রভাবশালী ভাষায় অনূদিত করার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর উল্লিখিত দিকগুলো এখনও অনালোচিত থেকে গেছে বলে লেখক আক্ষেপও করেছেন। এ গ্রন্থ এর অনেকটা মেটাবে, সেটিই যেমন লেখকের প্রচেষ্টা-লক্ষ্য; তেমনি এ গ্রন্থপাঠের অভিজ্ঞতাও তাই বলে।
২০১৬ একুশে বইমেলায় ‘প্রকৃতি’ প্রকাশনী প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এর দাম ১৯৫ টাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৬
এসএনএস