মার্কিন সাহিত্যের জনক বলে আখ্যায়িত মার্ক টোয়াইন সম্পর্কে আরেক বিখ্যাত লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেন, সব আধুনিক আমেরিকান সাহিত্য এসেছে মার্ক টোয়াইনের জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম ‘হাকলবেরি ফিন’ থেকে। অনেকেই মনে করেন, ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন’ মার্ক টোয়াইনের সবচেয়ে সেরা কাজ।
১৯১০ সালের ২১ এপ্রিল বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত এ লেখক ইহলোক ত্যাগ করেন। মার্ক টোয়াইন নিজেও যেমন রম্য লেখক ছিলেন, তেমনি তার ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলো বেশকিছু মজার ও অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপার। প্রয়াণদিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে তার জীবনের ছয়টি অজানা ও মজার ঘটনা নিয়ে থাকছে বাংলানিউজের বিশেষ আয়োজন।
মার্ক টোয়াইন ছিলেন প্রি-ম্যাচিইউর বেবি
মার্কের জন্ম ১৮৩৫ সালের ৩০ নভেম্বর মিসৌরির ফ্লোরিডায়। প্রি-ম্যাচিউর বেবি হিসেবে নির্ধারিত সময়ের দু’মাস আগেই জন্ম নেন তিনি। সাত বছর বয়স পর্যন্ত তিনি ছিলেন অসুস্থ ও ভগ্নস্বাস্থ্যের অধিকারী। বাবা-মায়ের সাত সন্তানের মধ্যে মার্ক ছিলেন ষষ্ঠতম। সাত ভাই-বোনের মধ্য থেকে শৈশব অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন মাত্র তিনজন। জন্মের পর মার্কের নাম রাখা হয় স্যামুয়েল ল্যাঙহর্ন ক্লিমেন্স। পরে লেখালেখিতে অনুপ্রবেশের পর তিনি ছদ্মনাম হিসেবে ‘মার্ক টোয়াইন’ ব্যবহার করতে শুরু করেন। মার্কের বাবা জন মার্শাল ক্লিমেন্স ছিলেন একজন অ্যাটর্নি ও বিচারক। মার্কের বয়স যখন চার, তখন তার বাবা সপরিবারে মিসৌরির হ্যানিবালে চলে আসেন। মিসৌরি নদীর তীরবর্তী ছোট্ট বন্দর নগরী হ্যানিবাল। এ শহরের আদলেই মার্ক তার দুই বিখ্যাত অভিযান গল্প ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন’ ও ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব টম সয়্যারের’ কাল্পনিক শহর সৃষ্টি করেছেন।
মার্ক টোয়াইনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো সীমিত
১৮৪৮ সালে স্যামুয়েল ক্লিমেন্স ওরফে টোয়াইনের বাবা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ফলে মাত্র ১১ বছর বয়সেই তাকে হ্যানিবালের এক খবরের কাগজের অফিসে ফুল টাইম শিক্ষানবিস প্রিন্টার হিসেবে কাজে যোগ দিতে হয়। পরে ১৮৫১ সালে একটি স্থানীয় খবরের কাগজে টাইপিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। এ খবরের কাগজের মালিক ছিলেন তার বড়ো ভাই ওরিয়ন। মূলত এখানে কাজ করার সময় থেকেই মার্ক লেখালেখি শুরু করেন ও বেশ কিছু রম্যগল্প প্রকাশ করেন। ১৮৫৩ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে মার্ক হ্যানিবাল ছেড়ে চলে যান। এরপর বেশকিছু বছর তিনি নিউইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, সেন্ট লুইস, ওহিও, লোয়া ইত্যাদি শহরে প্রিন্টার হিসেবে কাজ করেন।
নাবিক হিসেবে মার্কের ক্যারিয়ার শেষ হয় ট্র্যাজেডি দিয়ে
১৮৫৭ সালে মার্ক মিসিসিপি নদীতে স্টিমবোটের শিক্ষানবিস নাবিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেসময় নাবিকের চাকরি ছিলো বেশ সম্মানজনক। তাই মার্ক তার ছোটভাই হেনরিকেও স্টিমবোটের চাকরিতে যোগ দিতে উৎসাহিত করেন। ভাইয়ের কথা শুনে হেনরি ‘দ্য পেনসিলভানিয়া’ নামে এক স্টিমবোটে চাকরি নেন। ১৮৫৮ সালের ১৩ জুন দ্য পেনসিলভানিয়ার বয়লার বিস্ফোরণ হয়ে বিশাল এক দুর্ঘটনা ঘটে। ১৯ বছর বয়সী হেনরি এ দুর্ঘটনায় নিহত হন। ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর জন্য সবসময় নিজেকেই দায়ী মনে হতো মার্কের। কিন্তু তারপরও তিনি স্টিমবোটে কাজ চালিয়ে যান। ১৮৫৯ সালে স্টিমবোটের নাবিক হিসেবে নিজস্ব লাইসেন্স পাওয়ার পর ১৮৬১ সালে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি নাবিক হিসেবে কাজ করেন। এ চাকরি করার সময়ই তিনি ‘মার্ক টোয়াইন’ ছদ্মনামটি বেছে নেন। মার্ক টোয়াইন মানে হচ্ছে, দুই ফ্যাদম (১২ ফিট) গভীরতার নদীর জন্যে কান্না।
মার্ক হাকলবেরি ফিন চরিত্রটি বাস্তব
মার্ক টোয়াইনের ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন’র হাকলবেরি ফিন চরিত্রটির ভিত্তি একজন সত্যিকার মানুষ। হাকলবেরি ফিন এমন এক ব্যক্তি যিনি তার আশেপাশের পরিবেশের সঙ্গে কিছুতেই খাপ খাইয়ে নিতে পারেন না। অবশেষে মুক্ত জীবনের সন্ধানে ফিন তার কৃতদাস জিমকে সঙ্গে করে ভেলায় চড়ে মিসিসিপি নদীতে এক দুঃসাহসিক অভিযানে বের হন। ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব টম সয়্যার’ উপন্যাসে মার্ক ‘হাকলবেরি ফিন’ চরিত্রটি প্রথম প্রকাশ করেন। টম ব্ল্যাংকেনশিপ নামে একজন সত্যিকার মানুষের চরিত্র অবলম্বনে হাকলবেরি ফিন চরিত্রটির সৃষ্টি। টম ব্ল্যাংকেনশিপ থাকতেন হ্যানিবালে। তিনি বয়সে টোয়াইনের চেয়ে বছর চারেকের বড় ছিলেন। ব্ল্যাংকেনশিপ ছিলেন এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার দিনমজুর বাবা মাতলামির জন্যে শহরজুড়ে বাজেভাবে পরিচিত ছিলেন। টোয়াইন তার আত্মজীবনীতে বলেছেন, হাকলবেরি ফিনের মধ্যে আমি হুবহু এঁকেছি টম ব্ল্যাংকেনশিপকে। ব্ল্যাংকেনশিপ যেমন অজ্ঞ, অপরিচ্ছন্ন ও আধপেটা ছিলেন, ঠিক তেমনি হাকলবেরি চরিত্রটিও। কিন্তু তার মতো অসাধারণ ভালো হৃদয় আর অন্যকোনো ছেলের ছিলো না। পরবর্তীতে টম ব্ল্যাংকেনশিপের জীবনে কী ঘটে তা আর নিশ্চিত করে জানা যায়নি। তবে প্রকাশের পরপরই ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন’ তুলেছিলো বিতর্কের ঝড়। ১৮৮৫ সালে আমেরিকায় প্রকাশিত হওয়ার এক মাস পরই ম্যাসাচুসেটসের কনকর্ডে এক পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়।
দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন মার্ক টোয়াইন
লেখক হিসেবে সফল হলেও, ব্যবসায়ী হিসেবে ব্যর্থ ছিলেন মার্ক টোয়াইন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি অগাধ ভালোবাসার কারণে নতুন আবিষ্কারে বিনিয়োগ করে অনেক অর্থ খুইয়েছেন এ লেখক। বিশেষ করে অটোমেটিক টাইপ সেটিং মেশিনের পেছনে খরচ করেছেন দুই লাখ ডলারেরও বেশি অর্থ। পরে নিজের প্রকাশনা সংস্থায়ও লোকসানের মুখোমুখি হন তিনি। ১৮৯৪ সালে পাওনাদারদের টাকা দিতে না পেরে বাধ্য হয়ে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন টোয়াইন। পাওনা শোধ করার টাকা যোগাড়ের জন্যে পরের বছর তিনি বিশ্বব্যাপী বক্তৃতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন।
হ্যালির ধুমকেতুর সঙ্গে জন্ম, হ্যালির ধুমকেতুর সঙ্গেই মৃত্যু
পৃথিবীর আকাশে হ্যালির ধুমকেতু দেখা দেওয়ার কিছুদিন পরই মার্ক টোয়াইনের জন্ম হয়। তিনি মনে করতেন, হ্যালির ধুমকেতুর সঙ্গেই তার মৃত্যু হবে। ১৯০৯ সালে টোয়াইন মন্তব্য করেন, ১৮৩৫ সালে হ্যালির ধূমকেতুর সঙ্গে আমি পৃথিবীতে এসেছিলাম। আগামী বছর এটি আবার আসছে, আমি আশা করি এর সঙ্গেই আমি আবার চলে যাবো। হ্যালির ধূমকেতুর সঙ্গেই যদি আমার প্রস্থান না ঘটে তাহলে এটি হবে আমার জীবনের সবচে বড় হতাশাপূর্ণ ঘটনা। কোনো সন্দেহ নেই স্রষ্টা বলেছিলেন, ‘এই হলো দুই দায়িত্বজ্ঞানহীন উন্মাদ, এরা এসেছিলো একসঙ্গে, এদের যেতেও হবে একসঙ্গে’। তার সেই ভবিষ্যতবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিলো। ১৯১০ সালের ২১ এপ্রিল মার্ক টোয়াইন না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। দিনটি ছিলো হ্যালির ধূমকেতু পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থান করার ঠিক পরের দিন। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে পরকালে চলে যান জনপ্রিয় সাহিত্যিক মার্ক টোয়াইন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৬
এসএমএন/এসএনএস