[তাকে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ও নাট্যকার বলা হয়। চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল এ মহাত্মার চারশোতম প্রয়াণ দিবস।
কবি, নাট্যকার শেক্সপিয়ার। বলতে গেলে অতি প্রাচীন কবি, খুব পুরাতন নাট্যকার। আধুনিক যুগ থেকে বহু বছর আগে যখন বিলাতের সিংহাসনে রানি প্রথম এলিজাবেথ, তখন তার জন্ম। যখন প্রথম জেমস রাজা, তিনি পরলোকে পাড়ি জমান।
২৩ এপ্রিল, ১৬১৬। তার মৃত্যুর পর চারশো বছর কেটে গেছে। কতো রাজা, কতো রানি পার করে শেক্সপিয়ারের দেশে এখন আরেক এলিজাবেথ। তারও বয়স হয়েছে, সম্প্রতি পা রাখলেন নব্বইয়ের ঘরে। কিন্তু শেক্সপিয়ার রয়ে গেলেন যুবকের বেশে। শেক্সপিয়ারকে নানাভাবে আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে নিয়তো। একটা কারণ অবশ্য অতি সহজ আর স্বচ্ছ, তিনি একসময়ের ঔপনিবেশিক পরাশক্তির দেশের কবি। তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রচারিত, সুবিধাপুষ্ট ভাষায় লিখেছেন। কিন্তু অন্য কারণও থাকতে পারে তার সময়-বন্ধনহীন জনপ্রিয়তা আর ভূগোল-সীমাহীন গ্রহণযোগ্যতার পেছনে। বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশীয় সাহিত্য-মঞ্চে শেক্সপিয়ার অতি আলোচিত, তার প্রভাবও বেশ জোরালো। অখণ্ড ভারত এককালে ইংরেজদের উপনিবেশ ছিলো, এটা একটা বড় কারণ। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগ, কলেজ-স্কুলের পাঠ্যবই- সমস্ত শেক্সপিয়ারের হয়ে, বুঝে-না বুঝে প্রচার করছে তার জীবন আর কাজের মাহাত্ম্য।
কিন্তু ধরুন, শেক্সপিয়ারের দেশ কোনো বিশাল ঔপনিবেশিক শক্তি কোনোদিন ছিলো না। ধরা যাক, ইংরেজি ভাষা বাংলার মতো একটি নির্দিষ্ট জাতির ভাষা। তাহলে ঠিক কোন কারণে মানুষ শেক্সপিয়ার পড়তে চাইতো? তবু কেন যেকোনো জাতি, সংস্কৃতির, যেকোনো যুগের মানুষ তার লেখা পড়তে পারলে ধন্য হতো, তার নাটক নিয়ে মঞ্চ রাঙাতে চাইতেন নানান কালের নানান দেশের অভিনেতারা?
কারণ, শেক্সপিয়ারের সাহিত্যকর্ম মানুষের সব রস আর সমস্ত ভাবকে স্পর্শ করে। আমরা অ্যারিস্টটলের গ্রিক দর্শন ‘পোয়েটিকস’ সম্পর্কে জানি। নাটক-কবিতার অন্যতম আদিশাস্ত্র হিসেবে দুনিয়াজুড়ে এর কদর। পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলের যেকোনো নাটককে আমরা এই বইয়ের আলোকে বিচার করতে দ্বিধা করি না। নাট্যকার শেক্সপিয়ারও এর বাইরে নন। তার কাজকেও তাই বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন পণ্ডিতরা পোয়েটিকসের আদলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তার কাজও গ্রিক নাটকের আদলে ট্রাজেডি, কমেডিতে ভাগ করে পড়া হয়, পড়ানো হয়। কিন্তু যদি এমন হতো, আমরা গ্রিক নাট্যশাস্ত্র জানি না। কিন্তু আমরা শেক্সপিয়ার পড়ছি। তখন কীসের আলোকে আলোচনা-বিশ্লেষণ হতো?
আলোচনা হতে পারতো (বা এখনও পারে) ভারতীয় ‘নাট্যশাস্ত্র’র চোখ দিয়ে। অনুমান করা হয়, প্রায় পোয়েটিকসের সমান বয়সী ভরতমুনির সংস্কৃত নাট্যশাস্ত্র। দুই হাজারেরও অধিক বছরের প্রবীণ এই গ্রন্থে নাট্যকলার নন্দন, করণ, ধরন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা রয়েছে। বলা হয়েছে নাট্যকলার এমন এক শক্তির কথা যা মানুষকে অতি-অনুভূতির এক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। সেখানে মানুষ নিজেকে, নিজের চারপাশকে পুনরায় আবিষ্কার করে। মানুষের স্থায়ী ভাব আট প্রকারের। একজন সত্যিকারের নাট্যকার তার চরিত্রের সব প্রকার ভাব সম্পর্কে সচেতন। এই ভাবের সঙ্গে পাঠক, শ্রোতা, দর্শকের মনের রসের মিলনে তৈরি হয় শিল্প, সফল হয় নাট্যকলা। নাটক দেখে দর্শকের মনে মূলত নয় প্রকার অপূর্ব অনুভূতি জাগে। ‘নবরস’ হলো পৃথিবীর মানুষের আবেগ-অনুভবের নয় চিরন্তন প্রকাশ- শৃঙ্গার, হাস্য, করুণা, রৌদ্র, ভয়ানক, বীর, বিভৎস, অদ্ভুত ও শান্ত রস।
চাইলেই শেক্সপিয়ারের কাজকে এই নবরসের আলোকে বিভাজন, বিশ্লেষণ বা আলোচনা করা যেতে পারে। কমেডি, ট্র্যাজেডি, ট্র্যাজিক-কমেডি ইত্যাদি ভাগে ভাগ না করে কোন নাটক কোন রসের সঙ্গে সম্পর্কিত, কোন চরিত্র কোন ভাবের বাহক- এইসব মাথায় রেখে আমরা শেক্সপিয়ার পড়তে পারি। নাট্যশাস্ত্রে একেক রসের জন্য একেক হিন্দু দেবতা আর ভিন্ন ভিন্ন রঙ নির্ধারণ করা রয়েছে। শেক্সপিয়ারের নাটক বা চরিত্রকে বিভিন্ন রসের রঙে রঙিন করে ফেলাও সম্ভব।
শৃঙ্গার রসের রঙ লাল। শেক্সপিয়ারের লাল চরিত্রগুলোর মধ্যে ‘মিডসামার নাইটস ড্রিম’র ওবেরন, টাইটানিয়া বা ‘মেজার ফর মেজার’র জুলিয়েট উল্লেখযোগ্য। হাস্য রসের সাদা রঙ। এই রঙের চরিত্র অনেক। যেমন ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’র অড্রে, ফিবি, টাচস্টোন; ‘হেনরি দ্য ফোর্থ’র ফলস্টাফ প্রমুখ। রৌদ্র রসের লেডি ম্যাকবেথ, কিং লিয়ার বা ওথেলো। করুণা রসের পায়রারঙের হ্যামলেট, ওফেলিয়া বা রোমিও-জুলিয়েট। নীল বিভৎস রসে রঙিন ‘ম্যাকবেথ’র তিন ডাকিনী, ‘টেম্পেস্ট’র ক্যালিবান; ভয়ানক রসে ঘনকালো ম্যাকবেথ, ‘ওথেলো’র ইয়াগো। বীর রসের বাদামরঙা বাহক ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকের মার্ক অ্যান্টনি, ‘হেনরি দ্য ফোর্থ’র প্রিন্স হ্যারি। অদ্ভুত রসের হলুদ রঙ পাওয়া যায় শেক্সপিয়ারের অতি-প্রাকৃতিক চরিত্রগুলোতে, যেমন ‘হ্যামলেট’র ভূত, ‘টেম্পেস্ট’র এরিয়েল, ‘মিডসামার নাইটস ড্রিম’র পাক। আবার ‘কিং লিয়ার’র কর্ডেলিয়া, ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’র অ্যান্টোনিওর মধ্যে শুভ্র-স্নিগ্ধ শান্তরসের আভাস পাওয়া যায়।
মানে দাঁড়ায় যে, শেক্সপিয়ারের কাজ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, ভারতীয় দর্শনের নাট্যধারার সমস্ত মৌলিক গুণাবলী ধারণ করে। নাট্যশাস্ত্র যেমন বলে, নাটক মানে ধর্ম। আর নাটকের প্লট তৈরি হয় তিন জগতের ধারায়- সুর, মানব আর অসুর। শেক্সপিয়ার তেমনি গ্রিক এক প্লটের নাটক থেকে বের হয়ে মিডসামার নাইটস ড্রিমে তিনটি প্লট দেখিয়েছেন- একটি কল্পনার রাজ্যের, একটি এথেন্সের শাসক-শ্রেণি আর অন্যটি শ্রমজীবী সম্প্রদায়।
এই যে একজন আজীবন ব্রিটেনবাসী নাট্যকার, কবির লেখা সুদূর ভারতের নবরস তত্ত্বে ব্যাখ্যা করা যায়, তার চরিত্রগুলো যে পৃথিবীর নানা দেশ-বিদেশে বাস করে, দুনিয়ার নানান প্রান্তের নানান মানুষ খুব সহজেই আজও ওথেলোর হিংসা, পোর্শিয়ার বুদ্ধিমত্তা, ম্যাকবেথের ভুল, ভায়োলার রূপবদল, প্রসপারোর জাদু, হ্যামলেটের দ্বিধা ইত্যাদি এতো সহজে আপন করে বুঝতে পারে- এইখানেই শেক্সপিয়ারের মাহাত্ম্য।
হয়তো এতো লোক তাকে চিনতো না, জানতো না যদি ইংরেজ আর ইংরেজির এতো বিস্তার দুনিয়াজুড়ে না থাকতো। প্রচার যতো কমই হোক, মহান মহানই থাকেন। শেক্সপিয়ার ইংরেজ না হলে ক্ষতি হতো ইংরেজি ভাষার। শেক্সপিয়ার শেক্সপিয়ারই থাকতেন।
বাংলাদেশ সময়: ১০০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৬
এসএনএস