ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ভ্রমণামৃত-১

চিকেন চাইতেই এলো সিগারেট!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪২ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৬
চিকেন চাইতেই এলো সিগারেট! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চীনা নারীটি আশ্চর্য মুন্সিয়ানায় সবুজ শাক-সবজি আর কিছু স্থানীয় খাদ্য উপকরণ জ্বলন্ত উনুনের স্টকে ছুঁড়ে দিয়ে আমাদের দিকে মুচকি হাসি দিতেই চোখ চকচক করে উঠলো। সফরসঙ্গী পরিবারের বাকি দুই সদস্য জলি ফেরদৌসী আর কিশোরপুত্র ধন তুসু মাহমুদ ফিরিয়ে নিলো মুখ।

আপাত বিতর্ক, রাস্তার ধারের রেস্তোরাঁর এসব চীনা স্থানীয় ছাইপাস তারা খাবে না। বললাম, ভাষা না বোঝার এই দেশে কোথায় পাবো ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি? ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। সামনে কলমি, ক্যাপসিক্যাম, ব্রোকলি আর কয়েক জাতের নাম না জানা সবজির স্যুপ জাতীয় কিছু একটা তৈরি হতে দেখে আর তর সইছে না। আমি সবজিভুক বাঙালি। অপরিচিত খাবারে আমার রা নেই।

এই খাবারকাণ্ডটি গতরাতের। সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সে গুয়াংঝু পৌঁছে অনায়াসে পৌঁছা গেলো নির্ধারিত হুয়াদু ডিস্ট্রিক্টের তারকা হোটেল সেঞ্চুরিতে। পঁচিশ তলার ঢাউস কক্ষে হাতবোচকা ফেলে সবাই ক্লান্ত। হাতমুখ ধুয়ে বের হয়েছি রাতের খাবারের খোঁজে। হোটেলে বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁ থাকলেও আমার টার্গেট স্থানীয় খাবার। হোটেল থেকে বের হয়ে পাশের শিকুয়ান সড়ক ধরেই হাঁটছি তিনজন।

ভাগ্য ভালো এ সড়কের দু’পাশের দোকানগুলোর নব্বুইভাগই রেস্তোরাঁ। আমাদের দেশের শপিংমলের ফুডকোর্টের মতো। রেস্তোরাঁগুলো স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী। বুটিক স্টাইলে তা চালাচ্ছেন চীনা নারীরা। কারও কারও সঙ্গে স্বামীও রেস্তোরাঁর ক্যাশ সামলাচ্ছেন। রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ড, মেন্যু সব চীনা ভাষায়। এরা ইংরেজির ধার ধারে না বলেই মনে হলো। প্রতিটি রেস্তোরাঁয় লোকজনের ভিড় আছে বেশ। এদের রন্ধনপ্রণালীও আলাদা। মনে হলো, এরা একেক খাবারের জন্য বিখ্যাত।

হালাল চিকেন আর ভেজিটেবলের ব্যবহার হয় এমন রেস্তোরাঁ খুজছিলাম। এই খোঁজাখুজির মধ্যেই রাস্তার পাশে আবিষ্কার করেছি আলোচ্য রেস্তোরাঁটি। চীনা স্বামীসহ মধ্যবয়স্কা নারীর চিফশেফ কাম হোটেল বেয়ারা। স্বামী বসে বসে কাগজের মধ্যে চপস্টিক ঢুকিয়ে টেবিলে টেবিলে রাখছেন। স্বল্পবসনা নারীর মুচকি হাসি খদ্দেরদের বাড়তি পাওনা। এদের উপকরণও সবুজময় ও তরতাজা।

টেবিলে থরে থরে সাজানো ব্রোকলি, ধনেপাতা, কলমিশাক ও অন্যান্য স্থানীয় সবজি দেখে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। পানির মধ্যে ভিজিয়ে রাখা নানা ধরনের কাটা সবজি। একপাশে আগে থেকে বিস্কুটের আদলে ফ্রাই করা প্রোটিন। আমি কলমিশাক দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে সঙ্গী রন্ধনকুশলী জলি ফেরদৌসীকে দেখাতেই সেও বললো, হুমম কলমিশাকই তো। আমাদের কৌত‍ূহল দেখে নারীটি শাহাদাত আঙুল উঁচিয়ে কিছু একটা ইশারা করে একটা ডিশ এগিয়ে দিলেন। পছন্দের সবজিগুলো ডিশে তুলে দেওয়ার ইঙ্গিত।

ভেবে নিলাম, শাহাদাত আঙুলের মানে বোধহয় একটাকা বা এক ইউয়ান। এ রেস্তোরাঁর খাবারের মেন্যুতে ৪, ৬, ৮ এসব ইংরেজিতে লেখা। আমি বেছে বেছে সবজি, প্রোটিন ডিশে দিতেই তিনি তা মেপে রন্ধনকারিশমা শুরু করলেন।

সেগুলো ঝট করে ধুয়ে পাশেই বড় জলন্ত উনুনে টগবগ করে ফুটতে থাকা সসপেনের স্টকে ছুঁড়ে দিলেন। এর আগের এক কাস্টমারকে আঠালো ভাতের সঙ্গে সবজির একটা মিশেল দেওয়া একবাটি খাবার সার্ভ করতে দেখেছি। আমাকেও এরকম কিছু একটা দেওয়া হলে মন্দ হবে না। আমাকে বলছি এজন্য যে, সবজি দেখে জলি শুরুতে আগ্রহী হলেও এই রেস্তোরাঁতেই এরকম খাবার খেতে হবে তা মানতে নারাজ। সে আশা করছে আশপাশেই ভাত, ডাল, মাছ মাংসের কোনো হোটেল অবশ্যই আছে।

তুসু তো আরও এককাঠি সরেস। সে আশপাশের ঢাউস রাস্তার যতোদূর চোখ যায় ততোদূর ম্যাগডোনাল্ডস, কেএফসির ইংরেজি সাইনবোর্ড খুঁজছে। না পেয়ে হতাশ হয়ে বারবার বিরক্তি প্রকাশ করে বলছে, রাস্তার পাশেই এসব খেতে হবে কেন?

এমনিতেই আজকালকার ছেলেমেয়েদের মতো সবজিতে তার আগ্রহ নেই। তারওপর চীন দেশের কান্টন প্রদেশের দু‘দিনের অথিতি হিসেবে সবজি খেতে হবে এটা সে কিছুতেই মানছে না। ইতোমধ্যে আমি রেস্তোরাঁর টেবিলে বসেছি আর অন্য দু’জন রাস্তার আশপাশে ঘুরে চিকেনের দোকান খুঁজছে। রেস্তরাঁর নারীটি স্বভাবসুলভ মুচকি হাসি দিয়ে একবাটি সবজি সিদ্ধ বা সবজি স্যুপ আর চপস্টিক আমার সামনে রেখেছেন ইতোমধ্যে।

আশপাশের অনেকেই নানারকম খাবার উপভোগ করছেন। আমি ‘রাইস’ ‘রাইস’ বলে এর সঙ্গে ভাত দেওয়ার কথা বলছি। নারীটি আর তার

ক্যাশিয়ার স্বামী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে স্লোগানের মতো ‘লাইস’ ‘লাইস’ বলতে লাগলো। কিন্তু ‘লাইস’ আর আমার সামনে এলো না।

তিনি ব্যস্তসমস্ত হয়ে খদ্দেরদের অর্ডার নিচ্ছেন। রান্না করছেন। সাই সুই কথাবার্তা বলছেন। রেস্তোরাঁর ভেতরে যাচ্ছে, বাইরে আসছে। তার ব্যস্ততার অন্ত নেই। আমি চপস্টিক রেখে ইশারায় ‘মাঞ্জালা’ ‘মাঞ্জালা’ বলে চামচ দিতে বললাম। ভাবলাম চীনারা বাংলাদেশকে অন্তত এ শব্দটি দিয়ে বাংলাদেশ বোঝে। চামচ এলে স্যুপে চুমুকে দিয়ে দেখি স্বাদ মন্দ না, তবে সোয়া সসের গন্ধ একটু বেশি। লবণও কিঞ্চিত বেশি। তবে আমার জন্য চলে।

আমি দেশ-বিদেশে বেড়ানো ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়ার অভ্যেস আমার আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি স্যুপ শেষ করে হাত দিয়ে সবজি খাওয়া শুরু করেছি। কারণ বড় বড় কলমি শাক যেন একেকটা বড় গাছ। তা স্যুপের চামচ বা চপস্টিক দিয়ে ছোট করার জো নেই। সেটা আবার অর্ধসিদ্ধ। চিবিয়ে গলধকরণ করা ছাড়া এর কোনো ভূমিকা নেই। মনে হচ্ছে যেন জোর জবরদস্তি করে পেটে কিছু সবুজ সবজি ঢুকাতে পারলেই ল্যাঠা চোকে।

পুরো রেস্তোরাঁর অভ্যাগত আর মালিক-মালকিন কাম শেফ সবাই আমার খাওয়া দেখছেন আর সাই সুই আলাপ করছেন। আমি যে এ তল্লাটে নতুন তা-ই তাদের আলাপের বিষয় বলে মনে হচ্ছে। মনে হলো, পৃথিবীর ক্যান্টন নামের এক শহরের স্থানীয় রেস্তোরাঁয় সাঁঝরাতে বসে আমি নিরন্তর সবজি চিবিয়ে যাচ্ছি আর তাবৎ মানুষ আমাকে দেখে দেখে হাসছে।

দু’সঙ্গী ম্যাগডোনাল্ডস, কেএফসি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে খাওয়া দেখনে ওনাদের দলে ভিড়েছেন। এরই মধ্যে সবজির বড় একটা চাঙ্ক মুখে চালান করে চিকেনওলা ডিশের ছবি দেখিয়ে আমি তুসুকে এ রেস্তোরাঁতেই খেতে অনুরোধ করছি। সে আধোরাজি দেখে মালিক আর মালকিনকে চিকেন চিকেন বলে কিছু বোঝাতে চাইলাম। মালিক উঠে গিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট এনে আমার সামনে দিলেন। আমি না না বলে চিকেন চিকেন বলে চিকেনসহ কোনো খাবারের কথা বললেও সিগারেটের প্যাকটে বদলে দেওয়া হলো।

বুঝলাম, চিকেন বলে এখানে কাজ হবে না। এ রাতে ম্যাগডোনাল্ডস, কেএফসি খুঁজতেই বেরুতে হবে না।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৩ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৬
এএ

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।