ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্যারিসে ঘুরে বেড়ানো/পর্ব-৪

মেট্রো ও পিয়ানোবাদন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪১ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৭
মেট্রো ও পিয়ানোবাদন প্যারিসে ঘোরাঘুরি

মেট্রো ও পিয়ানোবাদন
পর্ব-৪

আপাতদৃষ্টিতে মাকেনি শহর থেকে কাবালা যাওয়ার পথে তার গাড়ির সাথে ভারী কোনো ট্রাকের সামনা-সামনি সংঘর্ষ হয়। অ্যাক্সিডেন্টের পর ট্রাক থামেনি।

সড়কে চাকার ভারি দাগ ফেলে চলে গেছে তার গন্তব্যে। মি. হুভারের পাজেরোর ফ্রন্ট ড্যামেজ হয়েছে মারাত্মকভাবে। চুরমার হয়েছে উইন্ডস্ক্রিন। স্টিয়ারিং হুইলের চাপে ভেঙে যায় তার পাঁজরের বেশ কয়েকটি হাড়।  
অজ্ঞান হয়ে রক্তক্ষরণরত হালতে তিনি বসে ছিলেন ভাংচুর হওয়া গাড়িটিতে। অজ্ঞাত কেউ ব্রিটিশ হাইকমিশনে টেলিফোন করে তার অ্যাক্সিডেন্টের খবর জানায়। ঘণ্টা খানেকের ভেতর তাকে হেলিকপ্টারে ইভাকুয়েট করে নিয়ে যাওয়া হয় সমুদ্রে ভাসমান ব্রিটিশ নৌবাহিনীর হসপিটাল শিপে। তদন্তে জানা যায় যে, তার শরীর থেকে যখন রক্ত ঝরছিল, তখন তার পকেট থেকে ওয়ালেট, আইফোন ইত্যাদি কে বা কারা তুলে নেয়। দশ হাজার ডলার সমমানের লোকাল কারেন্সিও এসময় খোয়া যায়। ব্রিটিশ হাইকমিশনের নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা কনক্লুসনে আসেন যে, পরিকল্পিতভাবে ভারী ট্রাক দিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে ছিনতাই করা হয় তার গাড়িতে করে বহন করা অর্থসম্পদ।

এক্সিডেন্টের ঘটনার পর মি. হুভার বিলাতের একটি হাসপাতালে মুমূর্ষু হালতে বেঁচে ছিলেন বেয়াল্লিশ দিন। আজ তার মৃত্যু হয়েছে। আমি মোবাইল ডিভাইসে আসা সংবাদটির দিকে তাকিয়ে পাতাল রেলের কামরায় নির্বাক হয়ে বসেছিলাম। ম্যানুয়েল তার আইফোনে কিছু খুঁটখাট করতে করতে ‘এক্সকিউজ আমওয়া’ বলে উঠে কমপার্টমেন্টের অন্যদিকে হেঁটে যায়। আগাথা ঝুঁকে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘সামথিং রং? নিশ্চয়ই কোনো ডিসাপোয়েনটিং সংবাদ পেয়েছো তুমি’। গ্রিস দেশের এ অচেনা নারীর সহানুভূতিকে সহজাত মনে হয়। মি. হুভার যে কী রকম আকর্ষণীয় চরিত্রের মানুষ ছিলেন, তা তাকে সংক্ষিপ্তভাবে বলি। ডিপ্লোম্যাটিক কোর থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বয়স্ক এক মহিলার সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন তার অধিকারে আসে অঢেল বিত্ত। ফ্লাই করতে ভালোবাসতেন মি. হুভার। স্ত্রী’র সুবাদে জুটেছিল ছোট্ট একখানা বাইপ্লেন। কিছুদিন বাস করেন কেনিয়ার জঙ্গলাকীর্ণ এক রেঞ্চে। তখন ফ্লাই করতেন পূর্ব আফ্রিকার সর্বত্র। অজানা সব নদীজলের কাছে বালুচরে ল্যান্ড করে ঢুকে পড়তেন বনানীতে। সিয়েরা লিওনে স্থায়ীভাবে বসবাসের চিন্তাভাবনা করছিলেন। পরিকল্পনা করছিলেন তার জানাশোনা কয়েকটি পল্লীগ্রামে উন্নয়ন প্রকল্পের। আমাকে বলতেন, ইবোলা অতিক্রান্ত হলে বিলাত থেকে নিয়ে আসবেন তার ছোট্ট বাইপ্লেন। আমাকে নিয়ে ওড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন, আলী আকবরের সরোদ বাজিয়ে...উই উইল ফ্লাই ওভার দ্য গোলা রেনফরেস্ট। আর ভাগ্য ভালো হলে দেখবো নিচে জঙ্গলাকীর্ণ জলাভূমিতে চরে বেড়াচ্ছে ফরেস্ট এলিফ্যান্টস্।
ম্যানুয়েল ফিরে এসে ইস্পাতের চকচকে খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। কী যেনো এক আজানা উৎসাহে সে টগবগ করে ফুটছে। তাকে বাক দিতে উদ্যত মোরগের মতো দেখায়। চোখেমুখে চাপা কৌতুক নিয়ে আগাথা তাকে অবলোকন করছে নিবিড়ভাবে। তাদের চোখে চোখে বিনিময় হয় বার্তা। গ্রিক নারীটি উঠে ম্যানুয়েলের পাশে দাঁড়িয়ে তার বাঁ হাত টেনে এনে তার কোমর পেঁচায়। চলমান ট্রেনে ভারসাম্য রক্ষা করে তারা দু’জন হেঁটে যায় কম্পার্টমেন্টের অন্যদিকে। ওখানকার নিভৃতিতে দাঁড়িয়ে আগাথা মুখ তুলে তাকায় দীর্ঘদেহী ম্যানুয়েলের দিকে। সে নিচু হয়ে ঝুঁকে চুমো খায় তার ঠোঁটে। খানিক দূর থেকে পরস্পরের শরীরে সংলগ্ন হয় ওঠা মানব-মানবীকে দেখায় তৈলচিত্রে আঁকা রোমান্টিক জুটির মতো।

অ্যামেচারদের পিয়ানোবাদন
  
ট্রেন থেকে নেমে এসে দেখি ভূতলের এ মেট্রো স্টেশনে চলছে ফরাসি বিপ্লব নিয়ে আঁকা তৈলচিত্রের প্রদর্শনী। যাত্রীরা যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে খুঁটিয়ে দেখছে শত বছর আগে ঘটে যাওয়া সংঘাত ও সমাজ বদলের রঙিন চিত্র। উল্টোদিকের দেয়ালজোড়া কাঁচে পড়ছে তাদের ছায়া। ওখানে তাকিয়ে মনে হয় চিত্রকরের আঁকা ছবির ডিটেল ও চলনোদ্যত ট্রেনযাত্রীদের শরীরের গতিময়তা মিলেমিশে তৈরি হয়েছে যেনো অভিনব এক ফ্রেস্কো।  

আমরা এক্সেলেটরের সিঁড়ি ধরে উঠে আসি উপরের লেয়ারের সামান্য কয়েকজন প্যাসেনজার্সে ভরপুর পরিসরে। এখানকার প্ল্যাটফর্মের কোণে পেতে রাখা আছে একটি পিয়ানো। তাতে বসে এক অ্যামেচার বাজিয়ে তুলছে টুংটাং বোল। তার বাদনের হাতকে ঠিক সাবলীল বলা চলে না। তার এক বন্ধু পাশে বসে তাকে দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে বাজাতে হবে। তো প্ল্যাটফর্মে পিয়ানো দেখতে পেয়ে কী কারণে যেনো উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে আগাথা। সে বাদন শুনতে দাঁড়িয়ে পড়লে যৎসামান্য বাজিয়ে অ্যামেচোর বাদকরা উঠে পড়ে। আগাথা সদ্য খালি হওয়া পিয়ানোর টুলে হাত রেখে জানতে চায়, ‘জেন্টলম্যান, আর ইউ আপ ফর সাম মিউজিক?’ ম্যানুয়েলকে বিভ্রান্ত দেখায়, সে কোনো জবাব না দিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলে আগাথা তাকে সরাসরি প্রশ্ন করে, ‘আমি যদি সামান্য সময়.. ধরো মিনিট পাঁচেক একটু পিয়ানো বাজাই, হাউ অ্যাবাউট দিস?’ সে ঘাড় হেলিয়ে সায় দিলে আগাথা আমার দিকে তাকায়, আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানাই, ‘ইট উড বি লাভলি টু হিয়ার ইউ প্লে আগাথা’। সে সঙ্গে সঙ্গে ‘থ্যাংক ইউ জেন্টলম্যান’ বলে স্কার্ট হাঁটুর কাছাকাছি তুলে কোমর বাঁকিয়ে অত্যন্ত ফেমিনিন ভঙ্গিতে কার্টসি করে বসে পড়ে পিয়ানোর টুলে। কি-বোর্ডে তার আঙুল চলাচল করে দারুণ দক্ষতায়। রোদ মরে গিয়ে আকাশ মেঘে মেঘে ছেয়ে ওঠার মতো পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে বিষণ্ন অথচ শ্রুতিনন্দন সুরধ্বনি। চলমান ট্রেনযাত্রীরা এক্সেলেটর থেকে নেমে এক্সিট গেটের দিকে যেতে যেতে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে পড়ে শোনে তার বাদন। আগাথা বাজিয়ে যাচ্ছে ‘অল থিংস্ ব্রাইট অ্যান্ড বিউটিফুল’ বলে অসামান্য একটি লিরিকের সুর। ইউরোপের নানা ভাষায় গীত এ সঙ্গীতের সুর সচরাচর বাজানো হয় চার্চে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে কোনো প্রয়াত প্রিয়জনকে বিদায় জানানোর সময়। পিয়ানোর চারপাশে জমে যায় জনা আট-দশেক মানুষের ছোটখাট ভিড়। আগাথা পিয়ানোর ডালা বন্ধ করে ঝুঁকে তাদের দিকে বাও করে।  

প্ল্যাটফর্মে গিটার বাজানো গায়ক
অনেক দীর্ঘ একটি একটি চলিষ্ণু সিঁড়ি বেয়ে আমরা বেরিয়ে আসি খোলা হাওয়ায়। এদিককার পথঘাট মনে হয় আগাথার ভালো করে চেনা। সে রোডকর্নার পার্কের ভেতর দিয়ে শর্টকাটে একটি ব্লক অতিক্রম করার প্রস্তাব দেয়। ঝকঝকে রোদে কৃত্রিম ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি তাকে উদ্দেশ্য করে মন্তব্য করি, ‘সো আগাথা, আই সি ইউ আর আ একমপ্লিসড্ মিউজিসিয়ান, তুমি কি পেশাদারভাবে কখনও গান করতে’? গ্রীবা বাঁকিয়ে হেসে জবাব দেয় সে, ‘আমাদের পরিবারে পাঁচ ভাইবোনের সবাই কমবেশি কোনো না কোনো মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট বাজাতে পারি। শুধু আমার ছোটভাই ডেভিডের গানের গলা ছিলো। কয়েক বছর আগে সে ক্যানসারে মারা যায়’। আমি মৃত্যুসংবাদে দুঃখপ্রকাশ করে বলি, ‘অল থিংস ব্রাইট অ্যান্ড বিউটিফুল’ লিরিকের সুর পিয়ানোতে তুলতে গিয়ে তুমি তোমার ভাই ডেভিডের কথা ভাবছিলে কি? আগাথা হেঁটে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে আমার দিকে তাকায়, কী যেনো ভাবতে গিয়ে তার মুখে ফুটে ওঠে নির্লিপ্তি, ম্লান হেসে সে বলে, ‘ডেভিডের মৃত্যুর পর কেটে গেছে বছর কয়েক। তার চলে যাওয়ার শোক এখন সহনীয় হয়ে গেছে। বাট ইট ইজ ট্রু দ্যাট আই প্লেড দিস সঙ ইন হিজ ফিউনারেল। ডেভিড জানতো তার সময় ঘনিয়ে আসছে দ্রুত, তাই সে আমাকে এ গানটি তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বাজানোর অনুরোধ করেছিল। তবে আজকে হঠাৎ করে বাজাতে ইচ্ছা হলো তোমার সদ্যপ্রয়াত সুহৃদ জোসেফ হুভারের মৃত্যুতে’।  

এ পর্যন্ত বলে সে আমাকে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত হেঁটে গিয়ে ম্যানুয়েলের হাত ধরে। তার আচরণে আমি মারাত্মকভাবে অবাক হই। মি. হুভারের মৃত্যুসংবাদ আমার মোবাইল ডিভাইসে এসেছে খুব নীরবে। বিষয়টি সে খেয়াল করে চেষ্টা করেছে কঠিন মুহূর্তে আমার কাছাকাছি হয়ে আমাকে কম্ফোর্ট দেয়ার। এমন কি অচেনা গ্রিক নারীটি মি. হুভারের নাম পর্যন্ত মনে রেখেছে!

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৭
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।