ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

শংকরের সঙ্গে একদিন ও কথামালা | হাবীব ইমন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৭ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০১৭
শংকরের সঙ্গে একদিন ও কথামালা | হাবীব ইমন শংকরের সঙ্গে একদিন ও কথামালা

কলকাতায় গিয়েছিলাম এ বছর ফেব্রুয়ারিতে। দুই বছর পর যাওয়া এবার। বিধাননগরে একটি সামাজিক মিলনোৎসব ও বারাসাতে আমার প্রকাশক মারুফ হোসেনের আমন্ত্রণে তার প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয়োজনে উপস্থিত ছিলাম। দু’টি অনুষ্ঠান ছিলো একই দিনে।

আয়োজনগুলো ছিলো ভিন্ন আঙ্গিকে। একটি ছিলো আনুষ্ঠানিক আর অন্যটি লেখক-প্রকাশক-সম্পাদকের আড্ডা।

অভিভূত ও মুগ্ধতা লেগে ছিলো সেইসবে। অনেক চেনা-অচেনা মানুষের ভালোবাসা-আলিঙ্গন আমাকে সবিম্ময় করেছে।  

এর আগে, যখন কলকাতায় গিয়েছিলাম সেইসময় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। দুই দিন লেগে থাকার পর আধঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন তিনি। স্বল্প সময়ের এ সাক্ষাৎকারটিতে বেশ ঝাঁঝ ছিলো। সাক্ষাৎকারটি অনলাইন ম্যাগ পরস্পর ও দৈনিক আমাদের সময়ে প্রকাশিত হয়। এইবার সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা ভাবলাম কথাসাহিত্যিক শংকরের। পুরো নাম মণিশংকর। কিন্তু চৌরঙ্গী, আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিত্তবাসনাসহ বহু জনপ্রিয় উপন্যাসের স্রষ্টা পশ্চিমবঙ্গের এই লেখক, পাঠক মহলে শংকর নামে পরিচিত।  

শংকরের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো সুযোগ ছিলো না। নিভৃতচারী মানুষটি খুব বেশি মানুষের সামনে আসেন না। তার নিজের ভাষায়, ‘কেউ আমাকে টেনে না আনলে কিংবা ধাক্কা না দিলে আমি আসলে নড়ি না’। কলকাতার অনুজ একজন শুভার্থীর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। বেশ আন্তরিকতা দেখালেন। দিনটি ছিলো ০১ ফাল্গুন। আমাদের দেশে সেসময় ফাল্গুন বরণ করার জন্য নানা আয়োজন চলছে। প্রতিটি অলি-গলিতে বাসন্তী সাজ। কলকাতায় কিছুই পেলাম না। এখানে তার ছিঁটে-ফোঁটা দেখিনি।  

শংকর দা-কে ফোন করলাম। ভেবেছিলাম, তিনি ফোন রিসিভ করবেন না। বা রিসিভ করলেও এড়িয়ে যাবেন। এতো বড় লেখক! বাংলা সাহিত্যের এতো জনপ্রিয় লেখক। ব্যস্ত মানুষও তিনি। না, তার কোনো অহঙ্কার পেলাম না। আমার পরিচয় শোনার পর মনে হলো তিনি কিছুটা আবেগতাড়িত হলেন। তাড়াতাড়ি যেতে বললেন আমাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে অফিস থেকে বেরিয়ে যাবেন তিনি। আমারও পরদিন ঢাকায় ফেরার তাড়া। হাতে সময় ভীষণ কম। সন্ধ্যেবেলায় সিনেমা দেখার কথা ছিলো সফরসঙ্গীদের সঙ্গে, ওটা বাদ দিয়ে তার দেওয়া ঠিকানা নিয়ে আমি এগুতে থাকলাম। ঠিকানাটা সহজ, আমার আবাসস্থলের কাছেই। গণ্ডগোলটা লাগলো ওখানে, আমি কলকাতার সবকিছুকে আত্মস্থ করতে পারিনি। ফলে ঠিকানা খুঁজে পেতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। বেশ বড়-সড় অফিসে গিয়ে হাজির। সিকিউরিটি-রিসিপশনে আমার আসার কথা তিনি বলে রেখেছিলেন। ওরা আমাকে বেশ সহযোগিতা করলো। আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। অনেকগুলো কক্ষের মধ্যে শংকর দা’র রুম পেতে অসুবিধে হয়নি। তিনি আমাকে দেখে বেশ উচ্ছ্বসিত হলেন। মুখের কোণে এক চিলতে হাসি টেনে নিলেন। অত্যন্ত বিনয়ী-হাস্যোজ্জ্বল তিনি। ওই রুমে আরও কয়েকজন ছিলো, সম্ভবত তারা তার অফিসের স্টাফ। তাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথা বলে বিদায় দিচ্ছেন। আমি এই ফাঁকে তার অনুমতি নিয়ে কয়েকটি ছবি তুলে নিলাম।

অনেক কথা চললো। অনেক প্রশ্ন করলাম তাকে। বিরক্ত হলেন না। খুব সহজভাবে, বিনয়ের সঙ্গে তিনি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলেন। কোনো রাখ-ঢাক ছিলো না তাতে। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলার কৌশলও ছিলো না তার মধ্যে।  

লেখক শংকরের জীবনযুদ্ধ এবং সাহিত্য জীবনের কথা কারও অজানা নেই নিশ্চয়। তার একটি গুণ রয়েছে, সাধারণ মানুষের প্রতি অসীম সমবেদনা, হয়তো সাফল্যের শিখরে উঠেও নিজের জীবনযুদ্ধের কথা ভুলে যাননি। অকপটে স্মরণ করেন তিনি। শংকরের জন্ম ১৯৩৩ সালের ০৭ ডিসেম্বর পথের পাঁচালির দেশ বনগাঁওয়ে, তদানীন্তন যশোর জেলায়। বিভূতিভূষণও জন্মেছিলেন এখানে। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে যান কলকাতার ওপারে হাওড়ায়। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। শংকর বলেন, ‘বাবার অকাল মৃত্যুর পর সেই চৌদ্দ বছর বয়স থেকে উপার্জনের সংগ্রামে নেমে পড়েছি, তারপর সারাজীবন দু’নৌকায় পা দিয়ে জীবন সমুদ্রে ভেসে চলেছি’।  

অল্প বয়সে বাবার পেশার সূত্রে কলকাতার হাইকোর্টে করণিক হিসেবে চাকরি পান। জীবনের শুরুতে কখনও ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনও প্রাইভেট টিউশনি, কখনও শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। কোনো একসময়ে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে আইএ পাশ এবং বঙ্গবাসী নৈশ কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি হাইকোর্টের ইংরেজ ব্যারিস্টার নোয়েক ফ্রেডরিক বারওয়েল সাহেবের সঙ্গে যুক্ত হন। এই বারওয়েল সাহেবই শংকরকে সাহিত্য রচনায় অনুপ্রাণিত করেন। বারওয়েলের মৃত্যুতে তিনি কিছুটা শোকাচ্ছন্ন হন। তাকেই উৎসর্গ করলেন তার প্রথম গ্রন্থ ‘কত অজানারে’। শংকরের প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। অল্প বয়সে ‘কত অজানারে’ বইটি লিখে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। সেই থেকে শংকর লিখছেন। ‘কত অজানারে’ লেখার সময় সবচেয়ে অবহেলা পেয়েছেন বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের দু’-একজন সহকর্মীর কাছ থেকে, তারা পাণ্ডুলিপি পড়ে বলেছিলেন, কিসসু হয়নি। সবচেয়ে সাহায্য করেছিলেন শঙ্করীপপ্রসাদ বসু। আর বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ ও সাগরময় ঘোষ। অন্নদাশঙ্কর রায়কে শান্তিনিকেতনে ‘কত অজানারে’ পাঠিয়েছিলেন তিনি। অন্নদাশঙ্কর তাতে তিনি লিখে দেন, ‘আপনার জীবনের প্রথম সাফল্যটি যেন জীবনের শেষ সাফল্য না হয়’।

তার প্রকাশিত গ্রন্থ প্রায় শতাধিক। কত অজানারে, চৌরঙ্গী ছাড়া রয়েছে নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি, মানচিত্র, পাত্রপাত্রী, রূপতাপস, এক দুই তিন, যোগ-বিয়োগ গুণ-ভাগ, নগরনন্দিনী, বিত্তবাসনা, মরুভূমি, কামনা বাসনা, ঘরের মধ্যে ঘর, সম্রাট ও সুন্দরী, পটভূমি, সীমান্ত সংবাদ, বাংলার মেয়ে, মুক্তির স্বাদ, সোনার সংসার, চরণ ছুঁয়ে যাই, জন অরণ্য, আশা-আকাঙ্ক্ষা, যেখানে যেমন ইত্যাদি। আরও অনেক বই লিখেছেন, এগুলোর মধ্যে ভ্রমণ রসসিক্ত কয়েকটি রচনাও রয়েছে।  

তার কয়েকটি বই চলচ্চিত্রেও রূপ পেয়েছে। বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায় তার সীমাবদ্ধ এবং জন অরণ্য উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তার চৌরঙ্গী উপন্যাস অবলম্বনেও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এতে মুখ্য চরিত্র স্যাটা বোসের ভূমিকায় উত্তম কুমার অভিনয় করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে শংকর বললেন, ‘সত্যজিৎই আমাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে’। তিনি আরও বলেন, ‘ওরা বলেÑএসপ্ল্যানেড। আমরা বলিÑচৌরঙ্গী। সেই চৌরঙ্গীরই কার্জন পার্ক। সারা দিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত শরীরটা যখন নড়তে চাইছিল না, তখনই ওইখানেই আশ্রয় মিলল। ইতিহাসের মহামান্য কার্জন সাহেব বাংলাদেশের অনেক অভিশাপ কুড়িয়েছিলেন। সুজলা-সুফলা এই দেশটাকে দু’ভাগ করার বুদ্ধি যেদিন তার মাথায় এসেছিল, আমাদের দুর্ভাগ্যের ইতিহাস নাকি সেই দিন শুরু হয়েছিল’।  

চৌরঙ্গী বই প্রকাশের প্রথম দিন থেকেই শক্তিমানদের নাক-উঁচু কান্না। শংকরের ভাষায়, ‘প্রথম দিন থেকেই সমালোচনা যে রেষ্টুরেন্ট আর রেস্তোরাঁর তফাত বোঝে না, সে লিখেছে হোটেল নিয়ে বই! এক নামী লেখিকা ‘দেশ’ সম্পাদককে চিঠি পাঠালেন অশিক্ষিতের উপন্যাস অভিযোগ করে। বললেন, ‘যে লোকটা ব্রেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট-এর সঙ্গে বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট’-কে গুলিয়ে ফেলতে পারে সে লিখেছে হোটেল নিয়ে বই। পাঠকরা যেমন ঢেলে দিয়েছেন, সমালোচকেরাও তেমনই ঢেলে আক্রমণ করে গেছেন। মানুষ বলে কেউ মনে করেনি। কোনও পুরস্কার দেয়নি। ভুল বললাম, একটা পুরস্কার ‘চৌরঙ্গী’ পেয়েছিল। শ্রেষ্ঠ বাইন্ডিং-য়ের জন্য’।

বোধোদয় উপন্যাস প্রকাশের পর শংকরকে উৎসাহ-বাণী পাঠান শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়: ‘ব্রাইট বোল্ড বেপরোয়া’। ভাবনা বা প্রকাশভঙ্গিতে এ-উপন্যাস নিজের অন্য লেখালেখি থেকে অনেকটাই অন্যরকম হওয়ায় তখন তা পড়তে দিয়েছিলেন মুম্বাইবাসী শরদিন্দুকে, পড়ে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার এই লেখায় জননী-জন্মভূমিকেই আমি সারাক্ষণ উপলব্ধি করলাম’। এই বই সম্পর্কে শংকর বলেন, ‘পাঠকমহলের নিন্দা ও প্রশংসার ডালি নিয়ে আমি নিজেও একসময় বোধোদয়-কে ভালবাসতে শুরু করেছি’। সত্তর দশকের অশান্ত কলকাতা নিয়ে তার ‘স্থানীয় সংবাদ’ উপন্যাসটি এবং ‘সুবর্ণ সুযোগ’Ñএই তিনটি উপন্যাস মিলিয়ে আগে প্রকাশিত হয়েছিল যে উপন্যাস-সংগ্রহ জন্মভূমি, প্রকাশিত হলো এর ১০২তম সংস্করণ। শংকরের জীবনাভিজ্ঞতা বিপুল। ছোট-বড় নানা অবস্থা ও অবস্থানে তিনি ছিলেন, নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেছে। সেইসব অভিজ্ঞতার রসরূপ তার কথাসাহিত্যে।  

কথার ফাঁকে ফাঁকে আমি তাকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানালাম। তিনি বললেন, আমি বাংলাদেশে আসতে চাই। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু আমি যেতে পারি না। আমার শরীরের কারণে যেতে পারি না। আমার ইচ্ছা আছে যাওয়ার। দেখা যাক কী হয়।  

কয়েক বছর আগে, ২০১০ সালে বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে শংকর বাংলাদেশে এসেছিলেন। এটি ছিলো তার প্রথম বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান। সে সময়কার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলেন, ‘বাংলাদেশে যাওয়ার পর আমি আমার যে বইটির উপর অটোগ্রাফ দিয়েছিলাম, সেই বইটি ছিলো পাইরেটেড। আমার বই এখানকার মানুষ পায়। কিন্তু সেই বইগুলো চুরি করা। বাজারে চোর আছে বলে কি গয়না পরে বের হব না?’   

হাবীব ইমন
কবি, কলামলেখক

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ০৫, ২০১৭
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।