ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

জলনৌকো : সরল এবং আশ্চর্য সুন্দর গদ্য

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১৫ ঘণ্টা, জুলাই ৯, ২০১৭
জলনৌকো : সরল এবং আশ্চর্য সুন্দর গদ্য জলনৌকো : সরল এবং আশ্চর্য সুন্দর গদ্য

জলনৌকো : সরল এবং আশ্চর্য সুন্দর গদ্য
ফারুক মুহাম্মদ

“যাবার তো কষ্ট নেই। হারাবার কষ্ট আছে।

চুপি চুপি এই মেঘ মৃত্যুময়। বাতাসে ঘর বাঁধা, উৎসব প্রান্তে রাখা। কৌশলে কিছু নদী ফিরে যায়। কিছু নদী কানে কানে নাম বলে, পাথরের শব্দের ঢেউ, আলো জ্বলে, ঠোঁটে আঁকে, চুম্বনে হাওয়াময় বাড়িটির দেয়াল ভেঙেছে চাঁদ-ঘুম? অবশেষে মোহনায় ঝাঁপ দেয় নদী, ভয় এসে সবটুকু গ্রাস করে যদি। নারী বোঝে এসবের মানে নেই কোনোÑজ্বলন্ত জীবন হবে না কখনো। ” (দ্বিচারিণী)

কয়েকটি লাইন বা একটি প্যারা একটি লেখার বা একটি গ্রন্থের সবটুকু সৌন্দর্যের পরিমাপক হতে পারে না। বহুক্ষেত্রেই হাবীব ইমনের গদ্যপদ্য উচ্চকিত, একই পরিধির মধ্যে ঘোরাফেরা করে। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে যাওয়ার ক্ষমতাও তার রয়েছে (নাকি রয়েছে?)। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যে দর্শনজটিলতাযুক্ত ভাষা-কুহেলিকা। তবে তার ভেতরে থেকেও হাবীব ইমনের গদ্যের নিজস্ব একটি স্টাইল আছে। সরল অথচ আশ্চর্য সুন্দর গদ্যগুলো লেখকের শব্দপ্রয়োগ আর ভাববৈচিত্র্যে কাব্যিক হয়ে উঠেছে আর কিছু গদ্য ছোটগল্পের মতো। নৈর্ব্যক্তিক দার্শনিকতার মধ্যে মন্তব্য সংশ্লেষ হয়েছে। হাবীব ইমনের গদ্যপদ্য ‘জলনৌকো’র পাঠ প্রতিক্রিয়ায় এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত।

আমাদের ছোটবেলা ছিলো নির্ভেজাল ও প্রকৃতিঘনিষ্ট। আমাদের গ্রামীণ জীবন ছিলো অসাম্প্রদায়িক ও সৌহার্দ্যে ভরা। কী ঈদ আর কী পূজা-পার্বণ, পাড়াতো ভাইদের সবারই অংশগ্রহণ ছিলো স্বতঃস্ফুর্ত ও নির্মল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেইসব দিন হারিয়েছে যান্ত্রিকতার যাতাকলে। সে কথাই যেনো ফুটে উঠছে গ্রন্থটির নামগদ্যেÑ
“আমাদের ছেলেবেলার কথা যখন মনে হয় দীর্ঘশ্বাস ফেলি, আহারে আদৃতার মতো শিশুরা এখন বঞ্চিত। তাদের জীবনযাত্রায় এখন সংযোজন হয়েছে প্রযুক্তি নির্ভর অত্যাধুনিক কৃত্রিম আনন্দ। ” (জলনৌকো)

এছাড়াও ‘সাদা মাঠ’, ‘তেত্রিশ কেটে গ্যালো’-তে লেখক পাড়াগাঁয়ের চিরন্তন কিশোরকালের স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। ব্যক্তিজীবনের টানাপোড়েন আর একঘেয়ে জীবনের চিত্রায়ন হয়েছে ‘রিপিটেশন’ গদ্যে।

আমাদের যাপিত জীবনে কতোরকম সম্পর্ক। তার মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে সামনের সারিতে রাখবেন যে কেউই। বন্ধুত্বে মান-অভিমান ছাপিয়ে ‘বন্ধুত্ব’ই বড় হয়ে ওঠে। আর তাইতো বন্ধুর জন্য বন্ধু অপেক্ষা করে থাকে সারাটি জীবন। তেমনই একটি গদ্য ‘পাখিবনে অপেক্ষা’। ‘প্রণব আচার্য্য : জন্মদিনে পুরাণ কথা’ গদ্যটিও বন্ধুত্বের। মন-প্রাণ উজাড় করা বন্ধুত্বের। আর ‘বন্ধু’ গদ্যের ভাষ্যÑ
“পৃথিবীর কেউ ভালো না থাকলেও আমরা ভালো থাকব। কারণ আমরা ভালোবাসতে জানি। ”

বন্ধুত্বের সম্পর্কে আরেকটি সম্পর্কের ‘অনুপ্রবেশ’ যখন ঘটে তখন আমাদের মানসপটের রূপান্তরÑ
“তোমার প্রতি আমার প্রীতি আছে। তার চাইতে বড় সত্য হচ্ছে, তুমি আমার বন্ধু। জীবনের মহান বন্ধু। হয়তো সঙ্গী বলে কেউ ভুল ভাবতে পারে। বা কোনোকালে ভেবেছে। আমরা জীবনের সঙ্গী হতে চাইনি। কিন্তু বন্ধুই রয়ে গেলাম। ” (অ্যালজাইমার্স)
এই কথাগুলোর মধ্যে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস আছে। এটা আমাদের ব্যক্তিজীবনের দীর্ঘশ্বাস। না পাওয়ার আক্ষেপ। বুকের বামপাশে ফুটে থাকা রক্তজবার মতো ক্ষত।

নর-নারীর বিবিধ সম্পর্কের সমাজসৃষ্ট বৈধতা-অবৈধতার দেয়ালের একটিÑবয়স। সমাজের এই দেয়ালের আড়ালে হারিয়ে যায় কতো কতো প্রেম। ‘মহাশয়া বেয়াদবি নিও না’ গদ্যে একজন বন্ধু কিংবা প্রেমিকের আর্তনাদ ছড়িয়ে আছে বিমূর্ত হয়ে।  

ব্যক্তিজীবনের হতাশা, সম্পর্কের টানাপোড়েন, আশাভঙ্গের গ্লানি, সামাজিক অস্থিরতা সবই যেনো মূর্ত হয়ে উঠে ছোট একটি গদ্যেÑ
“একটি ভয়ঙ্কর অপরিচিত জগৎ আমাকে গ্রাস করছে। ছেঁড়া-ফাটা-নোংরা সব। মাঝে মাঝে তারাজ পরিবহনের একজন বদ্ধ উন্মাদ যাত্রী মনে হয়। ” (সিজোফ্রেনিয়া)

“একদিন ‘ভুলে ভরা’ আক্কাস আলী, চাপা অভিমানে হারিয়ে গেলো।
সেদিন কোনো জ্যোৎস্না ছিলো না। ছিলো অমাবস্যার মধ্যরাত। ” (আক্কাসনামা)
‘সমাজচ্যুত’ প্রতিবন্ধী মানুষদের দুঃসহ অভিমান-যন্ত্রণার অ্যালবাম যেনো ‘আক্কাসনামা’ গদ্যটি।

হাবীব ইমনের ‘জলনৌকো’য় ভালোবাসা আছে, বন্ধুত্ব আছে, ভাই-বোনের সম্পর্কের টানাপড়েন আছে, বৃষ্টি বন্দনা আছে, অন্তহীন অপেক্ষা আছে, আছে মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার আকুতি; যা পাঠককে সচেতনভাবে নস্টালজিক করে তুলবে। হাবীব ইমনের লেখা সহজ-সরল। আসলে তার ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাপ্রবাহ বড় বেশি প্রভাব ফেলেছে তার লেখায়। জীবনকে দেখেছেন নিজের মতো, স্বাভাবিক-শিল্পমানসে। হাবীব ইমনের লেখা জীবনঘনিষ্ট, বিষয়-বৈচিত্র্যে ভিন্নতর, কেননা তিনি যেসব বিষয় নির্বাচন করেছেন তা আমাদের গদ্যকাররা মামূলি ভেবে এতোদিন এড়িয়ে গেছেন।  

জলনৌকো । হাবীব ইমন
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
প্রকাশন: ছিন্নপত্র প্রকাশন
প্রকাশকাল: জুন ২০১৭
মূল্য: ১৮০ টাকা

ফারুক মুহাম্মদ
কবি।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৪ ঘণ্টা, জুলাই ০৯, ২০১৭
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।