ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

দো-আশলা | অরিন্দম নাথ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১, ২০১৭
দো-আশলা | অরিন্দম নাথ দো-আশলা

পরিমলের সাথে সুবলবাবুর প্রথম পরিচয় একটি লোক আদালতে। সুবললাল বসু, প্যালিনড্রোম। উল্টালেও সেই নামই আসে। তিনি তখন পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। জেলার অতিরিক্ত দায়রা জজ হীরক ভট্টাচার্য তার বন্ধু। খুবই সজ্জন ব্যক্তি। তার অনুরোধে এক রবিবারে হাজির হলেন লোক আদালতে।

বিচারকের দায়িত্ব পালনের জন্য। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।

এতদিন তিনি তদন্ত করে আদালতে বিচারের জন্য মামলাই পাঠিয়ে এসেছেন। তার মতো আরও দু’জন ছিলেন। একজন কলেজের প্রফেসর। অন্যজন বিশিষ্ট ডাক্তার। মামুলি ধরনের মামলা। অধিকাংশই যান নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইনের ধরায়। তাছাড়া রয়েছে খোরপোষের মামলা, যান দুর্ঘটনার মামলা, মামুলি বিরোধ ইত্যাদি। বাদী-বিবাদী দু’পক্ষই হাজির থাকে। তাদের কৌশুলি ছাড়া। তবে অনেক ক্ষেত্রেই কৌশুলিরা বাগড়া দেয়। তারা বোঝায় যে স্থায়ী আদালতে বিচার হলে অনেক বেশি ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে। হীরক-বাবুই একদিনের বিচারকদের গাইড করছিলেন।

শরিকি বিরোধ থেকে পরিমলের মামলা। মামলার নথি বলল দু’পক্ষই সাত ধারা থেকে শুরু করে জোর করে জমি দখল ও হামলার প্রচুর অভিযোগ পাল্টা-অভিযোগ এনেছে। প্যালিনড্রোম আগ্রহ নিয়ে বর্তমান মামলার বাদী পরিমল দেবনাথের বক্তব্য শুনছিলেন। নথিতে তার বয়স ৩১। ছিপছিপে চেহারার জন্য তাকে আরও তরুণ দেখায়।   হীরক বাবু পরিমলের মামলার বিষয়ে অবগত ছিলেন। তিনি সুবলবাবুকে বললেন মামলাটি বকেয়া রেখে পরের মামলায় চলে যেতে। পরিমলের মামলার সুরাহা লোক আদলতে হবে না। বিবাদীপক্ষ দৃশ্যত খুশি হলো। পরিমল কিছুটা ছলছল দৃষ্টিতে দূরে দাঁড়িয়ে রইল। চা-বিরতির ফাঁকে তিনি পরিমলকে ডাকলেন। তার প্রতি কেন যেন তার মায়া পড়ে গিয়েছিল। পরিমলকে অফিসের ঠিকানা দিয়ে বললেন পরদিন সন্ধ্যায় তার অফিসে দেখা করার জন্য। হীরক বাবুও খুশি হলেন। বললেন, সেই ভালো, আপনি পরিমলের কাছ থেকেই তার কাহিনী প্রথমে শুনুন। পরে আপনার সঙ্গে কথা বলবো।

পরদিন পরিমল যথাসময়েই এলো। সে এক করুণ কাহিনী। পরিমলদের বাড়ি পশ্চিম থানাধীন জয়পুর। তিন ভাই, দুই বোন। সম্পন্ন অবস্থা। মূলত কৃষিজীবী। সীমান্তে থাকার সুবাদে পাচার-বাণিজ্যে অংশ নিয়েও পরিবারটির উপরি কামাই ছিল। তখন সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। লোকজন অনেকটা অনায়াসে বাংলাদেশে যাতায়ত করত। পরিমলও যেত। তখন সে সবে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পড়েছে।

রফিকুল হাসান ওপারের বড় ব্যবসায়ী। তার আড়তে যাতায়াতের সুবাদে পরিচয় আনিকার সঙ্গে। আনিকা বেগম, রফিকুলের দূর-সম্পর্কের ভাগিনী। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তার চাহনে-ওয়ালাও প্রচুর। সবাই মুসলিম যুবক। শেষ পর্যন্ত আনিকা পরিমলকেই পছন্দ করল। একদিন সে পরিমলের সঙ্গে এপারে পালিয়ে এলো। পরিমলের বাবা তখন জীবিত। তিনি এই সম্পর্ক মেনে নিলেন না। দু`জনকেই থানায় নিয়ে এলেন। দু`জনেই তখন পূর্ণবয়স্ক। থানায় আনিকা বলল সে ওপারে যাবে না। পরিমলের বাবার বক্তব্য তিনি হিন্দু হয়ে মুসলমান বউ ঘরে তুলবেন না। শেষ পর্যন্ত থানার মধ্যস্থতায় তিনি পরিমলকে কিছু জায়গা দিয়ে আলাদা করে দিলেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করল। একই অবস্থা এলাকার হিন্দু পরিবারগুলোর। কিন্তু আশপাশের মুসলিম পরিবারগুলো তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাল।

পরিমলের বন্ধু-বান্ধবদের একটি অংশ তার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করল না। পাচার-বাণিজ্য ছাড়াও তাদের অনেকেই তখন বিভিন্ন অপরাধে নাম লিখিয়েছে। পরিমল মাধ্যমিক পাস করেছিল। বটতলা বাজারে খুচরো সবজি বিক্রি করে আনিকাকে নিয়ে সুন্দরভাবেই চালাচ্ছিল সংসার। ইতোমধ্যে পরিমলের বাবা মারা গেছেন। মা আগেই গত হয়েছেন। পরিমল তার ব্যবসায় উন্নতি করে স্থায়ী আড়ত নিয়েছে। তাদের একমাত্র মেয়ে আয়ুশি পড়ছে স্কুলে। কিন্তু পরিমলের ভাইয়েরা তার উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত। অনেকবার তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে।
 
পরিমল সুবলবাবুকে বলল যে সে অস্বীকার করছে না তার বন্ধুরা অসামাজিক কাজে যুক্ত ছিল। তারা তাকে দুর্দিনে সাহায্য করেছে। তাই সে তাদের সঙ্গ ছড়তে পারে না। তাছাড়া বন্ধুদের সবাই এখন বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। পরিমল সুবলবাবুকে অনুরোধ করল, তার বাড়িতে বেড়িয়ে আসার জন্য। অবশ্য উর্দি পরে। তিনি তার সাথে আছেন, এই কথা জানলে শরিকরা তাকে নিয়ে ঘাঁটাবে না। পরিমলের অনুরোধ তার মনে ধরল।

পরের রবিবার বিকেলে তিনি তার কথা রাখলেন। আনিকা শব্দর অর্থ রূপসী। পরিমলের বউ সত্যিই অপরূপ সুন্দরী। তাদের ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া মেয়ে আয়ুশি মার মতো সুন্দরী নয়। তবে দেখতে মা-বাবার চেয়ে ফর্সা। আনিকা তার মুসলিম ধর্ম ত্যাগ করেনি ৷ মেয়ে আয়ুশি ও পরিমল হিন্দু রীতি মেনে চলে। এ নিয়ে তাদের পরিবারে বিরোধ নেই।

কিন্তু সুবলবাবুর মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কাটে পরিমলদের কুকুর নয়ন। কুকুরটি দো-আশলা। লেজ এবং পাগুলো লম্বা লম্বা। কিছুটা বাঘের মতো ডোরাকাটা। কুকুরটির একটি ইতিহাস রয়েছে। এর মা মিলি ছিল আনিকাদের কুকুর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল গ্রে-হাউন্ড প্রজাতির। আনিকা এপারে পালিয়ে আসার দু’দিনের মাথায় মিলিও এপারে চলে আসে। মিলিকে নিয়ে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ বাঁধেনি। মিলি বছর দু’য়েক বেঁচেছিল। বেশ কয়েকটি সন্তানেরও জন্ম দেয়। যার একটি নয়ন। এর রক্তে, হিন্দু না মুসলিম বাড়ির কুকুরের রক্ত মিশেছে কেউ জানে না। তবে নয়নও সুবললাল বসুর মতো প্যালিনড্রোম।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।