ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নীল উড়াল: তৃতীয় পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৭
নীল উড়াল: তৃতীয় পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অস‍ৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

৩.
মার্গারেট নামের অচেনা মেয়েটি আমার ভীষণ ক্ষতি করে গেল। বারমুডায় আফিমের ওপর বইটি পেয়ে যেমন হয়েছিল, ঠিক তেমনই অবস্থা।

মার্গারেট যেন আমার কানে কানে বলছে, লেখালেখি বা গবেষণার ব্যাপারটা, ইন ফ্যাক্ট, যে কোনও সাধনাই এক কঠিন তপস্যার নামান্তর। কয়েকজনের প্রশংসা বা ছেপে প্রকাশ পাওয়ার গণ্ডির মধ্যেই সার্থকতা খুঁজে নিয়ে স্ট্যাটিক হয়ে দাঁড়িয়ে যায় অনেক ক্রিয়েটিভ লেখক। যারা আরও এগোয়, আরও দূরে যেতে চায়, তাদের নিত্যসঙ্গী হয় অতৃপ্তি। কনফিউশন। মার্গারেট যেন আমাকেই বলছে, যেদিন অতৃপ্তি তোমাকে ছেড়ে যাবে, সেদিন সব সৃষ্টিশীলতা শেষ। অনির্বচনীয় আনন্দের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে তুমি। তুমি চিত্তানন্দে সুখের ঢেঁকুর দিও না। তোমার সাধনা চালিয়ে যাও। তবেই হবে মোক্ষ লাভ।

আমি সর্বক্ষণ কেবল ভাবছি, অতীতের রোমন্থন কোনও কাজের কাজ বয়ে আনবে না। বর্তমানকে দেখতে হবে নানা আঙ্গিকে। অতীতকে নিয়ে আদিখ্যেতা করা যায়। কিন্তু বেঁচে থাকতে হয় বর্তমানকে নিয়ে। আর সতর্ক থাকতে হয় ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই অতীতকে নিয়ে পড়ে থাকেন, বর্তমানকে অগ্রাহ্য করেন এবং এভাবেই ভবিষ্যতকে উপেক্ষা করতে থাকেন। হিন্দু ধর্মের একটি শ্লোক মনে পড়ছে আজকাল। ব্যাসদেব জননী সত্যবতীকে ভবিষ্যতের ছবি দেখিয়ে সতর্ক করে বলছেন, ‘অতিক্রান্তসুখাঃ কালাঃ পৃথিবী গতযৌবনাঃ’। কী আশ্চর্যভাবে কথাটা বলা হয়েছে। ‘সুখের দিন শেষ, পৃথিবী এখন গতযৌবনা। ’

আমি ভাবছি অন্য কথা। আসলে পৃথিবী নয়, গতযৌবনা হয়ে পড়ে মানুষ। যতদিন মানুষ তাজা থাকে, পৃথিবী তার কাছে তরুণী থাকে। মানুষ যত বৃদ্ধ হয়, পৃথিবীও ততই প্রৌঢ়া হয়ে যায়। তোমার চারপাশের পৃথিবীটাকে যতই তুমি মেক-আপ লাগিয়ে যুবতী করে তোলার চেষ্টা করো, লাভ নেই কোনও। নেশার রঙিন জগতে বসে চোখে স্বপ্নের ঘোর লাগিয়ে যতই কল্পনা কর, বাস্তব বদলাবে না। নিজের ভিতরের বৃদ্ধত্ব, নেশাচ্ছন্নতা কাটালেই তবে সব কিছু প্রকৃত সুন্দর ও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। আমার মনে হয়, এবার সময় নিয়ে দেশে যাওয়া দরকার। নিজের ভেতরটাকে আর দেশের ও মানুষের ভেতরটাকে গভীর ও তুলনামূলকভাবে দেখার জন্য। কত কিছুই তো দেখছি? নিজেকে দেখছি কি? নিজের স্বদেশ- তা-ও অজানা ভূগোল হয়েই রয়েছে।

গত বারো বছরে আমি একেবারেই যে নিজের দেশে যাই নি, সেটা বলা যাবে না। সে যাওয়া রুটিনবদ্ধ, গতানুগতিক। পনের-বিশ দিনের টানা প্রোগ্রাম। কিছু বেড়ানো। কিছু খোঁজ-খবর করা। খানিকটা বিশ্রাম নেওয়া। আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণে গিয়ে দাওয়াত খাওয়া। তারপর ছুটির শেষে ছুটে চলে আসা। খুবই উপরতলার ভ্রমণ। আলগা। সুপারফিসিয়াল। হ্যালো-হাই মার্কা মেকি। গভীরভাবে মেশা হয় না, দেখা হয় না, জানা হয় না। কমপক্ষে ছ’মাসের জন্য যেতে হবে এবার। আলাদা বাসা নিয়ে থাকতে হবে। নিজের মতো করে মনের ভেতরের ভাবনাগুলোর উত্তর জানতে হবে। মার্গারেট যা বলেছে, সেটা জানতে মানুষের গহীনে ডুব দিতে হবে।

নীল উড়াল: দ্বিতীয় পর্ব

এ যাবত আমার দেশে যাওয়া আনুষ্ঠানিকতার বাইরে আসতে পারে নি। দেশে যাওয়া মানে আমার জন্য ঢাকা এবং কলকাতা যাওয়া। আমার শেকড়টি বড় অদ্ভুত। নদীর শাখা মেলে দেওয়ার মতো। কিছুটা এগিয়ে ডানে-বায়ে ভাগ হয়ে ঢাকা আর কলকাতার দিকে চলে গেছে। আমার বংশচক্র ছড়িয়ে আছে দু’ জায়গাতেই।

ঢাকায় বড় বেশি আদরে-আহ্লাদে সময় কাটে। খাওয়ার চাপটা খুবই মর্মান্তিক। আপ্যায়নের হ্যাপা সামলাতেই সিংহভাগ সময় চলে যায়। আমার যাওয়াটা সাধারণত ঈদ-উৎসবকে কেন্দ্র করেই হয়। পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে দিয়ে আমি তখন আলাদা থাকতে চেষ্টা করি। ঈদের দিন নামাজ শেষে কখনও ঘুমিয়ে, কখনও লিখে বা পড়ে সময় কাটাই। ক্রমশ উৎসবের লক্ষ্যকে ছাপিয়ে উপলক্ষ্যই প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে দেখে আমার ভালো লাগে না। বড় বেশি যান্ত্রিক ও প্রদর্শনমুখী হয়ে যাচ্ছে সব কিছু। দুঃখ পেলেও কিছু করার নেই। সামাজিক অনুষ্ঠানে দশজনের দশ মত মিশে অদ্ভুত আকার ধারণ করছে।

ঢাকার তুলনায় কলকাতার যন্ত্রণা অন্য রকম; সেটা আরও তীব্র। আমার যাওয়ার সময়টাতেই কিভাবে যেন পূজা এসে হাজির হয়। সেখানে পূজা এখন কেবল ধর্মীয় উৎসব মাত্র নয়। সব ধরনের সুযোগ সন্ধানীদের মওসুম। বাণিজ্যিক সুবিধা, বিজ্ঞাপন, বিপণন ইত্যাকার ফায়দা আদায়ের জন্য মনে হয় পূজার অপেক্ষায় মুখিয়ে থাকে ধান্ধাবাজ লোকজন। ব্রিটিশরা চলে গেলেও তাদের এই প্রাচীন রাজধানী থেকে বেনিয়াদের সার্থক উত্তর-সাধকরা যায় নি। আরও গাট্টা হয়ে বসে গেছে। ইচ্ছে করেই আমি পূজায় কলকাতা যাই না অনেক বছর। ইচ্ছে করেই। কলকাতার কিছু স্মৃতি না হয় থাকল অমলিন! পূজা তো এখন বারোয়ারি হয়ে গেছে।

পুরস্কারের উচ্চনাদ, ধাক্কাধাক্কি, ভিড়, এক হাতে ঘামে ভেজা রুমাল, অন্য হাতে এগরোল, লাউডস্পিকারের অহেতুক ঘোষণা। এতকিছুর পর দুর্গা প্রতিমার সঙ্গে প্রতি প্যান্ডেলে সাক্ষাত সাকুল্যে দু’মিনিটেরও বেশি আদায় করতে পারছে না বাঙালি হিন্দুরা।

অথচ আমার ছেলেবেলার কলকাতার পূজা ছিল বড়ই আনন্দের। আমাদের জন্য যত না পূজা, তারচেয়ে বেশি মার্কেটিং-এর মজা। পাশের হিন্দু প্রতিবেশীদের দেখেছি, মহালয়ার সকালে একটু হিম থাকতে বাতাসে ভেসে আসা মারফি রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের উদাত্ত গলার সঙ্গে একাকার হয়ে যেতো। ঘুমচোখে নীচে নেমে দেখতাম বাড়ির লাগোয়া শিউলি গাছের তলায় শেষরাতের তারা ভরা আকাশের মতো এক রাশ নরম সাদা ফুল ভেজা মাটিতে মুখ গুঁজে পৃথিবীর ঘ্রাণ নিচ্ছে। ওদের কোমল বোঁটায় টলটল করছে শিশিরের ফোঁটা। হিন্দু বালক-বালিকাদের ফ্রকের কোঁচড় ভরে যেত এক আশ্চর্য ফুলের আলোয় ও গন্ধে। ততক্ষণে রেডিওতে আগমনী শুরু হয়ে যেত। বাজছে গান: “যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী, উমা আমার কেমন রয়েছে” শুনে কেন জানি আমার কোনোদিন না দেখা আঠাশ বছর বয়সে অকালপ্রয়াত পাশের হিন্দু বাড়ির মাসিমার জন্য একরাশ কষ্ট বুকের মধ্যে মোচড় দিত। আহা, জীবনে কত সাধ অপূর্ণ থেকে গেছে তাঁর। তাঁর কি মা ছিল? বিষাদের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ বোধহয় এই ভাবেই, শৈশবের কলকাতার পূজার কোনও এক আনন্দের মহালয়ার ভোরে।

কলকাতায় পূজা তখন এ রকম দু’সপ্তাহব্যাপী এলাহি ব্যাপার ছিল না। পূজা হত সপ্তমী থেকে নবমী, দিন মেপে। দশমীর দিন যোধপুর পার্ক আর সেলিমপুরের মাঝ বরাবর বড় রাস্তায় দাঁড়াতাম গিয়ে, হিন্দুদের বিসর্জনের ঠাকুর দেখতে। এখন দিন বদলেছে। মাটি ঠিই আছে, মানুষ বদলে গেছে। ‘  দেখেছি, পূর্ববঙ্গ থেকে আসা রিফিউজিরা একচিলতে জমিতে বাঁশের খুঁটি বেঁধে, সামিয়ানা খাটিয়ে পূজা দিচ্ছে। আরও পরে গিয়ে দেখেছি, সেখানে রাস্তার উপর থেকেই সটান একটা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে। আমাদের নানাভাইদের পাড়ার পূজা এখন পুরস্কার বিজয়ী নব্যকুলীন। পুরনো দিনের সেই সাদামাটা দিনগুলো আর পাশাপাশি বাস করা হিন্দু-মুসলমান সমাজ মিলিয়ে গেছে রাজনীতির নদীতে জলছবির মতো; হারিয়ে গেছে ইতিহাসের অজানা গন্তব্যে।

বিস্মৃতির কুয়াশা-ভেজা মাঠে মিলিয়ে গিয়েছে আরও অনেক কিছুই। গলির শেষে একটা খাটাল ছিল। ভোরে হিন্দুস্তানি গোয়ালারা প্লাস্টিকের জুতোয় খটাখট শব্দ তুলে হাতে লোহার বালতিতে খড় চাপা দুধ নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেত। হরিণঘাটা অনেকদিন চালু হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আমরা তখনও মাঝে মাঝেই দুধ রাখতাম পুরনো লোক হরিমতির কাছ থেকে। স্টিলের কাপে পোয়া মেপে ফেনা তোলা দুধ ‘পাস্তুরাইজেশন’-এর তোয়াক্কা না করে বাধাঁনো উনুনে, গুলের আগুনে, লোহার কড়াইতে জ্বাল দিয়ে দিব্যি খেত সবাই। একটু পরে যেত ফুলঝাড়ুওয়ালা: “ফুলঝাড়ু...” হাঁক দিয়ে। বর্ষাকালে আবর্জনা আর ভেজা কংক্রিটের গন্ধের সঙ্গে মিশে যেত চাঁপা আর মাধবীলতার সুবাস। জমা জলে ছপছপ করে “মাছ লাগবে নাকি মাছ... ভাল তোপসে, মৌরলা, ইলিশ আছে বাবু” বলে চলে যেত মাছওয়ালা। কালীপূজার আগেই এসে যেত ধুনকরের দল। তুলো ধুনবার জন্য হাতে থাকত বিশাল ধনুকের মতো যন্ত্র। আমার হিন্দু বন্ধুরা কল্পনা করে বলত, যেন রাম এসেছে বনবাস থেকে, বা মহারাজ দুষ্মন্ত। আর ছিল আমাদের সবার ‘লং ক্লথ’ দাদু। লং ক্লথ বিক্রি করতেন শীর্ণকায় ওই খর্বাকৃতি বৃদ্ধ। কাঁধে করে সাদা কাপড়ের থান নিয়ে ঘুরতেন, আর বাচ্চাদের আবদারে গান করতেন, ঘুরে ঘুরে গলা খাঁকারি দিয়ে, প্রত্যেক লাইনের শেষে বলতেন, “হুম। ” বিক্রি কী হত কে জানে! অবশ্য তখন তো সাউথ সিটি বা সিটি সেন্টার ছিল না। একই ছিটের কাপড় কিনে পরম যত্নে আমাদের ভাই-বোনের জামা বানিয়ে দিত ছোটখালা।

কলকাতার বর্ষা কোনও দিন পছন্দ ছিল না আমার। কারণ অনেক। বাসে করে বাইরে বেড়াতে যেতাম। রেইনকোটের ভিতরে ঘেমে উঠেছি, সামনে যিনি দাঁড়িয়ে তাঁর ছাতার থেকে বৃষ্টি-ভেজা জল-পানি ঝরছে আমার জুতায়, নর্দমা উপছে যত রাজ্যের নোংরা ভেসে চলেছে, বাস  থেকে নামতেই একটা গাড়ি আপাদমস্তক ভিজিয়ে নোংরা জল ছিটিয়ে চলে গেল, কোথাও গিয়ে ভেজা জুতা-মোজা খুলে বসেছি, ভিজে শার্টে পিঠ সেঁটে আছে, এই আমার বর্ষার স্মৃতি। এই কষ্টের জন্যেই বোধ হয়, রবি ঠাকুরের বর্ষার গান ভাল লাগতে অনেক দিন লেগেছে আমার। স্মৃতির একেবারে গোড়ায়, স্বপ্নের মতো মনে পড়ে এক সন্ধ্যার কথা, বাইরে অবিরাম জল ঝরছে, লোডশেডিং, জোলো হাওয়ায় মোমবাতির আলো কাঁপছে, বিচিত্র ছায়ার খেলা দেওয়ালে, রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁকছ্যোঁক আওয়াজ আসছে, ব্যাঙের ডাক অবিশ্রান্ত। সেই জমাট অন্ধকারে বর্ষার শব্দে কোলাহলহীন কলকাতা ছিল রূপকথার রাজ্য। আর ঢাকাকে মনে হত অনেক বেশি বাস্তব আর আধুনিক। ঢাকায় থাকলে কলকাতার কথা মনে পড়ত। কলকাতায় থাকলে ঢাকার। মন তখন অসীমান্তিক; স্বপ্নের মতো নগরে নগরে ঘুরছে।

শীতের মুখে যখন কলকাতা গিয়েছি, কালীপূজার উৎসবে পড়েছি। পাশের হিন্দু বাড়ির ছোটজেঠু বাজার থেকে নিয়ে আসত ছোট-বড় সাইজের চল্লিশ-পঞ্চাশটা তুবড়ির খোল, তাদের জলে ভিজিয়ে শুকানো হত দু’দিন ধরে। সোরা-গন্ধক-কাঠকয়লা হামানদিস্তায় গুঁড়ো করে কাপড়ে ছাঁকা হত। তাতে মেশানো হত অ্যালুমিনিয়াম আর তামার গুঁড়ো। কালীপূজার দিন সারা দুপুর আমরা সবাই মিলে চিলেকোঠায় জড়ো হয়ে খোলে মশলা ভরতাম। প্রথমে মশলা, তার পর বালি, শেষে মাটি দিয়ে খোলের মুখ বন্ধ করতে হত। সে এক দারুণ উত্তেজনা! এক একটা তুবড়ি উঠত ন’দশ হাত উঁচু হয়ে, জ্বলতো অনেকক্ষণ, এখনকার বাজারি তুবড়ি তার কাছেই লাগে না!

কলকাতার শীত আমার কাছে সব চাইতে মধুর। সে দিনও, আজও। কী বিশাল ছিল নীল আকাশটা। সকালের নরম রোদ গায়ে মেখে এক ঝাঁক পায়রা উড়ে যেত দিগন্তের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। আবার আকাশের শেষ সীমানা থেকে ডানায় ঝিলিক তুলে ফিরে আসত আমার পৃথিবীতে। ষুদ্ধপ্রান্তরের মতো বিশাল নানাবাড়ির বড় ছাদটার পাঁচিল ঘেঁষে ছিল গাঁদা, জিনিয়া, দোপাটি। পড়ন্ত দুপুরে কমলালেবু আর গল্পের বই হাতে উঠে যেতাম চিলেকোঠার ছাদে। চিত হয়ে শুয়ে চেয়ে দেখতাম আকাশটাকে। আমার আর আকাশের মধ্যে কিচ্ছুটি নেই। অনন্তের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়; আদি মিতালী। অনেক উঁচুতে ভ্রাম্যমাণ বিন্দুর মতো একটা একাকী ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে সেই আমার প্রথম উত্তর খোঁজা: জীবন কী, মৃত্যু কী, কোথায় শুরু, কোথায় শেষ। হঠাৎ বড় হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া। মাঝে মাঝে একটা প্লেন ক্ষীণ বাষ্পরেখা টেনে চলে যেত পূর্ব-উত্তরে, দমদম বিমানবন্দরের দিকে। কোন এক জগতের লোকেদের নিয়ে, যাদের সঙ্গে আমার কোনও পরিচয় নেই, যারা জানে না একটা ছোট্ট শিশু তাদের দিকেই চেয়ে আছে! ভেবে শিহরিত হতাম। বইমেলা, চিড়িয়াখানা, পিকনিক, ঝুপ করে নামা সন্ধেতে বন্ধ ঘরে কুয়াশার আল্পনা। সঙ্গে বেগন স্প্রে-র গন্ধ, লেপের সঘন আলিঙ্গনে দূর থেকে ভেসে আসা গানের রেশ আর ঢাকুরিয়া রেল লাইনে ট্রেনের হুইসেল, মশারির গায়ে পেটমোটা মশাদের দল, পাশে মায়ের মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দ। পরম আশ্বাসের মতো। আমার সমস্ত বয়সি ভাল লাগা, ভালোবাসা এবং বেদনা ধরা আছে কিছুটা কলকাতার আর কিছুটা ঢাকার কত শীতের দুপুরে ও রাতে।

স্মৃতির শহর কি কেউ কখনও ছেড়ে যায়? না যাওয়া যায়? কানাডার জানুয়ারি মাসের উড়ে যাওয়া বরফ কুচির দিকে চেয়ে কত দিন ঢাকার জমাট জীবন বা কলকাতার কালবৈশাখীর কথা মনে করেছি। বুকের মধ্যে বসত করে নিজের শহর। যে শহরে বাস করি সে আমার নয়। আমার শহর আমার মনে। পুরনো প্রেমিকের মতো তার সব দোষ চেনা, ভাল লাগা আলগা হয়ে গিয়েছে যোগাযোগহীনতায়। তবু যখন দূরে থাকি, যতই দূরে থাকি, তখন রাতে বালিশে মুখ লুকিয়ে প্রণয়ীর সাথে কথা বলাবলির মতো বলি, “আমার শহর, ভালবাসি, বোঝ না?”

অনেক বছর পর আবার গভীরভাবে নিজের শহরে ফেরার আবেগে স্মৃতি ও নস্টালজিয়া আমাকে প্রবলভাবে ঘিরে ধরে। এর নাম কি নেশা? ভালোবাসা? টান? এমন অখণ্ড ভালোবাসার নেশাময় টানকে দূরে রেখে মানুষ কি করে অন্য সব নেশার কাছে যেতে পারে? কে জানে! (চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।