ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নজরুল-স্মরণ

কোমলে-কঠিনে দ্রোহ ও মানবতার কবি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৭
কোমলে-কঠিনে দ্রোহ ও মানবতার কবি কোমলে-কঠিনে দ্রোহ ও মানবতার কবি

২৭ আগস্ট ২০১৭ (১২ ভাদ্র ১৪২৪ বঙ্গাব্দ) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের এ দিনে বাংলা সাহিত্যের চিরঞ্জীব কবি কাজী নজরুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেন। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব। মৌলিক কাব্য-প্রতিভার ছাপ রেখে গেছেন বলেই এখনও তিনি যুগ-প্রবর্তক কবি হিসেবে স্বীকৃত । 

‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে …। ’ এমন হাজারো অমর পঙক্তি সৃষ্টির মহানায়ক মানবতা ও সাম্যের কবি, বিংশ শতাব্দীর অগ্রগণ্য কবি আর গানের বুলবুল কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মান্ধতা, ফ্যাসিবাদ, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, অনাচার, বৈষম্য, শোষণ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে অগ্নিকণ্ঠে সোচ্চার নজরুল আমাদের 'জাতীয় কবি'।

জাতীয় সংকট, স্বপ্ন আর সংগ্রামে নজরুল জাতির আপনজন ও সামনে এগোনোর পাথেয়। দ্রোহে ও প্রেমে, কোমলে-কঠোরে বাংলা কাব্য ও সংগীতে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছিলেন তিনি তার অনন্য প্রতিভায়। অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কবি ‘চির উন্নত মম শির’ বলে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। যৌবনের প্রাণবন্যায় নজরুল বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতাকে আপ্লুত ও গৌরবদীপ্ত করে তুলেছিলেন। বাংলাভাষাকে তিনি উন্নীত করেছিলেন বেগবান ও পৌরুষদীপ্ত মহিমায়।
 
বাংলাসাহিত্যে ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে পরিচিত হলেও নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি অসাধারণ এক প্রাণশক্তিতে নতুন দ্যোতনায়, শৈল্পিক উৎকর্ষে বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে অতুলনীয় ঐশ্বর্য ও সম্পদে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনিই সর্বপ্রথম বাঙালি-কলমসৈনিক যিনি দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, 'কারার ঐ লোহ কপাট/ভেঙে ফেল কর রে লোপাট/রক্ত জমাট/শিকল পূজায় পাষাণ বেদী/ওরে ও তরুণ ঈশান/বাজা তোর প্রলয় বিষাণ/ধ্বংস নিশান/উড়ুক প্রাচীর/প্রাচীর ভেদি'। তিনিই পরাধীনতার শিকল ভেঙে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন জাতিকে।  

তার জাগরণী ও বিদ্রোহী কবিতা, 'লাথি মার ভাঙরে তালা/যত সব বন্দী-শালায়/আগুন জ্বালা ফেল উপাড়ি'। 'এই শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল/এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল'। 'মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হবো শান্ত…' এমন সাহসী কাব্য লেখনীর মাধ্যমে এ দেশবাসীকে জাগিয়েছেন। পরাধীনতা, শোষণের কবল থেকে জাতিকে প্রথম স্বাধীন হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন কবি নজরুল। তিনি প্রত্যয়ী ও বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছেন, জাগ্রত করেছেন জাতীয়তাবোধ।

ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশের কারণে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। গোলামির জিঞ্জির পরিয়েও তাকে আপস করাতে পারেনি প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্র। এই মহান পুরুষ ব্রিটিশ শাসকদের কাছে মাথা নত করেননি। পরাধীনতার নিগড় থেকে বের হয়ে আসার জন্য আগুনঝরা কবিতা এবং গানের মধ্য দিয়ে আজীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি। বাঙালির নবজাগরণ এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণার উৎস ছিল তার গান ও কবিতা। যে কারণে ‘বিদ্রোহী কবি’ আমাদের 'জাতীয় কবি'তে পরিণত হয়েছেন।

১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এরপর থেকে কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। বাংলাসাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি লিট ডিগ্রি দেয়। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে ‘একুশে পদক’ দেওয়া হয়। ১৯৭৬ সালে কবির স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে। যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও তার স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়নি। তার জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে পিজি হাসপাতালে।

বিদ্রোহী কবি তার একটি গানে লিখেছেন, ‘মসজিদেরই কাছে আমায় কবর দিও ভাই/ যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই’। কবির এই ইচ্ছা বিবেচনা করে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।

কবি নজরুলের কবিতা ও গান-গজল আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির চিরসম্পদ। তার দেশাত্মবোধক কবিতাগুলো লাখ লাখ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং অনুপ্রাণিত করেছে বীরত্বপূর্ণ ও নিঃস্বার্থ কাজে আত্মনিয়োগ করতে।

জাতীয় কবির বিদায়দিনে তার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।