ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

দ্য প্রফেট : আত্মা ও হৃদয় জাগরণের পঙক্তিমালা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৭
দ্য প্রফেট : আত্মা ও হৃদয় জাগরণের পঙক্তিমালা দ্য প্রফেট : আত্মা ও হৃদয় জাগরণের পঙক্তিমালা

দ্য প্রফেট
লেখক: কাহলিল জিবরান
পাঠপ্রতিক্রিয়া: শতাব্দী জুবায়ের

 

ক্ল্যাসিক বই ‘দ্য প্রফেট’ এর লেখক কাহলিল জিবরান। তার প্রকৃত নাম ছিলো, জিবরান খলিল জিবরান বিন মিখাইল সাদ।

তিনি ছিলেন একাধারে কবি, দার্শনিক, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক ও চিত্রশিল্পী। ১৮০৩ সালে লেবাননের ম্যারোনাইট খ্রিস্টান পরিবারে তিনি জন্ম নেন। মূলত তিনি কবি হিসেবেই পরিচিত লাভ করেন। তাকে বলা হয় লেবাননের জাতীয় কবি।
 
আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ যেমন, লেবানন বা সিরিয়াবাসীদের কাছে কাহলিল জিবরানও তেমন। আবার রবীন্দ্রনাথ যেমন কেবল আমাদের নন সমগ্র বিশ্বের, জিবরানও তাই। তিনি একজন প্রথাবিরোধী লেখক ছিলেন। ধর্মীয় ভন্ডামি, কুসংস্কারের বিরোধিতায় তিনি ছিলেন অপ্রতিরোদ্ধ।

তার কবিতা যেনো উঠে এসছে পর্বতের উচ্চতা, সমুদ্রের নাভীমূল, কখনও দেবকণ্ঠ থেকে। তিনি তার কবিতায় তুলে ধরেছেন সুফিবাদ, দর্শন, আরব রোমান্টিক ও প্রতীকবাদী কবিদের প্রাচীন ঐতিহ্য। এক অনির্বচনীয় আনন্দ ও অভিজ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় তার কাব্যগ্রন্থগুলোতে। দ্য প্রফেট তেমনি একটা কবিতাগ্রন্থ। কিংবা বলা যায়, অনেকগুলো কবিতা-ফুল দিয়ে গাঁথা মালার মতো। তবে এই বইটি মূলত উপদেশমূলক একটি গ্রন্থ। যেখানে একজন প্রফেট বা প্রেরিত পুরুষ অর্ফালিজ নগরীতে দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন শেষে তার জন্মের দ্বীপে ফিরে যাওয়ার আগে নগরীর মানুষদের বিভিন্ন উপদেশ দিয়েছিলেন। এই উপদেশগুলোই স্থান পেয়েছে দ্য প্রফেটে। এতে তিনি ‘জীবন ও মৃত্যুর’ মধ্যস্থিত বিষয় সম্পর্কে সমবেত জ্ঞানার্থীদের উপদেশ দেন এবং এই প্রতিশ্রতি নেন যে, তারা যেনো তা অন্তরে ধারণ ও এর বিনাশ না করে।

এই বিখ্যাত বইটি মূলত শুরু হয় সত্য বলা প্রফেট বা সন্তের অর্ফালিজ নগরী থেকে বিদায়ের দিনে এবং শেষ হয় তার নগরটি ছেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। এর মধ্যেই তিনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষদের নানা বিষয়ে তার ভাবনা-চিন্তার ব্যাখ্যা জানান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- ধর্ম, মৃত্যু, ভালোবাসা, বিবাহ, দান, সন্তান, গৃহ, অপরাধ ও শাস্তি, শিক্ষাদান, ক্রয়-বিক্রয়, আইন, যুক্তি ও আবেগ, বন্ধু, প্রার্থনা প্রভৃতি।

দ্য প্রফেট বইটি এতো জনপ্রিয় কেন তা নিয়ে নানা গুঞ্জন রয়েছে। তবে জিবরান বাইবেলের ভাষার ব্যঞ্জনায় আধুনিক মানুষের চিত্তের অসুখের নিরাময় করতে চেয়েছেন এই কাব্য গ্রন্থের মাধ্যমে। আধ্যাত্মিক চিন্তায় সমৃদ্ধ তার জগৎ ভাবনায় মানুষের নানা বিষয়ের সংকটের সমাধান রয়েছে। এসব সমাধান আসলে মানুষ নিজেই খুঁজে নিতে পারে। দ্য প্রফেট পড়ে একজন মানুষ নিজেই নিজেকে সাহায্য করতে পারবে। এই সাহায্য শুধু আত্মা ও হৃদয় জাগরণে ভূমিকা রাখে। জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণের মধ্যে রয়েছে- মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন ভূগোল, জলবায়ু, নির্সগ, বৃক্ষ-প্রান্তর ইত্যাদির সুন্দর সাবলীল বর্ণনা। তার চেয়ে বড় কথা এর মধ্যে রয়েছে জীবনের ঘোর বাস্তবতার উপদেশ। যেগুলো একজন মানুষকে জীবনের চলার পথে প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে।

বাস্তব জীবনে দেখা যায়, আমরা একটু নির্ভশীলতার সুযোগ পেলেই হাল ছেড়ে দেই। অন্যের উপর সঁপে দেই নিজের সবকিছু। তিনি যে বাস্তববাদী কবি ছিলেন তারই একটি প্রমাণ পাওয়া যায় নিচের উদ্ধৃতিতে। ‘বিবাহ’ নামক কবিতায় তিনি বলেন, ‘তোমরা তোমাদের হৃদয় বিনিময় করো কিন্তু একে অপরের হাতে সপেঁ দিও না’।

প্রতিনিয়তই মানুষ একজনের দর্শন দ্বারা অন্যজনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এমনকি পরিবারও তার বাইরে নয়। বাবা তার চিন্তা-ভাবনা সন্তানদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু জিবরান বলেছের ভিন্নকথা, ‘সন্তানদের তোমরা ভালোবাসা দিতে পারো কিন্তু তোমাদের ভাবনা তাদের দিতে পারো না। কারণ তাদেরও নিজস্ব ভাবনা রয়েছে’।

দান কবিতায় তিনি ধন-সম্পদ দানের চেয়ে নিজের আত্মাদান করাকে উত্তম দান বলেছেন। কারণ, মানুষ যখন ধন-সম্পদ গরিব-দুস্থদের মাঝে দান করে সেটা মহত্ব অল্প সময় থাকে। কিন্তু একজন মানুষ যখন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য নিজের জীবন দিয়ে দেন তখন তিনি চির অমর হয়ে থাকেন। আর এই বেঁচে থাকাটাই আসলে প্রকৃত বাঁচা। তাইতো তিনি বলেছেন, ‘তুমি যখন ধন-সম্পদ দান করো সেই দান এক ক্ষুদ্র দান, কিন্তু যখন আত্মদান করো সে দানই আসল দান’।
 
কতো আগেই জিবরান বাস্তব জীবনের কথা বলে গিয়েছেন। বর্তমান সময়ে দানের বিষয়টি হয়ে গেছে আত্মপ্রচারের মাধ্যম। সবাই আত্মপ্রচার চাই। আমি এটা, ওটা দান করছি সেটা মানুষ জানুক। আমার দানের বিষয়টি সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক এটা সবাই চাই। এই চাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছেন কবি। কারণ, এরকম প্রত্যাশা দানকে কলুষিত করে।  

তিনি বলেন, ‘যারা অন্তরের আত্মপ্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে দান করে তাদের গোপন বাসনা তাদের দানকে কলুষিত করে’।

আমরা কর্ম করতে চাই না। কাজের প্রতি ভালোবাসা নেই বললেই চলে। কিন্তু কর্মের সুফল ভোগ করতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আবার আমরা জ্ঞান অর্জন করি কিন্তু তা বাস্তব জীবনে কাজে লাগাই না অর্থাৎ প্রায়োগিক দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে আছি আমরা।
 
তাই তো তিনি বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করো এবং তার প্রয়োগ ঘটাও কারণ, কর্মহীন যতো জ্ঞান সবই বৃথা’।

একজন মানুষ যে কাজই করুক না কেন সে যেনো তার কাজকে ভালোবেসে করে। তিনি বলেছেন, ‘ভালোবেসে কাজ করাটা হচ্ছে তোমার হৃদয় থেকে সুতা বের করে কাপড় বোনা। যেনো তোমার প্রিয়তমা পরবে সে কাপড়’।
 
কাজের প্রতি অবহেলা আমাদের রয়েছেই, যার কারণে আমাদের কাজ শেষে ভালো ফলাফল পাই না। তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেছেন, অযত্নে রুটি সেঁক দিলে সে রুটি পুড়বেই।

মানুষ পোশাক পরে লজ্জা নিবারণ করার জন্য। কটু দৃষ্টি প্রতিহত করার জন্য। অশালীনতা থেকে বিরত থাকার জন্য। কিন্তু মাঝে মধ্যে রাস্তাঘাটে এর বিপরীত দৃশ্যও লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেছেন, ‘পোশাক হচ্ছে অসচ্চরিত্র মানুষের দৃষ্টি প্রতিহত করার একমাত্র ঢাল’।

জিবরান তার প্রফেট কাব্যগ্রন্থে পুঁজিবাদেরও বিরোধিতা করেছেন। ব্যবসায়ীরা যারা সস্তা দামে পণ্য কিনে করে চড়া দামে বিক্রি করে তাদের এসব থেকে বিরত থাকার আহ্বান করেছেন। তিনি ক্রয়-বিক্রয়ের সুবিচার করার কথা বলেছেন। যদি না করা হয় তাহলে এক শ্রেণীর মানুষ হবে লোভে উন্মত্ত এবং অন্যরা হবে অভুক্ত। বাস্তব জীবনে আমরা এখন তাই দেখতে পাচ্ছি।

আইন ও বিচার ব্যবস্থা নিয়ে তিনি দারুণ কথা বলেছে। তিনি বলেছেন, আইন যেনো বালির স্মৃতি সৌধ না হয়ে যায়। যে আইন করা হবে সেটা হবে সবার জন্য সমান এবং প্রযোজ্য। সূর্যকে পেছনে ফিরে তাকালে যে ছায়া দেখা যায় তাই হচ্ছে আইন।

প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে যুক্তি এবং আবেগ থাকা দরকার। আবেগ দিয়ে যেনো যুক্তিকে না ভাঙা হয় বরং যুক্তি দিয়ে আবেগকে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। কারণ, আবেগ হচ্ছে একটি জাহাজের ‘পাল’ আর যুক্তি হচ্ছে জাহাজের ‘হাল’। আবার আবেগ মানুষের হৃদয়ে অগ্নি শিখার মতো কাজ করে। তিনি বলেছেন, ‘আবেগ হচ্ছে এমন এক অগ্নিশিখা যে জ্বলে পুড়ে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়’।

বন্ধু নির্বাচনে নানা সময় আমরা ভুল করি। বন্ধু এমন মানুষকে নির্বাচন করতে হবে যাকে সবসময় পাশে পাওয়া যায়। ‘সেই তোমার বন্ধু যার কাছে তুমি গেলে শান্তি পাও’।

কবি জিবরান এতো চমৎকার চমৎকার কথা বলে গেছেন যেগুলো আমরা বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারি। উপকৃত হতে পারি আমি, আপনি, আমরা। কারণ, এই কাব্যগ্রন্থের প্রত্যেকটি লাইনই মানব জীবনের কোননো না মুহূর্তের সঙ্গে জড়িত। আর এই সব উপদেশ দিয়ে একজন মানুষ জীবনে উন্নতিসহ সত্যিকারের মানুষ হিসেবে নিজে আবিষ্কার করতে পারে।

নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত কবির খুব ইচ্ছা ছিলো, জীবিত অবস্তায় দেশে ফেরার। কিন্তু তিনি জীবিত ফিরতে পারেননি। ১৯৩১ সালে ১০ এপ্রিল তার জীবনাবসান হয়। মৃত্যুর পরে তাকে দেশে আনা হয়। সেদিন বৈরুত সমুদ্র বন্দরে হাজার হাজার অশ্রুসিক্ত মানুষ তাকে বরণ করে নেয়।  

তিনি দেশ ছাড়ার আগে বলেছিলেন, ‘Forget not that I shall come back to you’। তিনি কথা রেখেছিলেন। তিনি দেশে ফিরে এসছিলেন বীরের বেশে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৭
এসএনএস 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।