ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কাজুয়ো ইশিগুরো: আবেগের গহীনে অবগাহন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৬, ২০১৭
কাজুয়ো ইশিগুরো: আবেগের গহীনে অবগাহন কাজুও ইশিগুরো

জাপানিজ সাহিত্য থেকে কাউকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার জন্য বাছাই করতে হলে সবচেয়ে আগে হারুকি মুরাকামির নাম উত্থাপিত হওয়ার কথা। নিজ দেশে তো বটেই, সমগ্র বিশ্বে মুরাকামি প্রবল জনপ্রিয় ব্যাপক অনুবাদের কারণে। প্রতি বছরই তিনি সম্ভাব্যদের তালিকায় থাকেন আরও অনেকের সঙ্গে। কিন্তু ২০১৭ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার তিনি পাননি, পেয়েছে তারই স্বদেশী একজন, যার নাম স্বদেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই, পণ্ডিতরাও বলতে গেলে জানেন না।

কাজুয়ো ইশিগুরো নামের একজন জাপানিজ বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকের নাম যখন এ বছর নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের জন্য ঘোষিত হলো, তখন সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হন জাপানিরা। ইশিগুরোর জন্ম শহর পারমাণবিক বোমা-বিক্ষত নাগাসাকির কেউই বলতে গেলে তাকে চিনতে পারেননি।

সাধারণ মানুষ দূরঅস্ত, জাপানের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যের পণ্ডিতরা জানালেন যে, এই নামের কোনো লেখককে তারা চেনেন না; তার কোনো লেখা সম্পর্কেও তাদের ধারণা নেই। বিশ্বের অন্যত্রও কাজুও ইশিগুরো সম্পর্কে জানার পরিধিটি স্বাভাবিকভাবেই সীমিত। নোবেলের সম্ভাব্য তালিকাতেও তিনি বিশেষ আলোচিত কেউ ছিলেন না। হিসাবের বাইরে থেকে এসেই তিনি পুরস্কারটি জয় করেছেন।  

গত কয়েক বছর ধরেই নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার জল্পনা-কল্পনা যাদের ঘিরে তৈরি হয়, মহার্ঘ্য পুরস্কার তাদের ফাঁকি দিয়ে ফস্কে যাচ্ছে অন্যত্র। বোদ্ধারা বলে আসছিলেন যাদের নাম, পুরস্কার তারা পাচ্ছিলেন না। যেমন বেলারুশের সাহিত্যিক সভেতলানা অ্যালেক্সিভিচ (২০১৫) এবং পরবর্তীতে বব ডিলান (২০১৬) তেমনভাবেই পুরস্কার ছিনিয়ে নেন। এবার যেমন নিলেন ইশিগুরো।

২০১০ সালে দক্ষিণ আমেরিকার হিস্পানিক ভাষী কথাসাহিত্যিক মারিয়ো বার্গাস ইয়োসা পুরস্কার পাওয়ায় নোবেল পুরস্কার সেদিকে যাওয়ার সুযোগ পায়নি এ বছর। তারপর ফরাসিভাষী মোদিয়ানো পুরস্কৃত হওয়ায় ইউরোপ ও ফরাসিভাষী লেখকদের সুযোগও সীমিত হয়ে আসে। ইংরেজিতে লিখে কানাডার অ্যালিস মুনরোর  পুরস্কার প্রাপ্তিতে ইংরেজি ভাষা-অঞ্চল ও উত্তর আমেরিকার ক্ষেত্রটি বলা যায় সঙ্কুচিত ছিল। চীনের মো ইয়ান ২০১২ সালে পুরস্কৃত হয়ে নোবেলের এশীয়ায় আসার সম্ভাবনা আপাতত দমন করেছিলেন। যে কারণে বহুল আলোচিত হয়েও জাপানের হারুকি মুরাকামিকে অপেক্ষায় থাকতে হয়, যে অপেক্ষা এখনও চলছেই। এ পর্যায়ে ভাবা হয়েছিল, পরিস্থিতিগত বিবেচনায় নোবেল পুরস্কার হয়ত আফ্রিকায় গিয়ে পৌঁছাবে। এজন্য অবশ্য একজনের স্মৃতি জ্বলজ্বলভাবে কাজ করেছে, তিনি ২০১৩ পরলোকগত নাইজেরিয়ান ঔপন্যাসিক চিনুয়া আবেচে। মৃত্যুর আগে বছরের পর বছর তার নাম সম্ভাব্য পুরস্কার প্রাপ্তদের তালিকায় ছিল। এমন কি, তাকে মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়ারও দাবি উঠে, যদিও নোবেলের ক্ষেত্রে মৃত-প্রতিভাকে বিবেচনার সুযোগ নেই। দাবিটি অতীতে গান্ধীকে নিয়েও উঠেছিল। মারা যাওয়ায় তাকে পুরস্কৃত হরা যায়নি।  

ফলে নানা কারণে বহু বিখ্যাত প্রতিভা নোবেল বঞ্চিত হয়েছেন, যেমন, লিও টলস্টয়, আন্তন চেখভ, হোর্হে লুইস বোর্হেস, মার্সেল প্রুস্ত, বেটল্ট ব্রেখট, যোসেফ কনরাড, টমাস হার্ডি, ডব্লিউ এইচ অডেন, ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, হেনরিক ইবসেন, জেমস জয়েস, ফ্রানৎস কাফকা, ফার্নান্দো পেসোয়া, পল ভ্যালেরি, কার্লোস ফুয়েন্তেস। বলার অপেক্ষা রাখে না, পুরস্কারপ্রাপ্তদের তুলনায় অপ্রাপ্তদের তালিকাটিও কম উজ্জ্বল নয়। এখনো যারা নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পা নি, সে তালিকাটিও কম মহার্ঘ্য নয়: নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, ফিলিপ রথ, মিলান কুন্ডেরা, জয়েস ক্যারল ওটস, আদোনিস, গাদারে প্রমুখ। এসব মহাজনদের জ্বলজ্বলে তালিকাকে ম্লান করে প্রবল চমক সৃষ্টি করে আলোচনার বাইরে থেকে পুরস্কার ছিনিয়ে নিলেন ইশিগুরো।

এ কথা সত্য যে, দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের জেরে  আরবি, ফার্সি, ফরাসি, জার্মান ও রুশ সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদই সাধারণত আমরা পড়ি। পৃথিবীতে আরও কত ভাষা আছে, কোথাও মহৎ কিছু রচিত হলে ইংরেজি অনুবাদের দাক্ষিণ্য না পেলে তা আমাদের গোচরে আসে না। সেইজন্যই চীনের মতো এমন বিশাল ও ঐতিহ্যপূর্ণ দেশ কিংবা জাপানের মতো বাণিজ্য, শিল্প ও সংস্কৃতিতে এত উন্নত দেশের সাহিত্যসম্ভার সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানি। মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশগুলোর সাহিত্যকৃতি সম্পর্কে আমরা প্রায়-অজ্ঞই বলা যায়। তবে অকস্মাৎ এই দেশগুলোর কোনো একজন ‘নোবেল পুরস্কার’ পেলে তার লেখাগুলো পড়ার জন্য একটি বিশেষ ঝোঁক আসে। এ কারণেই চীনা উপন্যাস ‘সোল মাউন্টেন’ নোবেল পাওয়ার পর আমরা পড়েছি। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনা লেখকের প্রতি আন্তর্জাতিক আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হতে বিলম্ব হয় না চলমান বিশ্বায়নের যুগে।  

অথচ নোবেলের মানদণ্ডটিই যে সেরা বা আদর্শ স্থানীয়, তেমনটি হলফ করে বলা যাবে না। চীনের মতো বড় দেশের বিশাল সাহিত্য-ঐতিহ্য থেকে কোনো রচনাকে নোবেল পুরস্কারের জন্য বেছে নিতে একশ বছরেরও বেশি সময় লেগে গিয়েছিল! সে তুলনায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ছোট ছোট দেশগুলোতে নোবেল পুরস্কারের ছড়াছড়ি। এই হচ্ছে নোবেল পুরস্কারের মাপকাঠির নমুনা! 

একটি উদাহরণ দেয়া যায়। ব্রিটিশ নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টার জীবনের শেষ দিকে বহু আকাঙ্ক্ষিত নোবেল পুরস্কারটি পেলেন। পিন্টার তার উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো লিখেছেন বহু বছর আগে। এতদিন তাকে গ্রাহ্যই করা হয়নি। কিন্তু তিনি যখন নাটকের আঙ্গিকে ইরাক প্রসঙ্গে আমেরিকা ও ইংরেজ সরকারের কঠোর যুদ্ধবাজ নীতির তীব্র সমালোচনা করলেন, তখন তাকে বশে আনার দরকার হলো! ইরান ও তুরস্কের লেখকরা যখন ইসলাম ও মুসলমানদের সমালোচনা করেন, তখন তারা অজ্ঞাত হলেও নোবেল পুরস্কারের তালিকায় চলে আসেন। সে কারণে, বশীভূত করার ও দালালি/আনুগত্যের পুরস্কার দেওয়ার মতলব পুরস্কারের পেছনে রয়েছে কিনা, সে সন্দেহও বার বার উঁকি দিয়েছে নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের সময়।  

অতএব, বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম নোবেল পুরস্কারের মধ্যেও নিহিত রয়েছে নানা অসঙ্গতি। কিন্তু চাঁদের কলঙ্কের মতো নোবেল পুরস্কারে কিছু খুঁত থাকলেও এই সুইডিস প্রতিষ্ঠানটি কখনও কখনও বিশ্বের নিভৃতে লুকিয়ে থাকা বিশিষ্ট মেধাকে চিহ্ণিত ও পুরস্কৃত করার কৃতিত্বও দেখাতে সক্ষম হয়েছে। রাজনীতির নানা অন্ধি-সন্ধির কথা বিবেচনার পরেও এ কথা বলা যায়। সভেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ, এলিস মনরো বা ইশিগুরোকে এ কারণেই শুধু রাজনীতির মাপকাঠিতে পরিমাপ করলে ঠকতে হবে। রাজনীতি তার আশেপাশে অবশ্যই আছে; কিন্তু তাতে লেখকদের যোগ্যতা মিছে হয়ে যায় না।  

অতি সাম্প্রতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত সভেতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ বা বব ডিলানের ক্ষেত্রে একজন অ্যাকটিভিস্ট সাহিত্য চরিত্র হিসেবে তারা পুরস্কারের বিবেচনাকালে প্রাধান্য পেয়েছেন। যারা পূর্ণকালীন অভিনিবেশের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তৈরি করেন রচনা; অন্যরা যা লেখেননি বা এড়িয়ে গেছেন বা যেসব বিষয় ও চরিত্র গ্রাহ্য করেননি, সেসব কথা ও চরিত্রকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে এনেছেন যারা; তাদের রচনা প্রকৃতই ধারণ করে বহুস্বর, তাদেরই বিবেচনায় এনেছে নোবেল কমিটি। ফলে এ বছর মাত্র ৮টি বই লিখেই নোবেল পেয়েছেন ইশিগুরো নামের এমন একজন, যাকে আগে কেউ বিশেষভাবে চিনতোই না।

কাজুয়ো ইশিগুরো সাহিত্যের ময়দানে একেবারেই অজ্ঞাত পরিচয়, এমনটিও বলা যাবে না। অতি শৈশবে বিলেতে চলে এসে তিনি সেখানকার সমাজ ও সংস্কৃতিতেই বর্ধিত হয়েছেন। উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ব্রিটেনের উদীয়মান লেখকদের তালিকাকেও কখনো কখনো ছিলেন তিনি। তবে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি তিনি ধারণ করেছেন, তা হলো আইডেনটিটি বা পরিচিতির শক্তি। মোটেও তিনি জাপানিজ সত্ত্বাকে বিস্মৃত হননি। বরং স্বদেশ থেকে বহুদূরে অবস্থান করেও স্বদেশের সমাজ ও দর্শনকে ফুটিয়ে তোলার কাজ করে গেছেন, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তীব্র সঙ্কট ও পালাবদলের মানবিক-মননশীল ছাপ ধরা পড়েছে। ‘দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে’, ‘আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লোটিং ওয়াল্ড’, ‘দ্য আনকনসোল্ড’, ‘নেভার লেট মি গো’, ‘দ্য বারিড জায়ান্ট’ প্রভৃতি উপন্যাসে তিনি নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। সময় নিয়ে লেখা এই পেশাদার লেখক তার রচনায় গভীর গবেষণা ও বিশ্লেষণের ছাপ রেখেছেন। লেখার সময় তিনি চলে গেছেন নিভৃতে। যোগাযোগ বা ফোন ধরার কাজও বন্ধ রেখেছেন। নিবিষ্টতার শক্তিতে তিনি এক একটি রচনাকে উত্তীর্ণ করেছেন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে।  

আগের বছর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী সঙ্গীত শিল্পী বব ডিলান হলেন এ বছরের সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া কাজুয়ো ইশিগুরোর আইডল। সবুজ শৈশব থেকেই তিনি এই শিল্পীর ভক্ত এবং নিজেও সঙ্গীতের সঙ্গে সম্পৃক। সময় পেলে গান করেন, বাজনা বাজান। আর যে কাজটি তিনি করেন, সেটি হলো আবেগের গহীনে অবগাহন। নোবেল কমিটিও তার এই গুণটিকে সামনে এনেছে পুরস্কারের জন্য বিবেচনাকালে। বিশেষত একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের যুগে অতি-যান্ত্রিকীকরণ ও অতি-বাণিজ্যায়নের ফলে মানুষের আবেগের স্তরটি হয় ভোঁতা, নয় মৃত। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশের সম্পর্কটিও মুছে যাচ্ছে ক্রমশঃ। মানুষ এক আধুনিক রূপকথার সাইবার ফ্যান্টাসির যুগে বসবাস করছে। এমন সঙ্কুল সময়ে, মানুষের অন্তর্গত সম্পদ তথা আবেগের জায়গাটিকে ধারণ করা এবং মানুষের সঙ্গে জগতের সম্পর্কটিকে পুনর্নির্মাণের প্রয়াস নেওয়া একজন সাহিতিকের জন্য বৈপ্লবিক কাজ। তিনি গতানুগতিক উত্তর বা অতি-আধুনিক জায়গাটি থেকে সরে মানুষের মনের গভীর-গহীন প্রদেশে চলে গেছেন; শরীর ও ভোগের অতলে আবেগের সমুদ্রটিকে পুনঃখনন করেছেন এবং প্রকৃতির অমৃত সন্তান মানুষকে প্রকৃতি ও প্রতিবেশের সঙ্গে তার  আদি ও অকৃত্রিম সম্পর্কের কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

আপাত অজানা হলেও কাজুয়ো ইশিগুরোকে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার দিয়ে কর্তৃপক্ষ অপাত্রে দানের অভিযোগে ধৃত হবেন না; বরং গতানুগতিক সাহিত্যচিন্তা ও কাঠামো ভেঙে মানব-সত্ত্বার শক্তিতে জেগে ওঠা এক মানবিক সাহিত্য-সত্ত্বাকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্য হবেন।  

ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-কথাশিল্পী-গবেষক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।    

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।