ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কবিতা ও কবিতা এবং কবিতার কবি রুদ্র | তাইয়্যেবুন মিমি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৪২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৭
কবিতা ও কবিতা এবং কবিতার কবি রুদ্র | তাইয়্যেবুন মিমি কবিতা ও কবিতা এবং কবিতার কবি রুদ্র | তাইয়্যেবুন মিমি

সত্তরের দশকে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধোত্তর অস্থিতিশীল রাজনীতিক প্রেক্ষাপটে দু’চোখভরা আশাজাগানিয়া স্বপ্ন নিয়ে একটা নিজস্ব ধারার কাব্যভুবন গড়ে তুলেছিলেন চির তারুণ্যের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৬ অক্টোবর ১৯৫৬-২১ জুন ১৯৯১)। নিজের দেওয়া ‘রুদ্র’ নামে পাঠকের কাছে পরিচিত হতে ভালোবাসতেন এবং রুদ্র নামেই আজও আমাদের ভালোবাসার কবি হয়ে রইলেন।

কবিতা এবং শুধুই কবিতা ছিলো তার ধ্যান-জ্ঞান-জীবন-তৃষ্ণা-স্বপ্ন এককথায় সবকিছু। কবিদের মধ্যে অনেকে জাত বা স্বভাব-কবি; আর অনেকে লেখক কবি।

রুদ্র কিন্তু দু’টোই! কৈশোরবেলা থেকেই সাহিত্যমনা রুদ্র কবিতা পড়তে ও আবৃত্তি করতে ভালোবাসতেন; কবিতা ছিলো তার মজ্জাগত। তার জীবনের প্রধান একটা অংশ জুড়ে দখল করেছিল কবিতা। অন্যদিকে পরিণত বয়সে এসে জীবনের জন্য কবিতা নয় বরং কবিতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ার আগেই সাহিত্যে প্রচণ্ড অনুরাগ ছিলো তার; আর অনুরাগ থেকেই কবিতা লেখায় হাতে-খড়ি। তবে সাহিত্যের হিসেবেই শুধু নয়, মনে-প্রাণে আজন্ম এক বাঙালি তরুণ হিসেবে মাটি, মানুষ আর ঐতিহ্যের প্রতি দায়বোধ থেকে কাব্য-লেখার মৌল-শক্তির স্ফুরণ ঘটিয়েছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
 
জীবনের শুরুর সময়গুলো তার মফস্বলে কেটেছে; তবে ছেলেবেলা থেকেই পারিবারিক শিক্ষা ও সাহিত্যের অনুকূল পরিবেশ পাওয়ার কারণে মোটামুটি অল্প বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করতে পেরেছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই খুব সাংগঠনিক চিন্তা-ভাবনার অধিকারী ছিলেন; সাহিত্য-সংগঠন অথবা গানের দল গড়া, আড্ডার আসরে মুখে মুখে গান বেঁধে ফেলা, নতুন কবিতা বা গানে সুর দেওয়া-সহ লেখালেখিতে নতুনত্ব আনতেও ছাড়েননি। সবসময় একটা কিছু করার তাগিদ, নতুন কোনো ভাবনা অবতারণা করার প্রেষণা সর্বদা তারুণ্য তেজোদীপ্ত রুদ্রকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। আলাদা একটা কিছু, অন্যরকম ও আনকোরা নতুন একটা কিছু, চির-নতুন কিছু একটা করার অসম্ভব ইচ্ছাশক্তি পুষতেন মনে মনে। স্বাধীনচেতা এই তরুণ কবিটিকে আপাতদৃষ্টিতে দেখতে যতোটা অগোছালো কিংবা ভবঘুরে অথবা উড়নচণ্ডী দেখাতো, ঠিক ততোটাই গোছালো মনোভাব, নিষ্ঠা আর দায়বদ্ধতা ছিলো ভেতরের রুদ্র মানসে। ‍

তার কাছের বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষীদের মুখে প্রায়ই শোনা যেতো যে রুদ্র গোঁড়া, একরোখা, জেদি; অথচ এই জেদি স্বভাবটার জন্যই একরোখা ব্যক্তিত্বের মানুষটা সবার মনে ঠাঁই করে নিতো। ব্যক্তিত্বের প্রখর উত্তাপ তাকে সর্বদা স্বাধীনচেতা রেখেছে; কবিতাকে জীবিকা করে ফেলেছিলেন, চাকরি করা দূরে থাক কোনোদিন একটা চাকরির দরখাস্ত পর্যন্ত লেখেননি! বিভিন্ন ব্যবসা থেকে স্বোপার্জিত অর্থ ব্যয় করতেন দু’হাতে, অকুণ্ঠচিত্তে। কবি রুদ্রের চরিত্রের যে বিষয়টি তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করেছে সেটি হলো, তিনি জীবনের জন্য জীবিকা নয় বরং প্রধানতম উদ্দেশ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাহিত্যের পথ। বিশেষত কবিতা আর কবিতা এবং শুধু কবিতাই ছিলো তার একমাত্র কর্ম কিংবা প্রিয় পথ।
 
প্রেমী, ভাবুক, চঞ্চল অথচ সাহসী, প্রতিবাদী ও অমিতাচারী কবি রুদ্রের অন্যতম প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য রাজনীতি সচেতনতা। রাজনীতি-সচেতন হয়েও শিল্পের প্রতি তার দায়বদ্ধতা ছিলো আপোষহীন। নান্দনিক সৃষ্টিশীলতায় রাজনীতি ও শৈল্পিক প্রকরণে অলংকৃত কবিতা যেনো তার দু-হাতে দু’টি ‍দ্বি-মুখী রঙিন তুলি। সুদূর ঐতিহ্যের প্রতি দুর্বলতা, সংস্কৃতি-চেতনা, শব্দ-শিল্পের প্রতি তৃষ্ণা আর মননশীলতা— রুদ্র ছাড়া তৎকালীন আর কোনো কবির মধ্যে চোখে পড়ে না।

ব্যক্তিগত কিছু সম্পর্ক ও ঘটনা আর সেগুলোর টানাপড়েন তার কবিসত্তার আগুনকে উসকে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধোত্তর দেশের সামাজিক যন্ত্রণা, ক্রোধ, রাগ, অসংগতি, অস্থিরতা, বিষাদ, অবক্ষয় এবং ভালোবাসা সবকিছু মিলিয়ে কবি রুদ্রের মননে একটা দার্শনিক অন্বয় গড়ে উঠেছিল। ভালোবাসতেন স্বপ্নজাগানিয়া ভাবনায় বিভোর থাকতে, হারিয়ে যেতে আবার হারিয়ে যাওয়া নিজেকে খুঁজে নিতে।
 
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্বভাবতই প্রেমিক বলে তার জীবনের বৃহত্তম উপলব্ধি বলা যায় প্রেম। তাই তিনি কবিতায়ও প্রেমকে স্থান দিয়েছেন অবশ্যম্ভাবীভাবে। প্রচুর প্রেমের কবিতা এরই প্রমাণ। ঘুরে-ফিরে বার বার জীবনে প্রেম আসা, প্রাক্তন প্রেমিকা ও স্ত্রীর সঙ্গে আপাত-বিতর্কিত ও বহুলালোচিত সম্পর্কের বেড়াজাল, নতুন করে প্রেমে পড়া, আবার জীবনকে গুছিয়ে সাজানোর কল্পনা তাকে যেমন প্রেমিক কবি করে তুলেছে, অন্যদিকে সামাজিক, রাজনীতিক ও রাষ্ট্রীয় আবহ তাকে করে তুলেছে দ্রোহী। একইসাথে প্রেম ও সুন্দরের প্রতি তার আকণ্ঠ ও অকুণ্ঠ অনুরাগ, দ্রোহ ও সংগ্রামের প্রতি অভগ্ন বিশ্বাস, সর্বোপরি শিল্পের প্রতি বিশ্বস্ত নিবেদন তার তেজোদীপ্ত প্রতিবাদী কবি হয়ে ওঠার নেপথ্য নিয়ামক। কবিতায় আবেগ, প্রেম, নস্টালজিয়া ও ঐতিহ্য-অহংকার উপজীব্য হলেও বার বার তার কবিতায় উঁকি দেয় মানুষ; যে মানুষ পোড় খাওয়া, তামাটে এবং গ্রামীণ আর যে মানুষ আপামর।
 
আপাদমস্তক নিরীক্ষা-প্রবণ কবি রুদ্র। তার প্রথম কবিতা ছাপা হয় ‘আজাদ পত্রিকা’য় (১৯৭৩ সাল)। এর কিছুকাল পর ‘অশ্লীল জ্যোৎস্নায়’ নামে একটি সাহিত্য সংকলনে ‘উপলিকা’ নামের না-গল্প না কবিতা ধাঁচের নতুন এক কাব্য-ধারার প্রস্তাবনা ও চর্চা শুরু করেন। তার এই চমৎকার ধাঁচের কবিতা লেখার প্রয়াস পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা না পেলেও আলোচিত হয়েছিলো বেশ। তার সবচেয়ে অন্য বৈশিষ্ট্য বানানের ক্ষেত্রে অনন্যতা এবং স্বকীয়তা। স্বকীয়তাটা হলো তিনি ধ্বনিকে মূল ভিত্তি ধরে বানান লিখতেন এবং সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা বানানরীতি গড়ে তুলেছিলেন। যেমন, বাংলায় ‍মূর্ধন্য ‘ণ’র স্বতন্ত্র উচ্চারণ না থাকায়, বাংলা বানানে সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুশাসন তিনি অস্বীকার করেছেন। তার সব রচনা থেকে লোপ পেয়েছে মূর্ধন্য ণ। পাঠের সুবিধার্থে কিছু দ্বি-অক্ষরবিশিষ্ট অসমাপিকা ক্রিয়ায় তিনি ো’ কার= বোলে, কোরে, বোসে এবং বাকি অসমাপিকা ক্রিয়ায় লোপচিহ্ন ব্যবহার
করেছেন। হ্রস্ব ‘’ি’কার ও হ্রস্ব ‘ু’কার ব্যবহার ও অনুচ্চারিত য-ফলা বর্জন করেছেন। শব্দ-মধ্যের বিসর্গ, ‘ঙ’-এর বদলে ‘ং’, দন্ত্য ‘স’-এর বদলে তালব্য ‘শ’ ব্যবহার করেছেন। অর্ধ-কমার প্রচলন করেছেন ইংরেজির অনুকরণে।
 
জীবনে প্রচুর দুঃখ-আঘাত পেয়েছেন; কাটিয়েও উঠেছেন ইচ্ছা-শক্তির জোরে। দু:খ-বিলাসে বলতেন, ‘বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এইতো জীবন’। অভিজ্ঞতা, তীক্ষ্ণদৃষ্টি ও ভৌগলি্ক-ইতিহাসজ্ঞান শেষ পযন্ত তাকে দিয়েছে পরিণতি, স্থিতধী শক্তি আর শিল্পের স্থায়িত্ব। জাগতিক বিষয়ের মধ্যে থেকে লেখালেখির নিরন্তন সাধনা ছিলো তার অপরিসীম। মধ্যরাতে হুট করে জেগে উঠে কাগজ-কলম নিয়ে বসে যাওয়া, বার বার উচ্চারণে ছন্দের গতিপথ নির্ধারণ করা, শব্দকে নেড়ে-চেড়ে–ঝাঁকিয়ে-ভেঙে-চুরে কবিতায় বসিয়েছেন নিজস্ব নিয়মে। চিন্তার পরিধি তার ছড়াতো সুন্দর আবহে। নতুন সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যান্দোলনে নিজেকে নিবেদিত করে পরিবর্তনের ধারা নির্মাণের ব্যাকুলতা ছিলো অদম্য ।
 
১ম কাব্যগ্রন্থ ‘উপদ্রুত উপকূল’ (১৯৭৯) ও ২য় কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’ (১৯৮১) এর জন্য দুই-দুই বার পেয়েছেন ‘মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার’। জীবিতাবস্থায় প্রকাশিত হয়েছে আরও পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ। অসংখ্য অপরিচিত শুভানুধ্যায়ী আর বাংলাদেশের কাব্য-ভুবনকে বঞ্চিত করে অকালে মহাকালে বিলীন হয়ে গেলেন চির-তরুণ, চির-নবীন, চির-ভালোবাসার রুদ্র… তবে কোনো ভূষণে নয়, রুদ্র ভাস্বর আমাদের ভালোবাসায়।
 
তসলিমা নাসরিন যথার্থই লিখেছিলেন, ‘রুদ্র ; ওকে যেকোন দূরত্ব থেকে ভালোবাসা যায়’।
 
সত্যিই তাই। প্রাণের কবি, নতুনের কবি, কবিতার কবি রুদ্র; যাকে যেকোনো দূরত্ব থেকেই ভালোবাসা যায়।
 
বাংলাদেশ সময়: ১১৪২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৭
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।