ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

লেখকদের বিয়ে করা উচিত নয় | বুদ্ধদেব গুহ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৭
লেখকদের বিয়ে করা উচিত নয় | বুদ্ধদেব গুহ লেখকদের বিয়ে করা উচিত নয় | বুদ্ধদেব গুহ

বুদ্ধদেব গুহর মতো জনপ্রিয় লেখককে নতুন করে পাঠকদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা বাহুল্যই বটে। তার লেখা উপন্যাস বিশেষত মাধুকরী, কোজাগর, একটু উষ্ণতার জন্য— এগুলো পড়েননি এমন রসিক পাঠক বোধকরি পাওয়াই মুশকিল!

মেঘে মেঘে বেলা তো কম হলো না। দীর্ঘ জীবন যাপনের এই পর্বে এসে জীবন, মৃত্যু, প্রেম, সমাজচিন্তা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কতি প্রভৃতি নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে এক একান্ত আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন জননন্দিত এ লেখক।

বাংলানিউজের পক্ষ থেকে এ আলাপচারিতায় অংশ নেন কবি তানিয়া চক্রবর্তী

বাংলানিউজ: গান আপনার জীবনে কীভাবে এলো?

বুদ্ধদেব গুহ: দক্ষিণীতে তো গান শিখতামই! আগেই বলেছি কীভাবে পুরাতনী গানে আকৃষ্ট হলাম। তারপর আমি সঙ্গীত অ্যাকাডেমির মেম্বার ছিলাম! তো সেখানে একবার সেমিনার হচ্ছে প্রায় আট বছর আগে। বিষয় হলো, “এই সময়ের যুবক-যুবতীরা ক্ল্যাসিকাল মিউজিকে আগ্রহী নয় কেন?”। সারা ভারতবর্ষ থেকে গায়করা এসেছেন। সেমিনারের আগের দিন ককটেল পার্টি। ডিরেক্টর মি. মুখার্জি আমাকেও একটা পেপার পড়তে বলেছেন। এবার পার্টিতে গিয়েছি, হুইস্কি খাচ্ছি, খুব ভালোবাসি খেতে ওটি। এখন আর মেয়েরা খেতে দেয় না ফলে কষ্টে আছি। তো ওখানে ধূর্জটি বাবুর ছেলে কুমারদা ছিলেন, তিনি আমায় খুব স্নেহ করতেন। কুমারদার তখন ক্যানসার হয়েছে। আমি জানতে চাইলাম কেমন আছেন; উত্তরে বললেন, আমি তো বেশ ভালোই আছি শরীরটা বেগরবাই করছে। ফলে শরীর আর মন যদি বিযুক্ত করা যায় তার চেয়ে ভালো কিছু নেই এটা তার থেকে শিখেছি। তো পার্টিতে আমায় বাংলা টপ্পা গাইতে বলা হলো। আমি বললাম, মাথা খারাপ নাকি, সে কে না এসেছেন— ভীমসেন যোশী থেকে শুরু করে সবাই। যাই হোক একটু তুরীয় অবস্থায় ছিলাম ফলে প্রায় আধঘণ্টা গেয়ে দিলাম। সবাই যে ধন্য ধন্য করল তা নয়, কেউ কেউ হয়তো মনে মনে খিস্তিও করেছিল। পরেরদিন সেমিনারে কফি ব্রেক, দূর থেকে দেখি সন্ধ্যা মুখার্জি আসছেন। আমাকে  দেখে বললেন, আরে বুদ্ধদেব গুহ! কী ভালো গান আপনি! কী সুরে গান! আমি বললাম, একটা কাগজে লিখে দিন না, বুকে বাঁধিয়ে রাখি!

পরে মান্না দে, তাকে তখন বেঙ্গল ক্লাবে ফেলোশিটেড করা হচ্ছিল বোধহয়। হুইস্কি খাচ্ছিলেন তখন প্রায় বিরাশি বছর বয়স। দু’টো হুইস্কি খাওয়া হয়ে গেছে। পাশে গিয়ে বসেছি তখন কে একজন এসে বলল মান্নাদা, বুদ্ধ দা খুব ভালো বাংলা টপ্পা গায়! মান্না দা বললেন, শোনান। আর আমি তো সেই সুযোগ খুঁজছি। গান শুনে উনি বললেন, আরে মশাই আপনি প্রফেশনালি কেন গাইলেন না! অনেকের ভাত মারা যেত তো! আমি বললাম কটা প্রফেশন করব বলুন, ছিলো অ্যাকাউন্টিং হলাম লেখক, তারপর গানও! হেমন্তদাও একই কথা বলেছিলেন। তারপর এ টি কানন সাহেব, মালবিকা দি তারাও। একদিন দূরদর্শনে দোলের দিন দেখি আমার একটা পুরনো প্রোগ্রাম টিভি খুলে হঠাৎ দেখছি। কানন সাহেবের ফোন, এই বুদ্ধদেব তুমি আমার কাছে এসো, এসব চাকরি ছেড়ে দিয়ে গানটা শুরু করো।

তারপর একবার একটা কাজে জব্বলপুর যাচ্ছি। বেনারস হয়ে মুম্বই মেলে যাচ্ছি। এক শিল্পীকে দেখি তার ভক্তরা ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা দিতে এসেছে। তার সঙ্গে পরিচয় হলো, তিনি মুম্বই অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ছিলেন। অনেক আড্ডা হলো। ইতোমধ্যে ট্রেনে একটি মোষ কাটা পড়েছে; ফলে যতোক্ষণ না ট্রেন যায় বসে থাকা! ভদ্রলোক বললেন, ব্যাগের ভেতর মোষ ছটফট করছে। তাকে বের করি। বলেই, স্কচের বোতল বের করলেন; ভক্তরা এসব দিয়েছে। তারপর আমায় অফার করলেন; দু’জনে খেলাম। আমি তাকে গান গাইতে বললাম। তিনি বললেন ধুর হারমোনিয়াম, তবলা কিছু নেই কীভাবে গাইব। খালি গলায় গাওয়া সহজ নয়। তারপর যা হোক গাইলেন আর আমাকেও গাইতে বললেন। আমি বললাম, আমি গাইব না। তিনি বললেন, আপনি যখন গান গান করছেন, আপনি নিশ্চয় গান। আমি বললাম, আমি বাথরুমে গাই ঠিক তবে এখানে গাইব না! যা হোক শেষে অনেক কটাই গান গাইলাম। আর উনি তো আপ্লুত! বললেন, নাঙ্গা গলে মে অ্যায়সা গানা! আমাকে মুম্বই আসতে বললেন। আমি বললাম, এমনি মাসে আমার এক-দু’বার যাওয়া হয়, তাজে থাকি তখন কাজের সূত্রে। তো পরেরবার গিয়ে তাকে ফোন করেছিলাম। তিনি গাড়ি নিয়ে এসে আমায় নিয়ে গেলেন। সে বড় এক সুন্দর স্টুডিও, তার মধ্যে জোড়া তানপুরা, ধূপের গন্ধ। অজস্র ছাত্রের মধ্যে আমায় গাইতে বললেন,  আমিও গাইলাম, খুব সমর্থন পেলাম।

একই কাণ্ড হৃষিকেশ মুখার্জির ছোটভাই কাশীনাথ দার ক্ষেত্রেও। তখন এসআরএ তাকে ফেলোশিটেড করছে। আমায় বললেন, আমায় তার বাড়িতে গিয়ে গাইতে হবে। আমি তাজ্জব বনে বললাম, আমি আপনার মতো মানুষের বাড়ি গিয়ে গাইব কী বলেন! দারুণ সেতার বাজাতেন। তার বাড়িতেও সেই একঘর ছাত্রদের মধ্যে গান গেয়েছিলাম। ফলে এইভাবে বহু গুণী মানুষের সান্নিধ্য ও সমর্থন পেয়েছি। ফলে জীবনের প্রতি মুহূর্তকে আমি উপভোগ করেছি। আমার কোনো আক্ষেপ নেই। তবে দুঃখ আছে, গানটা যদি ভালো করে গাইতে পারতাম! সময় পাইনি মূলত। আর এক জীবনে কতো আর করা যায়, জীবনটা বড় ছোট সেই অর্থে। তবে হয়তো ভালো করে টেনিস খেললে, আমি হয়তো লিয়েন্ডার পেজই হতে পারতাম!

বাংলানিউজ: বিভূতিভূষণের উত্তরসূরী বলে অনেকে আপনাকে, এখানে আপনি কী ভাবেন?

বুদ্ধদেব গুহ: বিভূতিভূষণ ওয়াজ আ সেন্টলি পার্সন। উনি ঈশ্বর হলে আমি বাঁদর! তবে একটা কথা কী জানো, জীবন আর প্রকৃতি এদের আমি উল্টেপাল্টে দেখেছি। বিভূতিভূষণ দুপুরবেলা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, ধনী বাড়ির সুন্দরী মেয়ে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, উনি সেই দিয়ে প্রেমে বা ভালোবাসায় ঢুকে যেতে পারতেন। তবে আমি নারী বা প্রকৃতিকে রমণ করে জেনেছি। তাদের কাছে ভয়শূন্যভাবে গিয়ে জয় করেছি। ফলে তারা কাছে এসেছে। এখনও কতো মেয়ে আমার সঙ্গে প্রেম করতে চায়, ঘনিষ্ঠ হতে চায়। আমার যদিও এখন সেই বয়স নেই।

বাংলানিউজ: বিগত যাপনের কী কী আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে?

বুদ্ধদেব গুহ: খুব ইচ্ছে করে ম্যাকলাস্কিগঞ্জে যাই আবার। আবার যদি জিপ চালাতে পারি! একবার গ্রীষ্মে ম্যাকলাস্কিগঞ্জে গিয়েছি। নির্জনে লিখতেই যেতাম ওখানে। আমার বাড়িতে প্রায় আশিটা পেয়ারা গাছ ছিলো। সব দেখি শুকিয়ে গেছে। সারারাত বৃষ্টি হলো, সকালে উঠে দেখি এতোটুকুটুকু কিশলয়ে তারা ভরে গেছে, কোথায় ছিলো সাপ-ব্যাং তার সব ফিরে এলো। ফলে এই প্রকৃতির কোনো কিছুই তো ফেলে দেওয়ার নয়, সে মানুষ বা প্রাণী যা-ই বলো। কতো কী তো সুপ্ত থাকে আবার রূপ নেয়, ফলে সবই ফিরে পেতে ইচ্ছে করে।

বাংলানিউজ: এইসব মিডিয়ার জায়গায় অদ্ভুত একটা রাজনীতি আছে টের পেয়েছেন?

বুদ্ধদেব গুহ: টের পাব না মানে, খুব পেয়েছি। তবে মানুষের ক্ষুদ্রতা দেখে খারাপ লাগত। আমি নিজে কখনও হতাশ হইনি। উল্টো আমার জোর বেড়ে যেত যে, একদিন আমি প্রমাণ করব। তুমি জানো, মাধুকরী যখন বেরোয় কিছু ব্যক্তি হিংসায় চাঁদা তুলে আমার বিরুদ্ধে নেতিবাচক কথা বলার জন্য লোক লাগিয়েছিল। সেইসব লেখকেরাই সামনে হাসি মুখে কথা বলত। আসলে সত্য তো কখনও চাপা থাকে না, তাকে মিথ্যে দিয়ে কিছুতেই ঢাকা যায় না।

বাংলানিউজ: এই যে লেখকের কল্পজগত আবার বাস্তবজগত দু’টোর বিচরণ, তারপর ধরুন লেখকদের জীবন সাধারণের থেকে আলাদা আবার সাধারণ মানুষ লেখকের জীবন থেকে, লেখা থেকেই প্রতিবিম্বিত হতে চায়! এই আপনার জীবনে এতো নারী এসেছে, এতো সম্পর্ক আবার পুরোটা শ্রীকান্তের জীবনও নয়, সংসারেও ফিরেছেন— ফলে কোথাও কী এটা দ্বিচারিতা?

বুদ্ধবেদ গুহ: তা তো বটেই, ফলে সংসারের ওপর অনেক অবিচার হয়েছে, আমার স্ত্রী ঋতু ভীষণ দক্ষ ছিলো তাই আমার মেয়েরা এরকম শিক্ষিত হতে পেরেছে। ফলে লেখকের স্ত্রী হলে তাকেই দাম দিতে হয় জীবনের! ঋতুও তাই দিয়েছে। আসলেই লেখকদের বিয়ে করা উচিত নয় কারণ, উল্টোদিকের সাধারণ চাহিদারা বঞ্চিত হয়। ঋতু নিজে খুব দৃঢ়চেতা মেয়ে, শিল্পী হিসেবে আদর্শ। একটু অন্যরকম হলে হয়তো অনেক কিছু করতে পারত কিন্তু কারও কাছে সে মাথা নত করেনি। আমি প্রচুর টাকা উপার্জন করেছি কিন্তু সময় দিতে পারিনি। আর তার মধ্যে আমি তো শুধু লেখক ছিলাম না; আমাকে অফিসের কাজ করতে হতো তারপর এইসব মানুষদের মধ্যে লিখে সারভাইভ করা। ঋতুর নিজস্ব জায়গা ছিলো আর অদ্ভুত দক্ষ ছিলো তাই হয়তো সংসার ভাঙতে পারেনি। তবে এই সম্পর্ক, প্রকৃতি এরা না থাকলে আমি লেখক হতে পারতাম না কিন্তু তবুও আমার পা বাস্তবের মাটিতে ছিলো। তবে লেখক হওয়ার জন্য আমাকে অনেক শত্রুতা সহ্য করতে হয়েছে, যুদ্ধ করতে হয়েছে। সেই পারিবারিক বা বাহ্যিক যা-ই হোক।

বাংলানিউজ: এটা কী সত্যি, ক্রাইসিস না থাকলে প্রকৃত লেখক হওয়া যায় না?

বুদ্ধদেব গুহ: বহুলাংশে সত্যি, আমার যা যা বাঁধা যা যা কষ্ট তাই আমার ড্রাইভিং ফোর্স, সেগুলো আমার জোর বাড়িয়ে দিয়েছিল। এখন জীবনকে সামগ্রিকভাবে দেখলে বুঝি, ওগুলোই তো বুস্ট আপ করেছে। ফলে আমার জেদ জোর আমাকে আরও এগিয়ে দিয়েছে।

বাংলানিউজ: এই যে ভার্চুয়াল সময়— ইন্টারনেট, ওয়াটসঅ্যাপের যুগে লোকে বলছে, সাহিত্যসৃষ্টি কম বা মানুষের পড়াশুনা কমে যাচ্ছে। তারপর সামগ্রিকভাবে ক্রাইম, সুইসাইড, বিচ্ছেদ এইসবের প্রাবল্যের শেষ কোথায়?

বুদ্ধদেব গুহ: এটা আসলে সাইকেল, পাসিং ফেজ! মানুষকে চূড়ান্তভাবে বইয়ের কাছেই ফিরতে হবে কারণ, এই নেট-ফেট এসব চালাবে কী করে যদি মূল সাহিত্য তৈরিই না হয়। ফলে এটা সময়ের একটা অংশ।

বাংলানিউজ: নারী-পুরুষ দেহ ছাড়াও কী চূড়ান্ত প্রেম আদতেই সম্ভব? প্লেটোনিক লাভ সত্যিই কী হয়?

বুদ্ধদেব গুহ: নিশ্চয় হয়! বিশ্বাস করি হতে পারে।

চলবে…

আলাপচারিতা-১ম পর্ব
**লেখক হতে গেলে ফাঁকিবাজি করে কিছু হয় না | বুদ্ধদেব গুহ

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৭
এসএনএস/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।