ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ভেতর থেকে বলছে হৃদয়, তুমি আমার প্রিয়তম

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮
ভেতর থেকে বলছে হৃদয়, তুমি আমার প্রিয়তম প্রতীকী

স্মৃতির জাগরণে আর প্রতিশ্রুতির পুনরুচ্চারণে আজ (১৪ ফেব্রুয়ারি) ভালোবাসা দিবস। আজ যূথবদ্ধ তারুণ্য-যৌবন মেতেছে ভালোবাসার লেলিহান উৎসবে। ফাগুনের উদ্দামতায় চারদিকে ধ্বনিত হচ্ছে ভালোবাসার অজেয় সঙ্গীত। ঋতুরাজ বসন্তের আবাহনে এলোমেলো বাতাসের ছোঁয়ায় ভেসে যাচ্ছে প্রতিটি জীবন, জীবনেরই উপকূলে।

রঙিন ফুল, প্রজাপতির মেলা, বর্ণিল পত্র আর পল্লবের বাসন্তী বাহারে উৎসব ছাড়া অন্য কোনোভাবেই মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। উৎসব ছাড়া বাঙালি তো বাঁচেই না।

হয়তো বারো মাসে তেরো পার্বণের ইমেজটি এদেশে এখন উপকথা বা অতিশয়োক্তিতে পরিণত হয়েছে। তথাপি বিশ্বের প্রায় সকল দেশই ভালোবাসা দিবসে প্রবলভাবে উৎসবমুখর। বাংলাদেশও সেজেছে ভালোবাসার বহুবর্ণ সাজে।

তত্ত্বের ভাষায়: বৃষ্টি, জল, চাষাবাদের সঙ্গে শ্রমের সংযোগ যেখানে গভীর আর প্রত্যক্ষ, সেখানেই উৎসব। সেখানেই মানুষ মুখর। সেখানেই মানুষ মিশতে চায়, একের সঙ্গে অপরকে মেলাতে চায়। মানুষ সম্প্রদায়মুক্ত মনুষ্যত্বের টানে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ আবহে মিশে যেতে চায় ভালোবাসার চিরায়ত উৎসবে, আয়োজনে।    

ভালোবাসার নান্দনিক উৎসব আমাদের দৈনন্দিন গ্লানি-যাতনা-অপ্রাপ্তিকে ভুলিয়ে দেয়। দিনযাপনের পাতায় পাতায় সঞ্চারিত করে অনন্য সুরের ব্যঞ্জনা। আমাদের সাদামাটা দিনগুলোর বিবর্ণতা রঙিন হয়। ভালোবাসাকে ঘিরে অন্তরে-বাহিরে জেগে ওঠে এক মহাসমুদ্র। অতীত স্মৃতির জাগরণে যার উত্থান, চলমান প্রতিশ্রুতি পুনরুচ্চারণে যার পুনরাবৃত্তি।

মহাচীনের প্রাচীন দার্শনিক চুয়াংৎসে-এর কথাই ধরা যাক, যার দর্শন-কথাবার্তা-চিন্তার ধরন আজও নাড়া দেয়। ভালোবাসা তাঁর কাছে ছিল আত্মমগ্ন-নীরব প্রার্থনার প্রতীক। স্ত্রী-র মৃত্যুর পর গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বন্ধুকে বলেছিলেন, “আহঃ, তোমরা বোকার মতো শোক জানাতে এসেছো কেন? আমি যাকে হারালাম, সে তো দিব্যি আমার অন্দর-মহলের ঘরে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে!” 

এমনই প্রেমের ধ্বনি মঞ্জুরিত হয়েছে রুমির কবিতায়। আধুনিক অনেক কবির ভাষ্যে। উদাহরণস্বরূপ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ’ পর্বের কবিতায়।  
 
আসলেই তো, জীবনকে ঠিকভাবে বুঝে নিতে হলে তাকে বারেবারে বিপরীত প্রেক্ষিত থেকে দেখে নেওয়া দরকার। মৃত্যুর মাধ্যমেই তো জীবনের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। অন্ধকারকে দিয়েই তো আলোর মূল্য সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব। বিষাদেই সবচেয়ে স্পষ্ট হতে পারে প্রেম, ভালোবাসা।

প্রেম ও বিষাদের পরীক্ষায়, প্রাচীন ও মধ্যযুগের মতো বাংলাভাষার আধুনিক কবিগণও বিশেষ পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন: “লিপস্টিক বুলানো ঠোঁটের/মখমলে চেপে ধরি ঠোঁট, হৃৎকম্পন বেড়ে যায়, স্তব্ধ হয়/পৃথিবীর গতি;/সে মুহূর্তে জঙ্গি ট্যাঙ্ক আমার উপর দিয়ে চলে গেলে কিছুই পাব না/টের, শুধু ঠায়/থাকব দাঁড়িয়ে খাজুরাহো মুগ্ধতায়। ” (শামসুর রাহমান: নিভৃতে আমার অগোচরে)।

কিংবা আরও গভীর কোনও কাব্যাক্রান্ত উচ্চারণের ভেতর দিয়ে শুনতে পাওয়া যায়: “কালেভদ্রে একটুখানি দেখার জন্য/ঘুরে বেড়াই যত্রতত্র, দাঁড়িয়ে থাকি/পথের ধারে। /রোদের আঁচে পুড়ে যায়/যখন তখন/জল-আঁচড়ে আত্মা থেকে রক্ত ঝরে;/দূর দিগন্ত আস্তেসুস্থে রক্ত চাটে। ” (শামসুর রাহমান: কালেভদ্রে একটুখানি)।
 
উল্লেখ করা যায়, রফিক আজাদের বহুখ্যাত ‘ভালোবাসার সংজ্ঞা’ কবিতার পংক্তি থেকেও: “ভালোবাসার মানে দুজনের পাগলামি,/পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা/ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে-যাওয়া কথার পরেও/মুখোমুখি বসে থাকা। ”

যথার্থ প্রেমের প্রতিচ্ছবি রফিক আজাদেরই ‘নৈশ প্রার্থনা’ কবিতায় আরও সর্বাত্মকভাবে উদ্ভাসিত, যেখানে প্রেমের সমান্তরালে খেলা করে বিষাদের ভেলা: “কোথাও অনিন্দ্য গোলাপ ফুটুক আজ/কোনও নৈশ নীরব বাগানে; আমি একা সঙ্গোপনে/ঘ্রাণ নেব বিশ্বস্ত হাওয়ায়। ”

‘দুঃখ-কষ্ট’ কবিতায় উচ্চারিত পংক্তিতে প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে অব্যক্ত বেদনাও হৃদয় খুঁড়ে জাগিয়ে তুলেছেন রফিক আজাদ: “তুমি চলে গেলে দূরে/নিঃস্ব রিক্ত পাখির পালকসম একা পড়ে থাকি। ”

জীবনানন্দ দাশ, যিনি কবিতায় অদ্বিতীয়, মৃত্যু-পরবর্তীকালে প্রকাশিত ‘বিভা’ উপন্যাসে লিখেছেন প্রেমময় আখ্যান: “বিভার মুখের লাবণ্য বেশ উচ্চ জাতীয়। সচরাচর এ রকম সৌন্দর্য্য চোখে পড়ে না। খুব অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য নয়-কিন্তু এর বিশেষ ধরনাটা আমার কাছে বড্ড চিত্তাকর্ষক। অনেক নারীই তো দেখেছি-কিন্তু একটা মেয়ের কথা মনে পড়ে যায়, মুখ অনেকটা এই বিভার মতো। সেই মেয়েটি ষোল সতের বছরে মারা যায়। মৃত্যু বড় করুণ। তার মৃত্যুর পর আমার মনে হয়েছিল যুবাবয়সের সৌন্দয্যের একটা বিশেষ বিকাশ পৃথিবী থেকে মুছেই গেল বুঝি বা-। তারপর এই বিভাকে দেখলাম। মনে পড়ে প্রায় সাত বছর আগে বায়স্কোপে (চার আনার সিটে) বসে রুথ চ্যাটার টমকে দেখেছিলাম। আজ মনে হচ্ছে গঙ্গাসাগরের মেলা দেখতে গিয়ে মৃত সেই পাড়াগাঁর মেয়েটি, বিভা আর রুথ, এই তিনজনের মুখে একই আদল লেগে রয়েছে যেন। একটা ছিপছিপে নিমীলিত চাঁপাফুল কিংবা শীর্ণ একটা উন্মুখ চাঁপার কলির মতো নারীর আঙুলের দিকে তাকালে এ সৌন্দয্যের উপলব্ধি করতে পারা যায়। ”
 
অতএব ভালোবাসা যেমন স্মৃতির জাগরণ, তেমনি প্রতিশ্রুতিরও পুনরুচ্চারণ। ভালোবাসা দিবসের উৎসবে মানুষ হৃৎকমলের স্মৃতি মাখে, তারই প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করে স্মৃতি-সত্তার গভীর অন্তর্মূল থেকে উৎসারিত প্রেমময়তায়। প্রবহমান ভালোবাসার একটি যাদুকরী নদীর রোমাঞ্চকর স্রোতে ভাসতে ভাসতে গাইতে থাকে: “তোমার চোখে আকাশ আমার, চাঁদ-উজাড় পূর্ণিমা; ভেতর থেকে বলছে হৃদয়, তুমি আমার প্রিয়তমা…। ’

বাংলাদেশ সময়: ১১১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮
এমপি/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।