ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নিদানের নিদান চরকি | রুমা মোদক

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪০০ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১৮
নিদানের নিদান চরকি | রুমা মোদক নিদানের নিদান চরকি | রুমা মোদক

গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে ফার্স্টক্লাস কন্ট্রাকটার মো. নিদান মিয়া মাইকের আওয়াজ শুনতে পায়, নাকি মাইকের আওয়াজে ঘুম ভাঙে ঠিক ঠাহর করতে পারে না। বাইরে তুমুল বৃষ্টির আওয়াজে কথাগুলো একবার স্পষ্ট হয় আবার বৃষ্টির তোড়ে অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড ঘুম ভাঙা আর না ভাঙার সন্ধিকালে এই মাইকের আওয়াজ স্বপ্ন নাকি বাস্তব বিভ্রম লাগে তার। পুরোপুরি ঘুম ছুটে গেলে মাইকের আওয়াজটা স্পষ্টই কানে আসে। একটি জরুরি ঘোষণা, একটি জরুরি ঘোষণা, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উজানে পাহাড়ে প্রবল ঢলের পানি নেমে খোয়াই নদীর পানি বিপদসীমার ২৫০ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শহররক্ষা বাঁধ ভেঙে যে কোনো সময় শহর প্লাবিত হতে পারে, শহরবাসীকে সাবধান থাকার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। অনুরোধক্রমে জেলা প্রশাসক। ঘোষণাটি স্পষ্ট করে শোনার পর, বাকি শহরবাসীর ঘুম হারাম হয়ে যাবে নিশ্চিত জেনেও নিদান মিয়ার কানে বাজে স্টেডিয়ামের কার্নিভালের নিউ লক্ষ্মী অপেরার প্রিন্সেস মর্জিনার ঘুঙুরের ঝংকার ‘ছাইয়া...ছম...ছমা... ছম... ছম’।  

পড়ুন বাংলানিউজের বর্ষপূর্তির ই-ম্যাগ

সকালের হীরকখণ্ডের দ্যুতির মতো চকচকে রোদ দেখে কে বলবে রাতটা কেটেছে হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগী নিয়ে রাত কাটার মতো ভয়াবহ! নিমের ডালটা হাতে নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়ায় নিদান মিয়া। দাঁত খিলাল করতে করতে রাস্তায় জটলা জটলা মানুষ দেখে।

স্মরণকালে এমন দেখেছিল সে এরশাদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সময়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে জটলা, আর সবার চোখেমুখে আতঙ্ক-আশঙ্কা। নিদান মিয়া কাউকে কিছু জিগ্যেস করে না। জায়গামতোই জানবে সব। মায়ের রান্নাকরা ডালভাত হাপুস হুপুস খেয়ে মতি কবিরাজের দোকানমুখী হাঁটা দেয় সে।

মতি কবিরাজ তখন গোটাকতক ধূপকাঠি জ্বালিয়ে সিদ্ধিদাতা গণেশের আবাহন করছে। নাদান মিয়াকে চোখের ইশারায় বসতে বলে জয় শ্রী গুরুভে নম...জয় শ্রী গুরুভে নম...বলে বারকয়েক মন্ত্র পড়ে ধূপকাঠিগুলো ধূপদানিতে গুঁজে রাখে মতি কবিরাজ। তারপর ধীরে ধীরে নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বলে, হুনছি ফইত্যাখালা রামপুর দিয়া নদী কাইট্টা দিছে। বুকের ভেতর বজ্রপাতের আওয়াজ শুনে নিদান মিয়া, কও কিতা বা! কেম্নে হুনলায়? বলে আর উত্তরের অপেক্ষা না করে দোকান থেকে বের হয়ে রিক্সার অপেক্ষা না করে রামপুরমুখী হাঁটা দেয় সে।

এই মতি কবিরাজের সাথে নিদান মিয়ার বিশেষ খাতির। এর কথাতেই একদিন গ্রাম ছেড়ে শহরমুখো সে। সেদিন জৈষ্ঠ্যের খর দুপুরে পাকা আম আর কাঁঠাল নিয়ে খর দুপুরের মতোই অসহ্য খিদে পেটে নিয়েই হাটে বসেছিল নিদান মিয়া। থাকার মতো একখান ছাপড়া আর সীমানা লাগোয়া কয়েকটা আম-কাঁঠাল গাছ ছাড়া বাপ মরার আগে আর কিছুই রেখে যায়নি যে মায়ে-পুতে খাবে। কী করে মা-পুতের দিন কাটে তা কেবল এ দুজনই জানে। বাপের বাপ দাদা নাতির হাউশ মিটিয়ে খাবার জন্য যে আম কাঁঠাল গাছ লাগিয়েছিল, তার ফল বেচেই বরং মাসখানেক ভরপেট ভাত জোটে, সঙ্গে শুকনা মরিচপোড়া হোক কিংবা খালি লবণ।  

বিক্রি হয়ে যাবার পর ঢুকেছিলো পাশের জিলাপির দোকানে,আষ্টআনার জিলাপি কিনে খেলে মা টের পাবে না। সেখানেই জিলাপি খেতে খেতে দেখে সে মানুষটিকে। একজনের পর একজন হাত বাড়িয়ে ধরছে, আর সামনে যেনো সিনেমার পর্দার মতো ছবি ভাসছে, এমন করে সে বলে যাচ্ছে মাণিক বৈদ্যকে সামনে ফাঁড়া আছে, গ্রহতুষ্টি পূজা দেন। হাবিল মোল্লাকে, নৌকাডুবির লক্ষণ আছে পাঁচপীরের দরগায় মানত করেন। জিলাপি কয়খানা খেয়ে হাতটা ধুয়ে সেও হাতখানা বাড়িয়ে দেয় এক ফাঁকে। কার হাত, কেনো পেতেছে, কী জানতে চায় ইত্যাদি কোনো বৃত্তান্ত না জেনে, চেহারার দিকে না তাকিয়েই বলতে থাকে, আরে এ ত দেখি রাজকপাইল্যা। পরের ধনে পোদ্দারি। কথাটার মানে কী, জিজ্ঞেস করার আগেই তাকে ঠেলে সরিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় অন্য আরেকজন।

তের বছরের বালক নিদান মিয়া, সাধ্য কী এতোগুলো মানুষের সামনে আবার জানতে চায় কথাটার তর্জমা। তবু তার মনের ভেতর কী এক অজানা আশার ঢেউ তীর ভাঙে, মনে হয় কোনো স্বপ্নদরজার চাবি আছে এই লোকটার হাতে। সে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। ততোক্ষণে জানা হয় লোকটির নাম মতি কবিরাজ। চক্রবর্তীপাড়ার জামাই সে। জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে শশুরবাড়ি এসেছে।  

ধীর পায়ে অন্ধকার এগিয়ে এলে, সূর্যটা পুরোপুরি নদীর জলে ডোবার আগে জবাই করে ফেলে রাখা মুরগির আঁকাবাঁকা রক্তের ধারার মতো লাল রং আকাশে ছড়িয়ে দেয়। একটা দোকানে হারিকেনজ্বলা কেরোসিনের পোড়াগন্ধ জানান দেয় সন্ধ্যার রাত হতে খুব বাকি নেই। সবাই একে একে উঠে গেলে জিলাপির দোকান ঝাঁপ ফেলে। নিরাপদ দূরত্বে সে হাঁটে মতি কবিরাজের পেছন পেছন। সবাই বাড়িমুখো হতে হতে অন্ধকার পুরোই গাঢ় হয়ে গিলে খায় আশপাশের সুপারিগাছ,নারকেল গাছ আর বট-পাকুড়ের প্রতাপশালী ছায়া।

মতি কবিরাজ বাড়ির ভেতর ঢোকার সময় ডাকে নিদান মিয়া, কত্তা...। বারান্দায় জ্বালানো হ্যাজাকের আলোতে পেছনের অন্ধকার সমেত নিদান মিয়াকে দেখে হঠাৎ এক অতিলৌকিক দৃশ্য বলে ভ্রম হয় মতি কবিরাজের। নিদান মিয়ার কথায় ভ্রম কাটে তার, কত্তা কী জানি কইলেন তহন, রাজকপাইল্যা! আমি বুঝতাম ফারছি না।
 
আস্তা একটি পাগল দেহি, বলে হো হো হাসিতে ভয় তাড়ায় মতি কবিরাজ। বারান্দার হ্যাজাকের আলোতেই আবার হাতখানা নড়িয়েচড়িয়ে দেখে। বলে, হ ঠিকওই কইছি, রাজকপাইল্যা, পরের ধনে পোদ্দারি কই নাই? হ কইছেন ত, নিশ্চিত করে নিদান মিয়া। কিন্তুক কথাডার মাইনে ত বুজলাম না। বুজন লাগত না, একবার কফাল হাতাইয়া বাইরাইয়া পড়। হাতখানা ছেড়ে দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে যেতে গিয়েও আবার ফিরে আসে মতি কবিরাজ। তয় একখান কথা, নারীজাতির থাইক্যা সাবধান। বাড়ির ভেতরে উৎসবের শোরগোল। বারান্দায় বারান্দায় হ্যাজাক জ্বলছে। ছোট বাচ্চাকাচ্চাদের এদিক সেদিক ছুটাছুটি উৎসবের পরিবেশকে বহুবর্ণিল আর পোক্ত করে তুলেছে। হাভাতে চোখে সেই উৎসবের রঙ দেখে কী হয় নিদান মিয়ার,নিজের অর্ধভুক্ত, লাত্থি-উষ্টা খাওয়া দূর দূর অযাচিত দিনের বোঝা তাতানো দুপুরে হাটের পিচ করা রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটার মতো অসহ্য, দুর্বহ লাগে। যা থাকে কপালে, মনে মনে বিড়বিড় করে ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে এক রাতপরি দেখে সে। রাতপরি ঘোর অন্ধকারে আঁকাবাঁকা নাচে আর নিদান মিয়াকে ইশারা দেয়।

বাড়ি না গিয়ে সেই রাতে পরির ইশারায় নদীর ঘাটে যায় নিদান। সারারাত সব ভয় অগ্রাহ্য করে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। কাছেধারে কোনো গাছে বাদুড় ডানা ঝাপটালে তার বুক ধক্ করে ওঠে, বুঝি তার উপর লাফিয়ে পড়ে ত্যক্ত দিনযাপনে ফিরে যেতে বাধ্য করে। রাতপরি ইশারা করে। সে আশ্বস্ত হয়ে আবার বসে। গা ছমছম করা পায়ের শব্দে মনে হয় কেউ হঠাৎ এগিয়ে আসছে অন্ধকার কেটে কেটে, তার গলা টিপে ধরছে। বাড়িমুখো দৌড় দেয়ার ইচ্ছে হয় তার। রাতপরি আবার ইশারা করে। এভাবে পুবদিকের আকাশ আবারো জবাই করা মুরগির রক্তের ধারার মতো নানাদিকে লাল রং ছড়িয়ে আলো জেগে উঠতে থাকলে ঘাটে আসে হারান মাঝি। এই অকাল ভোরে একা নিদান মিয়াকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয় সে।
এত সক্কাল ঘাডে কী করো বাজান? কাকা টাউনে যামু, বলে হারান মাঝির নৌকায় উঠে পড়ে। তারপর আরো ক’জন যাত্রী জুটলে হারান মাঝি সূর্যটা ঠিকমতো পুবদিক দখল করার আগেই নৌকা ছেড়ে দেয়। সারারাত না-ঘুমানো নিদানের চোখ ঘুমে ঢুলতে থাকে। বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে আর কেউ শুনতে না পেলেও ঢুলতে ঢুলতে নিদান ঠিক মায়ের গলা শুনতে পায়, নিদাইন্যারে...কই গেলি রে নিদাইন্যা...। নৌকা চলতে থাকে শহরমুখো নিদানকে নিয়ে। পেছনে পড়ে থাকে খড়ের চালে মায়ের শুকাতে দেয়া শাড়ির ভেজা গন্ধ। মুখে আঁচলচাপা মায়ের গুমড়ে কান্না, হাজীবাড়ি থেকে চেয়ে আনা বাসি তরকারি আর পান্তা ভাত...।

রামপুর গ্রামটা কী অনেক দূরে মনে হয় আজ। রাস্তা যেনো ফুরায় না। রাস্তায় রিক্সা ভ্যানের ছিটেফোঁটাও নেই। সারারাত অঝোর বৃষ্টি আর নদী-ভাঙনের উৎকণ্ঠায় ঘুমহীন রিক্সাওয়ালারা কেউ রাস্তায় নামেনি এখনো। বিশেষত রিকশাওয়ালাদের অধিকাংশের বাস ঐ রামপুরে। মর্জিনার বাপও রিকশাওয়ালা ছিল এককালে। বাপের মৃত্যুর পরই যাত্রাদলে নাম লিখিয়েছে মর্জিনা। ঘুঙুর বাজিয়ে নাচা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তার। কোনো অপেরার বান্ধা প্রিন্সেস নয় সে। যে বেশি টাকায় বায়না করে তার দলেই নাচে। সিজন শেষে বাড়ি চলে আসে। রোজগারের টাকায় বসে বসে খায়। মার্কেটে ওই এখন সবচেয়ে দামী প্রিন্সেস। দস্তুরমতো নিলামে নিজের রেট বাড়ায় মর্জিনা। নিদান মজেছে তার প্রেমে। মর্জিনা টিপ্পনী কাটে, ভালোবাসাও নিলামে তুলুম বুঝছো নাগর? বলে বটে। কিন্তু ঠিক বোঝে নিদানের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে কিনতে কেউ আসবে না তাকে। তাই খাতির মহব্বতে কমতি করে না। মর্জিনার মাও জামাই আদর করে। সবচে বড় কথা মর্জিনার এই প্রিন্সেস নাচে কোনো বাধা দেয় না নিদান। উপরন্তু এটা সেটা কিনে দিয়ে সংসারের চাকাটা স্বচ্ছল চালিয়ে রাখে। ঘরে ঢুকলে মর্জিনা বাড়তি রং ঢং করে শখের জিনিসগুলা আদায় করে নেয়। যেমন গতমাসে ছয় ব্রান্ডের রেডিও আদায় করে নিয়েছে। নিজে হিন্দি গানে নাচে বটে, ছম...ছমা...ছম...ছম। নিজে শুনতে ভালোবাসে শাবানার লিপসিংয়ে সিনেমার গান: সন্ধ্যার ছায়া নামে এলোমেলো হাওয়া, ভালোলাগে জীবনের এই গান গাওয়া...। নিথর দুপুর কিংবা নিঃসঙ্গ রাতে যেদিন অপেরার পালা থাকে না, গান শুনতে শুনতে নিদানকেই কল্পনা করে সে।

শহরে যখন নামে নিদান তখন দুপুর অতিক্রান্ত। তীব্র ক্ষুধায় চোখেমুখে অন্ধকার দেখলেও সে অন্ধকারে রাতপরিকে আর দেখে না সে। সারি সারি ব্যস্ত মানুষ, কোথায় চলেছে কে জানে! লুঙ্গির কোঁচড়ে আম-কাঁঠাল বেচা টাকাটা আছে, কোথায় খেতে হয় কীভাবে খেতে হয় কিছুই তো জানে না সে। শুনেছে, গ্রামের জিলাপির দোকানের মতো শহরে ভাতেরও দোকান আছে। কিন্তু তার সাকিন-মোকাম তো জানা নেই নিদানের। ক্ষিধা পেটেই অজানা গন্তব্যের রাস্তা ধরে সে। এমন সময় পেছন থেকে কেউ ডাকে, ঐ ছোকড়া বস্তাডা তুলতে ফারবে? নিদান দেখে তাকেই ডাকছে লোকটা। পারবে না মানে গ্রামে এমন কত বস্তা পিঠে করে পৌঁছে দেয় হাজীবাড়ি, চৌধুরীবাড়ি। পেটে ক্ষিদে সত্ত্বেও নিজের গায়ের বলে টের পায় ঠিকই তুলে দিতে পারবে বস্তাটা। বস্তাটা ঠেলা গাড়িতে তুলে দিলে লোকটি পাঁচ টাকার একটা নোট এগিয়ে দেয় তার দিকে। নিদান বিস্ময়ে ভিরমি খায়। পাঁচ টাকার নোট এই প্রথম দেখলো সে। কাল আম-কাঁঠাল বেচে সাত-আট টাকা হয়েছে বটে কিন্তু সে খুচরা খাচরা। গ্রামে এমন কতোজনের সুপারি নারিকেল পেড়ে দেয়, বস্তা পৌঁছে দেয় বাড়ি বাড়ি। কেউ টাকা দূরে থাক, এক গ্লাস পানিও এগিয়ে ধরে না। হাজীর বউ অবশ্য টিনের থালায় দুমুঠো মুড়ি আর গুড় খেতে দেয় কালেভদ্রে। তাই বলে পাঁচ টাকা!  
যুদ্ধের পর সেইবার দেশে খুব আকাল; যেবার, বাজারে চাল নেই, ক্ষেতে ধান নেই, ঘরে ঘরে খাবার নেই সেবার তার জন্ম। তাই বাপ নাম রেখেছিল নিদান। পরের বছর নিদান শুনে তার বয়স একবছর পূর্ণ হয় কী হয় নাই, শেখের ব্যাটাও মরলো, আর চৌধুরীর খেতে ধান কাটতে গিয়ে সুস্থ বাপ ফিরে এলো চারজনের কাঁধে করে লাশ হয়ে। গ্রামে রিলিফ এলো বটে, কোনো পুরুষমানুষ নাই বলে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার চাল আনতে পারলো না ঘরে। তারপর তো এর-ওর ফুট ফরমায়েশ খাটা এই হেলাফেলার জীবন। অপ্রত্যাশিত পাঁচ টাকা পেয়ে চোখে পানি এসে যায় নিদানের। সেই চোখের পানি দেখে কী হয় লোকটার নিদানকে সাথে নিয়ে আসে নিজের বাসায়।    

এইবারই প্রথম নিজের শহরে নিউফিল্ডে মর্জিনার নাচ দেখে সে বসে বসে। লোকজন সিটি বাজালে, টাকা ছুড়ে মারলে, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করলে তার বরং গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে, এই বেহেশতের হুরের অধিকারী সে একা। এতোদিন আশেপাশে ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী কতো জায়গায় যেতে হয়ছে তার মর্জিনার পিছন পিছন। নিজের ব্যবসার কিছু ক্ষতি হয় বটে, মর্জিনার নেশা সে ছাড়তে পারে না। অপেরার অধিকারীরাও জানে নিদান মর্জিনার নাগর। তাই ওর আসা যাওয়া থাকা খাওয়া নিয়ে তেমন চিন্তা নেই অপেরার অধিকারীদের। যাত্রাপালা শুরু হবার আগে শহরের হোটেলে বোরকা পরে গরুর মাংস দিয়ে পেটপুরে খেয়ে নিদান আর মর্জিনা সিনেমাহলে শাবানার সিনেমা দেখে। বৌরানি সিনেমায় শাবানার দুঃখ দেখে কাঁদতে কাঁদতে হাতের রুমাল ভিজিয়ে ফ্যালে মর্জিনা। নিদান হাসে। এই বে-আক্কেল মেয়ে মানুষটা ছাড়া তার জীবন বৃথা। মতি কবিরাজ যতোই বলুক, নারীজাতি থেকে সাবধান। যতোই তার মা বেঁকে বসে থাকুক নর্তকী বউ ঘরে তুলবে না, যতোই মর্জিনার শো শেষে শহরে ফিরে জানুক তার টেন্ডার বেহাত হয়ে গেছে, তবু শাবানার দুঃখে তার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদা এই নারীকে ছাড়া সে বাঁচবে না।

লোকটার সাথে সাথেই এরপর থেকে নিদান। গ্রামের সরকারি প্রাইমারি স্কুলে বর্ণমালা আর বানান করে পড়তে শেখা নিদান লোকটার সাথে থেকে অনেক কিছু শিখে নেয়। টেন্ডার ওঠানো-জমা দেয়া, সন্ধ্যাবেলা জায়গামতো ইলিশমাছ আর দৈ নিয়ে গিয়ে টেন্ডার বাগানো, নদীর বাঁধে রাতের অন্ধকারে কয়েক বস্তা বালি ফেলে কয়েক হাজার বস্তার বিল ওঠানো আর ইন্সপেকশন এলে সব পানির তোড়ে ভেসে গেছে প্রমাণ করা খুব কাছে থেকে দেখে শিখে নেয় সে। পড়া শিখে স্কুলের পরীক্ষা পাশ দেয়ার চেয়ে এই শেখা যে অনেক কার্যকরী প্রতিদিনই তার এই উপলব্ধি গাঢ় হয় তার। একসময় লোকটার ব্যবসা আরো বিস্তৃত হয়ে গেলে কিছু কিছু কাজ সে নিদানের ওপরেই ছেড়ে দেয় পুরাপুরি। নিদানও কাজগুলো সম্পন্ন করে সুনিপুণভাবে।

শহরে তেমন বন্ধুবান্ধব না জুটলেও মতি কবিরাজের দোকানে সে হাজিরা দেয় নিয়মিত। কতো রাজা-উজির মারে সেখানে, আরও গোটা পাঁচেক লোক জমে। এই এরশাদ সরকার এভাবে সর্বোচ্চ কতোদিন টিকতে পারে। আট দলীয় জোট আর পনের দলীয় জোট ইলেকশান না করলে কী বিপদে পড়বে ব্যাটা এরশাদ।  রাজনীতির এসব মারপ্যাঁচ নিয়ে মাথাব্যথা নেই নিদানের। তবে এই উত্তেজিত আলোচনা শরীর-মন চাঙ্গা করে দেয়, অবসর সময়টাও বেশ কেটে যায়। আর প্রতিবার টেন্ডার জমা দেয়ার আগে হাত দেখানোর ব্যাপারটাতো আছেই। মতি কবিরাজ হাসে, ব্যাটা তোর রোগ হইয়া গেছে গা। দেখলে তো আমার কথা, কেমন অর্জুনের বাণ! এক অক্ষরও ভুল হয় না। প্রতিবারই সে বলে, যা ঈশ্বর সহায়, মিস নাই। কিন্তু মিস যে হয় না তা নয়। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রচুর বেড়ে গেছে লাইনে। মিস হবার খবরগুলো মতি কবিরাজকে জানিয়ে বিব্রত করতে চায় না সে। আসল যে ভবিষ্যৎবাণী মতি কবিরাজের, যে ভবিষ্যৎবাণী সেই রাত থেকে তাকে আজ পর্যন্ত টেনে এনেছে তাতো ভুল হয় নি।

সেবার প্রেসিডেন্ট এরশাদ শহরের থানা জামে মসজিদে এসে জুম্মাবার নামাজ পড়ার স্বপ্নের কথা আগের দিন রেডিও টিভিতে ঘোষণা করলেও, মসজিদ সংস্কারের কাজ শুরু হয়ে যায় মাসদুয়েক আগেই। লোকটা মাসব্যাপী সিমেন্ট পালিশ করা, রং করা, নকশা করা ইত্যাদি কাজ সেরে সেই জুম্মাবারে হঠাৎ বাথরুম থেকে ফিরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান ঘরে। ধরাধরি করে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিলেও জ্ঞান আর ফেরে না তার। সেদিন অফিসপাড়া, সার্কিট হাউস থানা জামে মসজিদ সব অফিসার আর নতুন দলের নতুন নেতাদের বদলি, বিদেশ ভ্রমণ, পদ আর নমিনেশন বাগানো ইত্যাদি নানামুখী তদবিরের আতরের গন্ধে ভুরভুর করলেও লোকটার বাসায় আগরবাতি লোবানের গন্ধে ভাসে অকূল অনিশ্চয়তা কতোগুলো জীবনের।  গরম পানিতে বরইপাতা ভেজানো হয়। করুণ মিহি সুরে কোরান খতম হয়। আর এরশাদ হেলিকপ্টারে উঠে চলে গেলে থানা জামে মসজিদে জানাজা পড়ে আত্মীয়-পরিজন পাড়া-পড়শির কাঁধে করে লোকটার গন্তব্য হয় শেষ গন্তব্যে।
 
অতপর দুই নাবালিকা কন্যা নিয়ে লোকটার বউ মধ্যসমুদ্রে দিশা হারিয়ে ফেললে নিদান অপরিণত হাতেই হাল ধরে। পড়িমরি দৌড়ে তার বকেয়া সমস্ত টেন্ডারের বিল আদায়ের জন্য ইলিশ মাছ, দৈ, নগদ টাকা যখন যেখানে যা প্রয়োজন হয় দিতে কার্পণ্য করে না। এবং অতপর সব আদায় করে সততার সাথে স্ত্রীর কাছে সব হস্তান্তর করে। বিনিময়ে লোকটার সবধরনের কন্ট্রাক্টরির লাইসেন্সের মালিক হয় নিদান। অতপর এই অল্পবয়সী সুন্দরী স্ত্রী দুই নাবালিকা সন্তানসহ কই থাকবে এ নিয়ে দফায় দফায় শ্বশুরবাড়ি বাপেরবাড়ি মিটিংয়ের পর বাপের বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে লোকটার স্ত্রী যখন সুযোগ হয় ফেরত নেবে কিংবা সুযোগ হলে উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করবে শর্তে বাড়িখানা নিদানকে হস্তান্তর করে বাপের বাড়ি চলে যায়।  

শহরে এসে ভরা সংসারে পা রাখা বাড়িটা যখন খাঁ খাঁ করে, নিদানের তখন মায়ের মুখটা মনে পড়ে, মনে পড়ে মাটির দাওয়ায় বসে থাকা তার এলো চুল আর উদাস দুঃসহ দৃষ্টির কথা। একদিন কেজিকয় চিনিগুড়া পোলাওয়ের চাল, গরুর মাংস আর রাতা মোরগ, ইলিশ মাছ আর দৈ নিয়ে গ্রামের পথ ধরে সে। পুরো নৌকার রাস্তা ততোদিনে আধা পাকা হয়ে গেছে। শহরে পৌঁছানোর প্রায় অর্ধেক সময়ে গ্রামে পৌঁছে যায় সে। ঘাট থেকে বাড়ি অবধি হাঁটা রাস্তায় সবাই ঘুরেঘুরে দেখলেও নিদান সবার দৃষ্টিতে দেখে তাকে না চেনার পলক। ছয় বছরে তার বয়স বেড়েছে, বেড়েছে শরীরের আকার আয়তন। চেহারা আর পোশাক-আশাকে শহরের নকল জৌলুস। বাড়ি ঢুকে মাকে ডাকলে, তার মা এক অবিশ্বাস্য ত্রস্ততায় বাইরে এসে কেমন তব্দা খেয়ে যায়! নিদান দেখে ছয় বছরে তার মায়ের বয়স তিরিশ থেকে ষাটে পৌঁছে গেছে।

রামপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে নানারকম দুশ্চিন্তায় তার পা চলতে চায় না। কালই পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে বিল পাশ করে, ব্যাংক থেকে আরও কয়েক লক্ষ টাকা উঠিয়ে মর্জিনার বাড়ি গিয়েছিলো সে সন্ধ্যায়। সপ্তাহখানেক আগে নদীর বাঁধে বালির বস্তা ফেলার টেন্ডার। কয় বস্তার অর্ডার হলে কয় বস্তা ফেলতে হয়, ব্যাপারটা তার আগেই জানা। এবার লাভ হয়েছে তিনগুন। বাড়ির দামটা এবারই পুরোপুরিভাবে মিটিয়ে দেয়ার কথা। মর্জিনার বাড়িতে রাত বেশি হয়ে গেলে বেশ খানিকক্ষণ গুড়ুম গুড়ুম পূর্বাভাস দিয়ে দুনিয়া ভেঙে বৃষ্টি নামে। বছরকয় পার হয়ে গেলেও গ্রাম থেকে আসা মা শহরের বাতাস তখনো একদমই হজম করে উঠতে পারেনি। গ্রামের সম্ভ্রমহীন ফাঁক-ফোঁকরের ঘরে দীর্ঘদিন একা থাকলেও শহরের দেয়াল ঘেরা নিরাপত্তায় একা একা থাকতে ভয় পায়। পথের নানা বিপদের কথা আঁচ করে টাকাটা মর্জিনার বাসায় রেখেই বাড়ি ফিরেছিল সে।  

আজ সকালে এই নদী ইন্সপেকশনের জন্য ঢাকা থেকে প্রতিনিধিদল আসার কথা। কন্ট্রাক্টর হিসাবে তারও উপস্থিত থেকে ব্যাখ্যা করার কথা বালির বস্তার পরিমাণ আর অবস্থান। কিছুটা ঝামেলার তো বটেই। তারাও সব বোঝে। ফলে ভালো পরিমাণই গুঁজে দিতে হয় হাতে। প্রস্তুতও ছিলো সে। এর মাঝেই কাল রাতে অঝোর বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সব ভেসে গেছে। শহরবাসী যখন দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম, তখন নিদান স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ঘুমিয়েছে। যাক বাবা, ইন্সপেকশনের মুখোমুখি হতে আর কোনোই ঝামেলা রইলো না। যতো লক্ষ বস্তা বালি ফেলুক এই পানির তোড়ে সব ভেসে যেতে কয়েক মিনিট!

এ পর্যন্ত ঠিকঠাকই ছিলো। সে জানতো শহরের বাঁধ হুমকির মুখে পড়লে শহরতলী দিয়ে বাঁধ কেটে শহর রক্ষা করা হয়। প্রতি বর্ষায় এ এক বাধা কাজ। এতে বাঁধের নিচে ছাউনি বানিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করা ছিন্নমূল মানুষগুলো আবার ছিন্নমূল হয় বটে। তা কারোরই তেমন মাথাব্যথার কারণ নয়। মুখে স্নো-পাউডার মাখা আলগা সাদা লাগার মতো বানানো শহর তো ঠিক থাকে। ছিন্নমূলরা তো ছিন্নমূল। আবার অন্যত্র ঠিকানা খুঁজে নেয়। এরা সর্বত্র অস্থায়ী। দুনিয়ায় মানবজন্মই তো অস্থায়ী। প্রতিবছর ছিন্নমূল নিঃস্ব মানুষগুলোর অসহায় অশ্রুসজল চেহারার সাথে নিজের চেহারার অদ্ভুত মিল আবিষ্কার করে এভাবেই নিজেকে সান্ত¡না দেয় নিদান মিয়া।

কিন্তু এবার বুঝি নিদান তার ঘাড়েই। রামপুর ঘাটে দাঁড়িয়ে যতোদূর চোখ যায় কেবল পানি আর পানি। কে বলবে এখানে একটা গ্রাম ছিল, গ্রামের নাম ছিল রামপুর। সেই গ্রামে কিছু মানুষ ছিল। মানুষদের মধ্যে তার প্রেমিকাও ছিল। প্রেমিকার কাছে গচ্ছিত ছিল তার শহরে স্থায়ী হবার সর্বস্ব আয়োজন! 
আশেপাশে বেঁচে যাওয়া শহরের কৌতুহলী মানুষের কমতি নেই। প্রশাসনের লোকজনও আছে। কিন্তু কেউ জানে না এই থৈহীন পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া গ্রামের মানুষগুলো কোথায় গেছে। জনাকয়েককে জিজ্ঞেস করে হতাশ হয় সে। বরং বিরক্ত হয় তারা। নিদান পা বাড়ায় স্টেডিয়ামের দিকে। নিউ লক্ষ্মী অপেরার অধিকারী যদি জানে কিছু। হঠাৎ মনে হয়, গতকালই তো অশ্লীলতার অভিযোগে কার্নিভালের যাত্রা সার্কাসের সব প্যান্ডেল ভেঙে দিয়েছে পুলিশ। দিনে দিনেই সবাই শহর ছেড়ে চলে গেছে। এ নিয়ে বেশ মনখারাপও ছিলো মর্জিনার। বাপ মরে যাওয়া হাভাতে দিনগুলোর মতো বিভ্রান্ত লাগে নিজেকে! কী করে কী করে এখন নিদান। মতি কবিরাজের কথা মনে হয় এই নিদানকালে। তার কথাতেই একদিন নিজেকে নিয়ে জুয়া খেলায় নেমেছিল সে, শহরমুখো নৌকায় চড়ে। মতি কবিরাজ বলেছিল বটে নারীজাতি থেকে সাবধান, আজ এই নিজস্ব নিদানের মুখোমুখি সে আবার মতি কবিরাজের দোকানমুখী হাঁটা দেয়।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪১ ঘণ্টা, জুলাই ০১, ২০১৮

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।