ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

‘সময়ের গান অসময়ের কবিতায়’ নূর-মিলনের স্মৃতিচারণ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১৮
‘সময়ের গান অসময়ের কবিতায়’ নূর-মিলনের স্মৃতিচারণ সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, ছবি: জিএম মুজিবুর

ঢাকা: বাবা-মা দু’জনেই শিক্ষকতা করতেন। একটা মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা সাধারণ মানুষের খুব পরিচিত ‘বাকের ভাই’। সেই সাধারণ পরিবার থেকে এখনকার সংস্কৃতিমন্ত্রী। দীর্ঘ এই পথচলা নিয়েই কথা বলছিলেন আসাদুজ্জামান নূর।

বৃহস্পতিবার (০৮ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকা লিট ফেস্টের ‘সময়ের গান, অসময়ের কবিতা’ শীর্ষক সেশনে তিনি স্মৃতিচারণ করেন। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন।

শৈশব আর বেড়ে ওঠা নিয়ে কথা বলেন তিনিও। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কবি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামীম রেজা।

অনুষ্ঠানে নিজের স্বপ্ন নিয়ে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ছোটবেলায় তখন খুব বড় কোনো স্বপ্ন দেখতাম না। সবকিছু করতাম। একবার আমরা তিন বন্ধু মিলে ভাবলাম কবিতা লিখবো। তখণ ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। তো কবিতা তো আর ঘরে বসে লেখা যায় না! তাই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। কবিতা লেখার জন্য রেললাইন ধরে চলে গেলাম ধান ক্ষেতে! অবশেষে লিখলামও। তবে দুঃখ, সেই কবিতা আমরা তিন বন্ধু ছাড়া আর কেউ পড়েনি।

‘১৯৬২ সালে আমি মেট্রিক পাস করি। তখন আমরা আসলে অনেক কিছু করতাম। আমরা তিন বন্ধু মিলে একটা হিন্দি ফিল্ম ১৬ বার দেখেছিলাম। তখনকার অবস্থা বলতে গেলে- বলতে হয়, সবই হয়, কিন্তু লেখাপড়াটা হয় না। ’

মায়ের মমত্ব নিয়েও স্মৃতিচারণ করে কথা বলেন দেশ বরেণ্য এ নাট্যকার। বলেন, ছোটবেলার অনেক স্মৃতি আছে। মা তখন কাসার গ্লাসে করে সকাল বেলা গরম চা করে দিতেন। সেই উষ্ণতাটা এখনো খুঁজে ফিরি।

‘বাকের ভাই’ বলেন, আমার তখন ঢাকা আসার খুব ইচ্ছে। কিন্তু বাবার ইচ্ছে রাজশাহী। এরপর ১৯৬৬ সালে ঢাকা আসি। বাবার সঙ্গে যুদ্ধ করেই আসি বলা যায়। বাবার মতামত ছিল, পৃথিবীর সব বড় মানুষগুলো আইনজীবী। তাই বাবার ইচ্ছে ছিল আমিও আইনে পড়ি। কিন্তু আমি তো অন্যরকম...! তাই বাবার সঙ্গে কথা বললাম, রাজশাহী নয়, আমি আইনেই পড়বো, তবে ঢাকাতে। আসলে এটারও মূল কারণ সংস্কৃতির জন্য। অন্তত ঢাকাতে আসতে পারলে সবাইকে কাছ থেকে দেখতে পাবো।

নেতা না-কি অভিনেতা? এমন প্রশ্নের জবাবে সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, অনুভবের জায়গা থেকে কথা উঠলে বলবো- এখন নাটক করছি। গ্যালিলিও নিয়ে মঞ্চে ফিরেছি। জীবনে ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, ডিবেট, নাটক, ফুলের বাগান, রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ সবই করেছি। তাই কোনোটাই ঠিকঠাক করা হয়ে উঠেনি। তবে যেদিন নাটক করে বাড়ি ফিরি, আমার স্ত্রী পরীক্ষা করে দেখেছে, আমার প্রেসার সেদিন একদম ঠিকঠাক থাকে। অথচ অন্যদিন প্রেসার হাই। আবার রাজনীতিতে মানুষের যে ভালোবাসা, মানুষের জন্য কিছু করতে পারার যে আনন্দ, তা অনন্য। সত্যি বলতে দু'’দিকেই একটা আনন্দ আছে, প্রাপ্তি আছে।

ভালো কাজ পেলে নতুন চলচ্চিত্রে আসবেন কি-না, এমন বক্তব্যে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, চলচ্চিত্রের জন্য যে সময়টা দিতে হয়, সেটা একটু কম! আর একটা ভীতি কাজ করে; অতোবড় একটা পর্দায় পাঁচ ফিট মানুষকে কতোটুকু দেখাবে!

তিনি বলেন, খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঋতুপর্ণ ঘোষ অনেকবার বলেছে, ওর সঙ্গে কাজ করার জন্য। কিন্তু করতে পারিনি, এজন্য এখন দুঃখ লাগে। আগামীতে সেভাবে সুযোগ পেলে বা ভালো কাজ সামনে আসলে অবশ্যই করবো। তবে আমি ছবি দেখি অনেক। দেশের বাইরে গেলে একদিনে চারটি ছবিও দেখেছি। আর এক্ষেত্রে কোনো বাধ-বিচার নেই। সালমান খানের দাবাং থেকে পিংক সবই দেখি!

জীবনের প্রাপ্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে মহান এ মানুষটি বলেন, ঢাকায় আসার পর সব থেকে বড় প্রাপ্তি হলো, অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। এদের মধ্যে সত্যেন সেন অন্যতম। তিনি যা বলতেন, তাই করতেন। তিনি কখনও ইস্ত্রি করা জামা পরতেন না, হাতে ধোয়া জামা পরতেন।

‘একবার সত্যেন সেন আমাকে একটি বইয়ের ১০টি কপি বিক্র করতে বললেন। আমি নিলামও। তখন বাসা থেকে টাকা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। কিভাবে যে চলি নিজেও জানি না। মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এসে ঘুম থেকে একটু দেরি করে উঠি, যেনো সকালের খাবারটা না খেতে হয়। তো সত্যেন দা’র বই বিক্রি করে টাকা খরচ করে ফেলেছিলাম। অনেকদিন তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। পরে দেখা হলে তিনি বললেন, ‘কি আর করবি! তোরও দরকার, আমারও দরকার, কি আর করা যায়!’

এছাড়াও অন্যদের মধ্যে ওয়াহিদুল হক, কাইয়ুম চৌধুরীসহ আরও অনেকে আছেন। জীবনে রাজনীতি-নাটক না থাকলেও এই মানুষগুলোর সহচার্যগুলোকেই জীবনের সব থেকে বড় প্রাপ্তি ও অর্জন হিসেবে মেনে নেবো।

আয়োজনে কথা বলেন, দেশের অন্যতম কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনও। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, পদ্মাসেতুর কাছে মেদিনিমণ্ডল গ্রাম আমার। ১০ ভাই-বোনের মধ্যে বড় হয়েছি নানির কাছে। আমাদের গ্রামে বর্ষাকাল মানে ছয় মাস। নৌকা ছাড়া কোথাও যাওয়া যেতো না। তখন নানি বই পড়ে গল্প শোনাতেন। বই শেষ হয়ে গেলে বানিয়ে বানিয়েও গল্প বলতেন তিনি। তখন ওই যে নানি মনের মধ্যে গল্পের একটা রেশ তৈরি করে দিয়েছিলেন, সেটা কাজে লেগেছে ভীষণ।

তিনি বলেন, ছোটবেলায় আমি কেমন যেনো ছিলাম। ফুটবল মাঠে ৯০ মিনিট দৌড়াদৌড়ি করেছি, একবারও বল ছুঁতে পারিনি। ক্রিকেটেও একই অবস্থা। সাইকেল চালনাও। তখন গিয়ে লাইব্রেরিতে বসলাম। লাইব্রেরিতে একজন আসতো। এরপর সে আবার লেখালেখিও করতো। তো সে একদিন তার প্রকাশিত একটা লেখা নিয়ে এসে খুব গর্বের সঙ্গে সেটা আমাকে দেখাতে লাগলো। তখন ভাবলাম, আমিও তো কিছু লিখতে পারি।

এসময় লেখক তার ‘পরাধীন'’ উপন্যাস সম্পর্কে বলেন, ইউরোপ-আমেরিকায় গেলে আকাশে ডলার উড়তে থাকে, হাত বাড়ালেই একজন সুন্দর নারী এসে যাবে এই ধারণাগুলো আমাদের থাকলেও তা আসলে পুরোপুরি ভুল। বরং বাস্তবতা হলো, সেখানে বারে গেলেও রঙ দেখে বের করে দেবে, পদে পদে অপমান, যেখানেই পা ফেলি, মনে হয় এ দেশটি আমার না, পায়ে যেনো শিকল বাঁধা।

বর্তমান সময়ের বইপড়া নিয়ে তিনি বলেন, একটা সময় মানুষ বই পড়তো। এখন অবশ্য সেটা কমে গেছে। এসময় তিনি মজা করে বলেন, এখন কিছু লিখে বাড়িতে পড়তে দিলেও বড় মেয়ে পৃষ্ঠা উল্টে বলে ৫০০ টাকা দাও, এটা পড়তে তো আমার সময় লাগবে!

মিষ্টি মধুর আলোচনা শেষে সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরুল দীনের সারা জীবন’ এবং কবি তারিক সুজাতের ‘হলি আর্টিজান’ নিয়ে কবিতা আবৃত্তি করেন আসাদুজ্জামান নূর।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০১৮
এইচএমএস/টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।