এই কবির নাম আস্কর আলী পণ্ডিত ও তার দুটি কাব্য-‘জ্ঞান চৌতিসা’ও ‘পঞ্চসতী প্যারজান’। ‘পঞ্চসতী প্যারজান’ মূলত প্রণয়কাব্য হলেও ‘জ্ঞান চৌতিসা’য় প্রণয় কাহিনীর আশ্রয়ে মরমি বা আধ্যাত্মিক দর্শনের চর্চা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ড. আহমদ শরীফ বলেছেন, “দেশজ বৌদ্ধ হিন্দু যোগতন্ত্র প্রভাবিত সুফীবাদেও সঙ্গে শরিয়ত সম্মত ইসলামের এবং স্থানীয় লৌকিক বিশ্বাস, আচার-সংস্কারের অসংগত মিশ্রণ-সমন্বয়ে এক লৌকিক ইসলামই ওয়াহাবী-ফরায়েজী আন্দোলনের পূর্বাবধি বাংলাদেশে প্রজন্মক্রমে চালু ছিল। ”
মুসলমান সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণকারী লোকসাধারণ এবং কবি বা চিন্তকরাও এই ধারাতেই পথ চলেন। এর অন্যতম কারণ নির্দেশ করে ড. শরীফ বলেছেন, “কোরআন-হাদিস অনুগ বিশুদ্ধ ইসলাম বিশ্বাসে ও আচরণে মানাসম্ভবও ছিল না দুটো কারণে। প্রথমত, শাস্ত্র ছিল আরবী ভাষায় লিখিত, বিদেশীর বিভাষা আয়ত্ত করা বিদ্যালয়-বিরল। সে যুগে ক্বচিৎ কারুর পক্ষে সম্ভব ছিল। আলিম মৌলভী আজও সর্বত্র শত শত মেলে না। দ্বিতীয়ত, স্থানীক কালিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক যে পরিবেশে মানুষ আশৈশব লালিত হয়, তার প্রভাব এড়াতে পারে না। শাস্ত্রীয় গোত্রীয় ও স্থানীয় ঐতিহ্যের আচার, সংস্কারের মিশ্র ও সমন্বিত প্রভাবেই মানুষের মন-মনন, আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে বাঙালির ধর্ম সাধারণভাবে বিশুদ্ধ নয়, যাতে রয়েছে মাদুলী, তাবিজ, দোয়া, ঝাড়-ফুক, তুক-তাক। ”
বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত মধ্যযুগে রচিত মুসলিম সাহিত্যেও ড. শরীফ নির্দেশিত কারণেই হিন্দুর যোগতত্ত্বের মিশ্রণে যোগ কালন্দর নামে এক ধরনের সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছিল। যোগ কালন্দর ধারারই অন্তর্গত ‘জ্ঞানচৌতিসা’। এই ‘জ্ঞান চৌতিসা’ নামে সৈয়দ সুলতান প্রমুখ কবিরা সে যুগে যেসব কাব্য রচনা করেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় এ যুগেও আস্কর আলী পণ্ডিতের (১৮৪৬-১৯২৭) ‘জ্ঞান চৌতিসা’ রচিত।
১৯৫১ সালে ‘জ্ঞান চৌতিসা’প্রথম মুদ্রিতরূপে প্রকাশিত হয়। এতে বুঝা যায়: বিশ শতকের গ্রামীণ পাঠকদের কাছেও এর সমাদর রয়ে গেছে এবং এই গ্রামীণ পাঠকরাই বাংলা কাব্যের মূলধারাটিকে আজও রক্ষা করেচলেছেন।
শামসুল আরেফীন ১৯৫১ সালে মুদ্রিত ‘জ্ঞান চৌতিসা’সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। নব প্রকাশিত জ্ঞান চৌতিসার ভূমিকায় শামসুল আরেফীন লিখেছেন, “আস্কর আলী পণ্ডিতের‘জ্ঞান চৌতিসা’ মধ্যযুগে রচিত নয়। কেননা তিনি মধ্যযুগের কবি বা লোককবি নন। বাংলা সাহিত্যের অবক্ষয় যুগের শেষ প্রান্তে পণ্ডিতের জন্ম (১৮৪৬)”।
কোন কোন গবেষক অবক্ষয় যুগের সময়সীমা ১৭৬০-১৮৩০, আবার কোন কোন গবেষক ১৭৬০-১৮৬০ বলে উল্লেখ করেছেন। প্রথমোক্ত সময়সীমা সত্য স্বীকৃত হলে অবক্ষয় যুগের শেষপ্রান্তে পণ্ডিতের জন্মের কথাযথাযথ নয়। কিন্তু এ কথা যথাযথ হোক বা না হোক অবক্ষয় যুগ পেরিয়ে যাবার পরই তিনি ‘জ্ঞান চৌতিসা’ পুঁথি রচনা করেন। তার জীবদ্দশায় এটি প্রকাশিত হয়নি। ”
শামসুল আরেফীন সম্পাদিত আস্কর আলী পণ্ডিতের ‘জ্ঞান চৌতিসা’ ও ‘পঞ্চসতী প্যারজান’ পুঁথিতে মূলধারার কবিতার সন্ধান পাওয়া গেছে। এই গবেষকের অনুসন্ধিৎসায় আস্কর আলী পণ্ডিতের মতো বিস্মৃতপ্রায় কবিরপরিচয় উদ্ঘাটিত হয়েছে, বাংলা সাহিত্যে গবেষণার জাড্য দূর করতে যত্নবান হয়েছেন তিনি।
যতীন সরকার: স্বাধীনতা পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ড. এনামুল হক স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত লেখক ও গবেষক।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৮
এসি/