এলাকায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির বেশ সুখ্যাতি থাকায় বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাশ করা সিরিয়ালে প্রথম দিকের স্টুডেন্ট সব এখানে ভর্তি হয়। এখনও সে রেওয়াজ চালু আছে এবং প্রতিযোগিতা আগের চেয়ে বেড়েছেও শুনেছি।
গ্রাম এলাকায় এমন একটি বিদ্যালয়ের ছাত্র হতে পারাটাও বেশ গর্বের তখন। তেমনি গর্বের বস্তু ছিলো নতুন ক্লাসে উঠে পঞ্চম শ্রেণিতে সবে ছয়টি বই পড়ার অভ্যস্ততা কাটিয়ে একবারে নয়টি বই বগলদাবা করে স্কুলে যাওয়া। এ যেন দেখ কত বড় হয়ে গেছি একটা ব্যাপার-সেপার।
কিছু দিন পরেই এই ভালো লাগার অনুভুতিগুলো ভোঁতা হতে শুরু করে যখন প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় পরীক্ষার হলে স্কেল বক্স (জ্যামিতি বক্স) নামক বস্তুটি বেশ কয়েকজনের সামনে দেখি।
টিনের লালরঙের এই বাক্সটির উপর কম্পাস হাতে চিত্রাঙ্কণরত কালো রঙের লোকটির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় যখন আমি পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিই তখন। তখন প্রয়োজনীয়তা ততোটা অনুভব না করলেও এখন আর তর সইছে না। আমারও যে একটা চাই।
আব্বুকে বুঝাতে চাইলাম এটা ছাড়া পরীক্ষা দেওয়াই সম্ভব নয়। ইত্যাদি, ইত্যাদি। আব্বু দাঁত খিটমিট করে কি যেন বললেন মনে করতে পারছি না এখন। তবে কিনে দিতে পারবেন না সেটা সাফ জানিয়ে দিলেন উচ্চস্বরে। তার সেই স্বর আমাকে বুঝিয়ে দিলো এই বক্স আমার জন্য নয়। না আজ, না কাল।
বার্ষিক পরীক্ষার কিছুদিন আগে হঠাৎ একদিন দেখলাম আমার বেশ কাছের দু’একজন বন্ধু স্কুলের মাঠের কোণায় কি নিয়ে যেন খেলছে গোল হয়ে। এগিয়ে গিয়ে যা দেখলাম তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। ম্যাগনিফাইং গ্লাস- যেটাকে আমরা আতশ কাঁচ বলি। মনে হলো জাদু দেখছি।
সূর্যের ঠাঁটানো রোদে বন্ধুরা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে আগুনের ধোঁয়া তৈরিতে ব্যস্ত। তার রেশ থাকতেই টিফিন পিরিয়ডের পর ক্লাসে ঢুকে দেখি সেই বন্ধুটি তার সেই জাদুর গোল কাঁচটি যে বাক্সে রাখলো সেটি আর কিছু নয়। আমার স্বপ্নের জ্যামিতি বক্স।
কি চকচকে নিখুঁত আর সুন্দর স্কেল, কাঁটা কম্পাস, রাবার, পেন্সিল কাটার, চাঁদা, ত্রিভুজ। তবে টিনের নয়। ভিন্ন ধরনের ফাইবারে বানানো জ্যামিতি বক্স। এটি- দেখতেও অসাধারণ।
আমার স্বপ্ন একটা টিনের জ্যামিতি বক্স যদি আমার থাকতো, অথচ এই নতুন ধাঁচের বক্সটি দেখে কেন যেন মনটা বিষিয়ে উঠলো। আব্বুর দাঁত খিটমিট করার দৃশ্য আর চেঁচানোর দৃশ্য তখনও স্পষ্ট। টিনের বক্সের চেয়ে নিশ্চয়ই এটির দাম আরও অনেক বেশি হবে। তাই স্বপ্নটা টিনের বক্সেই সীমাবদ্ধ রাখলাম।
অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা দেবো। এবার তো আব্বুকে বললে একটা কিনে দেবেই। তাছাড়া জ্যামিতি আঁকতে তো লাগবে। অন্যেরটা তো সবসময় নেওয়া যায় না। আব্বুর সোঁজা যুক্তি- সবাই তো বৃত্তি পরীক্ষা দিচ্ছে না, তাদের কারোটা নিয়ে যাও। মনটা আবার খারাপ হলো। মনে হলো যখন পড়ালেখা করব না তখন মজা বুঝবে!
কার মজা কে বুঝবে সেটা পরে বুঝলেও তখন তো বুঝতাম না। রাগে গজগজ করলেও তা প্রকাশ করলাম না মার খাওয়ার ভয়ে। আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম এটি আমার কেনা হবে না কখনও।
স্কুলের পড়াশোনা শেষ হয়ে এলো। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। আব্বুকে আর জ্যামিতি বক্সের কথা বলিনি। এসএসসি পরীক্ষার দুদিন আগে- রাতে আব্বু বাজার থেকে ফিরে সোজা আমার রুমে এসে দাঁড়িয়ে আছেন আমি খেয়াল করিনি।
খেয়াল করতেই জানতে চাইলাম আব্বু কিছু বলবেন? আব্বু কোনো উত্তর না দিয়ে আমার স্বপ্নের লাল কালো জাদুর বক্সটি আমাকে দিয়ে বললেন, ‘এই নাও তোমার জ্যামিতি বক্স। ভালো করে পরীক্ষা দিও। ’
আমি সেদিন কেঁদেছিলাম কিনা মনে নেই।
লেখক: রাজিব হোসেন। সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০২০