কখনো দরজা ঠেলতেই ঝাপটে আসে হিমলে বাতাস, কখনো গরম বাতাস, উত্তাপ মেশানো। উত্তরে, অতি কাছেই বিশাল পাহাড়, যেনো পর্বতের কোল।
উপায় ছিলো না কারও। নিরুপায় হয়ে সুচরিতার মতো বাস্তুভিটাহীন, মুহাজির, আশ্রয়হীন, অসহায় হাজার হাজার শরণার্থী বৃক্ষহীন পাহাড়ের কোলে এই বসতিটা গড়ে তুলেছে। প্রাণভয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে আসা মানুষের কাছে তখন এটাই হয়ে উঠেছিল স্বর্গ। মরণসিঁড়ি বেয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের কী আর জায়গা ছিল? শুধু দানাদানা বালি আর মাটি। সারবাঁধা ঘর, গোলপাতার চালা আর বাঁশ-বেতের বেড়া।
আজ, এ মুহূর্তের বাতাসটা মিষ্টি, মৃদু ঠাণ্ডাও। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে এলো বিছানায় গড়া দিতেই। খাট-তোষকছাড়া কাঁথা বিছিয়ে মেঝের চাটাইয়ে শুতে হয়। জীর্ণ বস্ত্রে প্রস্তুত মোটা শীতবস্ত্র চড়াতে হয় গায়ে। বিষয়টি ভীষণ পীড়া দেয় ওকে।
বিরাট গৃহস্থের আদরের একমাত্র মেয়ে সুচরিতাই এখন যেনো ভিখিরি। কীই বা বয়স? আঠারো বছরের হৃদয়ের ছাতায় কঠিনসব জীবনপরীক্ষায় উতরাতে হয়েছে। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে কত কী যে জমা হয়েই চলছে হররোজ। স্বামীর আদরসোহাগ ঠিকই একমুহূর্তের জন্যও চোখ থেকে নামে না। চমৎকার গড়ন আর হলুদ-নীল শাড়িতে দারুণ নাকি মানাতো। শ্যামল রঙের হলেও দেহগড়নের সৌষ্ঠব আর ওর উজ্জ্বল চোখ দুটি ভীষণ কাবু করতো দেবকান্ত রায় দেবুকে। বিয়ের পর লম্বা চুমোয় স্ত্রীকে আদর করতে করতে দেবু বলেছিলো, ‘তুমি এতো সুন্দরী কেন, সুরু?’
‘যা, কী যে বলো, তুমি কম কিসে? পাত্রী দেখতে গিয়ে তুমিই কী শুধু তাকাচ্ছিলে, আমি চোখাচোখি বারবার তাকাইনি? কী হ্যান্ডসাম ছেলে, যেমন লম্বা তেমন ফর্সা আর ধারালো নাক। তখন তো ছেলের আকাল ছিল। পাত্রপক্ষ থেকে বার্তা পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় আমাদের পরিবারতো আশা ছেড়েই দিয়েছিল! এরপর সৃষ্টি হয় নানা কথা?’
‘কী কথা?’
‘আড়ালে আড়ালে প্রতিবেশীদের নাক-সিটকানো, টিপ্পনী। ঢাকায় কাকার কাছে বড় হওয়া মেয়ে হঠাৎ চলে এলো কেন? কী না কী করেছে কে জানে? পাত্রপক্ষ কেনইবা পছন্দ করবে? দেশের চারদিকে খালি গণ্ডগোল, যা দিনকাল, সোমত্ত মেয়েকে বেটাদের থেকে লুকিয়ে রাখবে কী করে? কেবল স্কুল পাস, কলেজেও পড়েনি। মেয়ের গায়ের রঙ শ্যামলা, কালো, পাত্রপক্ষের নাকি পছন্দই হয়নি। ’
‘এরপর?’
‘প্রভুকে ডাকতে শুরু করলাম। প্রেমের কবিতা পড়তাম আর ছটফট করতাম। কেন যেন- ভীষণ আকর্ষণ ছিল তোমার চোখজুড়ে। ঢাকা ছিলাম ঠিকই। কিন্তু কাকাতো সপরিবারে ইন্ডিয়া চলে গেলো, আমার কিছু করার ছিল? দোষ কী আমার?’
‘এরপর?’
‘একদিন তোমাদের বাড়ি থেকে পাত্রপক্ষের চিঠি এলো। সুখবর ছড়িয়ে পড়ল বাড়িময়। তোমাদের মতো সুনামগঞ্জ শহরে সুন্দর সাজানো বাড়িঘর নয়। গ্রামের বাড়ি তো আমাদের। গ্রাম্য রাস্তা। বর্ষায় কাদা মাখা। বাড়ির পিছনে কলাগাছ আর বাঁশঝাড়, লম্বা গোয়ালঘর। বাড়িশুদ্ধ লোকজন ঘরদোর ঝকঝক করে সাজানোর কাজে লাগলো। কিন্তু আমার হৃদয় শুধু তোমাতেই। আর কেবল প্রভুকেই ডাকি। যেন পাই। ’
‘কাকে?’
‘তোমাকে!’
চোখে নেচে ওঠে, কানে ভীষণবাজে সেসব সংলাপ। আসলে এসব করে করে মজা লুটতো দেবু। সুচরিতা যখন বুঝে উঠতো তখনতো একচোট হয়ে যেত বিছানাতেই। দেবু ওকে কীভাবে যেন জড়িয়ে ধরে শরীরজুড়ে ঝড় তুলতো, ভুলেই যেতো দেবু ওর স্বামী।
একদিন সকাল দশটায় গোসল সেরে এসেছে সুচরিতা। দেবু তখনো ঘুমে। রাতে নানান কথা, রাজনীতি নিয়েই বেশি। শহরে বলাবলি হচ্ছে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে যেতে পারে। দেবু বলেছিলো- হিন্দুদের কাছে তো উনি এক অবতার। শুধু হিন্দু বলছি কেন, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবধর্মের সবমানুষেরই একমাত্র আস্থার জায়গা বঙ্গবন্ধু। সকল স্লোগান উনাকে নিয়েই। শোনো না, তোমার নেতা আমার নেতা- শেখ মুজিব শেখ মুজিব। উনাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পশ্চিম পাকিস্তানিদের।
মাথা নিচু করে শুধুই শুনেছে সুচরিতা।
‘শোনো, আমাদেরও কাজ আছে। কেবল নেতার ওপরই সবকিছু ছেড়ে দিলে হবে না। ’ সুচরিতার উদ্দেশে কথা ছাড়ে দেবু।
‘রাজনীতি নিয়ে তো তুমি কখনো এভাবে ভাবতে না। কী হয়েছে তোমার?’
‘সুরু, সময় এসে গেছে, সাম্প্রদায়িকতার কবর দেবো। ’
দেবু হঠাৎ থেমে গেলো।
ব্লাউজের হুক আটকে থাকা শাড়িটা শরীর থেকে সরিয়ে নাইটি পরতে পরতে সুচরিতা বললো, ‘রাত অনেকে হয়েছে ঘুমোও। ’
পরদিন সকাল বেলা।
ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল সুচরিতা। ঘাড় ঘুরিয়ে বললো, ‘আর কত? বেলা তো দশ বাজে। ’
সতেজতা ও সৌন্দর্য আরো বাড়িয়েছে ওর প্রিন্টের হলুদ শাড়ি, যেন আলগা জড়ানো, পিঠের ওপর খোলা চুল। গায়ে থেকে একটু হাল্কা মিষ্টি গন্ধ উঠছে। সম্ভবত সুগন্ধি সাবানের অথবা শরীরের। এমন বয়সে এমন মিষ্টি গন্ধ হতেও পারে। আড়চোখে এতক্ষণ বউকে দেখছিল দেবু। খপ করে হাত টেনে বিছানার কোণে তুলে দেবু বললো, ‘এখন? এখন? এখন কে বাঁচাবে?’
দেবুর চোখমুখ পড়ে সুচরিতার বুঝতে দেরি হয় না স্বামীর আচরণের হেতু। বিনয়ী কণ্ঠে বললো, ‘আর চান করতে পারবো না, প্লিজ পাগলামো করো না, কেউ দেখবে, প্লিজ!’
‘মা আসবে না, রান্নাঘরে। কেউ আসবে না। বাবা অফিসে। ’
‘উঁহু না, ছাড়ো। ’ প্রাণপণ চেষ্টায় শক্তিশালী পুরুষের হাত ছাড়িয়ে প্রায় দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে পালালো সুচরিতা।
বিয়ের এক সপ্তাহ পর একসন্ধ্যায় দেবুকে ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হলো। হাসিখুশি মুখটি কঠোর যেন। বেডরুমে চেয়ার টেনে বসতে বসতে হঠাৎ করে বললো, ‘আমি হতভাগ্য। চাকরি-বাকরি না পেয়ে ব্যবসায় নেমেছি। ব্যবসায় বহু টাকা ইনভেষ্ট। আজ ধর্মঘট তো কাল সারাদেশে হরতাল। এখন শুনছি, পাকিস্তানি মিলিটারিরা হামলা চালাবে। ’
উদ্বিগ্ন চোখে তাকালো সুচরিতা। খানিকক্ষণ নীরব থেকে বললো, ‘আমিও পেপার-পত্রিকায় আভাস পাচ্ছি, ওরা আক্রমণ করবে?’
চিন্তিত দেবু বিষন্ন মুখে বললো, ‘কী যে করি বুঝতেই পারছি না। দুয়েকদিনের মধ্যেই সমস্যা গভীর হবে। ’
‘তুমি শুনলে কীভাবে?’
‘ঢাকা থেকে ছাত্রনেতারা শহরে এসে গেছে। ওরা আমার স্টোরে এসেছিল, গল্পচ্ছলে আরো কতকিছু জানালো। তো কোনোদিনই রাজনীতির ধারকাছে যাইনি। ব্যবসার খাতা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। তাদের কথা-বার্তার ভাষায় বুঝলাম- বিপদ সামনে। কয়েকজন তো শিওর দিয়ে বলছে। ঢাকার অবস্থা খারাপ। ’
‘সবাইকে নিয়ে চলো, আমাদের গ্রামের বাড়ি। ’ সরল জবাব সুচরিতার।
হাতের সিগারেট ফেলে দেবু বললো, ‘তা তো হয় না, এটা যে সারাদেশের সমস্যা!’
মাথা নামিয়ে রাখে দুজনই।
দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সুচরিতা বলে, ‘চা বানিয়ে দিই?’
‘হ্যাঁ, কড়া লিকার দিও। ’
চায়ের কেতলি বসানোর সময় এক ধরনের স্মৃতির ধাক্কা খেল সুচরিতা। দেবুর মুখচোখ দেখে মনে পড়ে গেলো, ওর বাবাও এমন করেই দেবুর মতো হঠাৎ হঠাৎ থম ধরে যেতেন। বিয়ের আগে পাত্রের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। দৃষ্টি দেখে মনে হতো- তিনি অন্যরকম হয়ে গেছেন। কথায় কথায় উচ্চারণ করতেন- দিনকাল খুব খারাপ আসছে। নানারকম আশঙ্কার ভাঁজ পড়েছিল কপালে। শোনা যেত, পাকিস্তান ভেঙে যাবে, দু’টুকরো হয়েই যাবে। গণকের মতো তার কণ্ঠে উচ্চারিত হতো, পালাতে হবে, প্রাণে বাঁচতে চাইলে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে। তখন বিয়ের যোগ্যি মেয়েকে নিয়ে দৌড়ানো যাবে? এক গভীররাতে ওর মায়ের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া বাঁধল বাবার। ঘুম ভেঙে যাওয়ায় পাশের ঘর থেকে উঠে আড়ালে দাঁড়িয়েছিলো সুচরিতা। জীবনে কখনো কোনোকিছুর অভাব, অভিযোগ এমনকি মতবিরোধ দেখেনি এ দুজনের।
‘হাতের কাছে যে পাত্র পাবো, তার হাতেই মেয়ে তুলে দেবো। ’ কথাগুলো উচ্চারণের পর বাবার ক্রুদ্ধ কণ্ঠ আরো উঁচু হয়। ‘মেয়ে আমার, বিয়ে দেবো আমি। কোনো শালারই মতামত নেবো না। ’
ক্ষেপে গিয়ে দ্বিগুণ উচ্চারণে মা বলেন, ‘মেয়ে কী তোমার একার? আমার নয়? দশ মাস দশদিন পেটে ধরিনি? রাস্তার ছাগল-পাগলের কাছে তুলে দিয়ে দেবো? দরকার হলে বিষ খাইয়ে মারবো, নিজের হাতে বিষ খাওয়াবো। ’
‘ছেলে পেতে হবে না? ছেলে কোথায়? বহু কষ্টে জোগাড় করি আমি আর উনার পছন্দ হয় না!’ বাবার মুখ অন্যদিকে ফেরানো।
‘উঁহু, পাত্র পছন্দ না হলে সুচরিতার বিয়ে হবে না!’ রাতের আওয়াজ অনেকে দূরে যাচ্ছে- এটা দুজনই বুঝতে পারেন। কিন্তু ক্ষোভ কেউই সংবরণ করেন না।
উচ্চারণ আস্তে হলেও বিরক্তিকণ্ঠে বাবা বলেন, ‘তুমি বড় অদ্ভুত মানুষ তো! কিছুই বোঝ না। বহু চেষ্টা-তদ্বির করে একটা উচ্চশিক্ষিত পাত্র যোগালাম, বললে কিনা ছেলের বয়স পঁয়তাল্লিশ হবে। বুড়া, দামড়া। ’
হঠাৎ মায়ের কান্না শুরু হলো। কাপড়ের আঁচল মুখচোখ চেপে মা কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বলতে থাকেন, ‘সুচরিতাকে কেটে টুকরো টুকরো করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেবো। ’
কিছুক্ষণ পরই উল্টো হয়ে গেল বাবার চরিত্র। শান্ত্বনা দিতে মায়ের মাথায় হাত রাখেন। কয়েক মিনিট পর কপাল ছুঁইয়ে দেখেন, এর আরো কয়েক সেকেন্ড পর নতুন দম্পতির মতো বুকে জড়িয়ে নেন।
পিঠে কারো স্পর্শে পেয়ে সম্বিৎ ঘুরে তাকায় সুচরিতা। কাঁধ থেকে দেবুর হাত আস্তে সরিয়ে ও গম্ভীর গলায় বলে, ‘চা-চানাচুর নিয়ে আসছি। ’
‘চা আনবে কীভাবে, পানি তো শুকিয়ে গেছে। কিছু কি ভাবছিলে?’
লজ্জায় লাল হয়ে যায় মুখ, ‘ও স্যরি। যাও তুমি, এক্ষুণি আসছি আমি। ’
দু’মাস পর।
দেশে এক নতুন পরিস্থিত। ভূতুড়ে শহর। অতীতে শহরের কখনো এমন রূপ ছিল না। সকাল-বিকাল কারফিউ। শহর থেকে ফাঁকি দিয়ে বেরোবার রাস্তা খুঁজতে থাকল দেবু। গ্রামীণ জনপদ নিরাপদ মনে হচ্ছিল। সবাইকে নিয়ে কীভাবে পালানো যায়- এ চিন্তা শহরবাসীর। মূল সড়ক ধরে সরকারি গাড়ি আসা-যাওয়ার শব্দ আসে মাঝে মধ্যে। চারদিকে আতঙ্ক আর উদ্বেগ। নীরব শহরে কাক-কবুতরের ওড়াউড়ি ছাড়া কোনো শব্দ কানে আসে না। পাশের জারুল গাছে একটি কাক প্রায়ই বিশ্রী কণ্ঠে ডাকে। একদিন কাকটিও চোঁচামেচি বন্ধ করে নীরব। সেদিনই প্যান্ট-কোট পরে বাসা থেকে উধাও হয়ে গেল দেবু।
নিরুদ্দেশ হওয়ার অর্থ কেউ বুঝতে না পারলেও সুচরিতা ঠিকই আন্দাজ করেছিল। এর পরদিনই সকাল সাতটায় ঘটনাটা ঘটে। পাকিস্তানি মিলিটারিরা দল বেঁধে বাসা ঘেরাও করে। রান্নাঘরের পিছনে টয়লেট। পুরানো কাঁসার বদনাটা হাত থেকে রেখে টয়লেট ঘর থেকে বের হয়েই অবাক হলো সুচরিতা। হঠাৎ অচেনা আশঙ্কা গ্রাস করেছে, ভয়ে চক্ষু স্থির। এমনটা হতে পারে- এ আশঙ্কা থেকেই বাড়ির গেটে তালা মারা হয়েছিল। পাঁচমিনিটের মধ্যেই দেখা গেলো- পাঁচিল টপকে পাশের বাসার শার্ট-প্যান্ট পরা মুসলিম লীগ করা যুবকটি বাড়ির ভিতর ঢুকে গেটের তালা ভাঙার চেষ্টা করছে। একপর্যায়ে সে সফল তো হলোই, হাতের লোহার রডখানা রাস্তার দিকে ছুড়ে ফেললো। দেশজয় করার মতো হাসিমুখ তার। যেন এমন কাজটি করে ভীষণ তৃপ্ত সে। দু’লাফে এগিয়ে এসে দরজায় দাঁড়ালো, তার খালি পা। উৎফুল্ল চিত্তে উর্দু বাংলা মিশিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘ঘেরাও দো, ইন্ডিয়ান সাপোর্টারগো বাড়ি। জলদি করো। আভি বিউটিফুল গার্ল মিলেগা। ’
ঘেরাও করে রাখা বাড়িটির প্রতি তার প্রচণ্ড আক্রোশ, এটি বোঝা যায় দাড়িওয়ালা স্বাস্থ্যবান ওই যুবকের ভাষায়, আচরণে।
অষ্টাদশী সুচরিতা বাউন্ডারি দেয়াল সংলগ্ন কচুক্ষেতের আড়ালেই থাকলো। লুকিয়ে পড়ার মতো জায়গা ছিল ভেতরে। উপুড় হয়ে থাকলো অনেকক্ষণ।
বাড়িটি ঘেরাও করে রাখা একদল মিলিটারি রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। পিছনের বারান্দায় দরজা বরাবর আরো কয়েক জোয়ান। তাদের পাহারায় রেখে বাড়ির ভেতর ঢুকলো চার মিলিটারিসহ এক অফিসার। মুহূর্তেই ওরা সুচরিতার কিশোরী ননদ, শ্বশুর, শাশুড়ি, বৃদ্ধা গৃহপরিচারিকাসহ চোখবাঁধা ছয়জনকে টেনেহেঁচড়ে গাড়িতে তুললো। তাদের হাত পিছনমোড়া। আটকদের আর্ত-চিৎকার, কান্না, আহাজারি কিছুই ভ্রুক্ষেপ করলো না মিলিটারির দল। ঘটনাটি এতো দ্রুত গড়াতে থাকলো যে, অনুমিত হয় এটি পূর্বপরিকল্পিত। এরপর মুখটি ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো করে মুসলিম লীগের যুবকটিকে জাপটে ধরে এক মিলিটারি জানতে চাইলো, ‘ইজ ঘরমে অ্যানাদার লাভলী লড়কি কাঁহা। ’
কাঁচুমাচু করে জবাব দিলো, ‘স্যার, নেহি সমজতে। ’
‘তুমলোগ ইধার আও। ’
যুবকটির উদ্দেশে উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই তরুণ এক মিলিটারি হাত নেড়ে কাছে আসতে ইশারা করলো। ঈষৎ দূরে নিয়ে গেলো তাকে। কানের কাছে মুখ এনে কী যেন ফিসফিস করে শেখালো। হাত ও মাথা নাড়ানোর ভঙ্গি তো আছেই, একইসঙ্গে চোখমুখে উত্তেজনা। এর কিছুক্ষণ পরই সাই করে মিলিটারিদের জলপাই রঙের দুটি গাড়ি চলে গেলো। শব্দ করা হলেই কী সাঙ্ঘাতিক পরিণাম হতে পারে তা নিজের চোখে দেখেছে সুচরিতা। তাই মুখে কাপড় গুজে শব্দহীন কান্না করার উপায় ছিল না ওর। নড়াচড়া করলেই সর্বনাশের চূড়ান্ত হবে!
এরপর মুহূর্তেই গাট্টাগোট্টা দুজন অপরিচিত লোক ঘরে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে প্রবেশ করলো। ওরা বাইরে কোনো ধরনের ইশারার অপেক্ষায় ছিল যেনো। ওয়ারড্রোব, আলমিরা, ট্রাঙ্ক ভাঙার শব্দ কানে এলো সুচরিতার। অদ্ভুত শব্দমালা একের পর এক ঘর থেকে ভেসে আসছিল। কখনো উচ্চশব্দ, স্টিলের আলমিরা ভাঙার ধ্বনি, কখনো ঝনঝন। রান্নাঘর থেকে হাঁড়িপাতিলের শব্দ, কাপ-প্লেট নাড়াচাড়া বা ছুড়ে ফেলার আওয়াজ। কড়াই মেঝেয় পড়ে যাওয়ার শব্দ এলো কানে।
প্রায় তিন ঘণ্টা পর পিস্তলহাতে প্রবেশ করা দুজন বিশাল বিশাল দুটি কাপড়ের গাঁট নিয়ে বেরোলো। গেট অতিক্রম করার মুহূর্তে এদিক-ওদিক তাকিয়ে শার্ট-প্যান্ট পরা কমবয়সী গাঁট্টা লোকটি বললো, ‘ম্যালা ভার। ’
অন্যজন তৃপ্তির মুখে বললো, ‘আমার এ্যাইডাও ভার, তবে কম। বিছনার চাদর ছাড়াও দামি মাল তো, সোনা-দানা বেশি। কানপাশা, নেকলেস, হাতবালা, সিঁথির ঝাঁপটা, সোনার ব্রেসলেট হলতাই লইছি। ’ তার বয়স অনুমান করা মুশকিল, পঞ্চাশ হতে পারে আবার ষাটও। পরনে ঢোলা পাঞ্জাবি আর পাজামা।
তূলনামূলক কম বয়েসী লোকটি ঘাড় কাত করে বললো, ‘ভাইসাব, এ্যাকডা কাম করতে অইবো। ’
একটু থেমে একেঅন্যকে শোধাচ্ছে, ‘যা কিচু কথাবার্তা পরে কইমু, অংকা আওয়াজছাড়া। ’ বাসার অদূরে একটি রিকশা পেয়ে দক্ষিণের বড়সড়কের দিকে ওরা যেতে থাকলো।
চারদিক সতর্কতার সঙ্গে চোখ বুলিয়ে পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে বিস্মিত হয় সুচরিতা। তছনছ করার কারণে নিজের ঘর চিনতেই কষ্ট হচ্ছে। সকল ঘরেই ওলটপালট করা বিছানা। দ্রুত এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলো কষ্টিপাথরের কৃষ্ণমূর্তিটি নেই। ওয়ারড্রোব শূন্য, এলোমেলো বিছানা, আলমারি মেলানো, ট্রাঙ্ক উল্টানো, রান্নাঘরের বাসনকোসন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ওয়ারড্রোবের নিচে পড়ে থাকা খুচরা টাকার ছোট্ট ব্যাগটা হাতে নিলো। সম্ভবত এটা ওদের চোখে পড়েনি। সুচরিতার কানে যেনো কেউ একজন ফিসফিস করে বললো, তাড়াতাড়ি পালাও সুচরিতা। ওর কাছে মনে হলো এ সত্যিটাই মানতে হবে। দ্রুত একটি সাদামাটা কালোব্যাগে দুটি কাপড়, চামড়ার সেন্ডেল, আর ছাতা নিয়ে ত্যাগ করলো ঘর। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওর মনে হলো কোথাওতো যাওয়ার জায়গা নেই। ভাবতেই চোখ বেয়ে পানি এসেছিল। কিন্তু গোটা শহরের মানুষের এমন ঢল দেখে ওর বুকে ভরসা পেলো।
শহরে কারফিউ শিথিল করায় মানুষ ঘর থেকে বেরুচ্ছে। যেন ইঁদুরের গর্তে ছিল শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা জাতীয় মানুষগুলো। ওদের অনুসরণ করে ও। সুচরিতা যে জায়গাটিতে এসে দাঁড়িয়েছে এটি সুনামগঞ্জ শহরের লঞ্চঘাট। ভাগ্য ভাল শেষপর্যন্ত লঞ্চ পাওয়া গেল। মাঝারি আকারের জলযান। এটি ছেড়ে যাবে সাচনাবাজার। বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় অন্তরে ভরসা বাড়ে।
কেউ এভাবে পালায় না কিন্তু এর বিকল্প কিছু কী ছিল ওর! লঞ্চে জায়গা দখলের প্রতিযোগিতা নারী-পুরুষের মধ্যে। তাড়াহুড়ার সঙ্গে চেঁচামেচি, হাঁক-ডাক, বাড়তিকথা, কান্নাকাটি যাত্রীদের। তবে সুচরিতা শুরুতেই লক্ষ্য করছে, লঞ্চের স্টাফদের মধ্যে একধরনের নীরবতা। যাত্রীদের ধীরকণ্ঠে সতর্ক করছেন, মধ্যবয়সী একজন। তার গালভর্তি দাড়ি। কোলাহল সামলাতে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘আমি আবদুল্লাহ কইতাছি, মায়েরা-বইনেরা, আপনাগোরে করজোরে কই, থির অইয়া বসেন ব্যাবাকেতে যাইতে পারবেন। আমরা হগ্গলেই বিপদে, এই কতাটা মনে রাখবেন। ’
আবদুল্লাহ মেশিনরুমে বসলেন, মুখে পান। সম্ভবত নিরাপত্তার জন্য বন্ধ থাকা জানলাটি এক ফাঁকে উদোম করে নদীতে দ্রুত পানের পিক ফেললেন। ইঁদুরের মতো কিছু দেখলেনও।
বাচ্চাদের হইচই বন্ধ করার জন্য হাতে থাকা মেশিনের কালো হ্যান্ডেল উঁচিয়ে বড়বড় চোখে আবদুল্লাহ তেড়ে গেলেন, ‘চুপ, একদম চুপ থাহো। ’ বাচ্চারা সবাই ভয়ে চুপ হয়ে গেলো, কেউ মাথা নিচু করে থাকলো, কারো ভয়ার্ত চোখ আবদুল্লাহর দিকে। এরপর লঞ্চের ভিতর চারদিক এক পলক চোখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘কেউ কতা কইলে, আওয়াজ বাইরে যাইব- পাঞ্জাবি মিলিটারির গুলি খাইয়া তুমরা মরবা, আমগোরেও মারবা। ’
যাত্রীদের ভেতর উঠতি দাড়িগোঁফের এক প্যান্ট-শার্ট পরা তরুণ দাঁড়িয়ে গেলো। এরপর উচ্চকণ্ঠে বললো, ‘আমরা কি পইসা ছাড়া যাইতাছি? ভাড়া ছাড়া? অত তেজ ক্যান?’
ক্ষেপে গিয়ে আবদুল্লাহ বললেন, ‘ওই চ্যাংটা অত কতা কও ক্যান? ভাড়ার পইসা না থাকলে বাইন্ধা রাখি? কও? ছাইড়া দেই। আমরা হগ্গলেই বিপদে। ’ পেঁচার মতো মুখ বানিয়ে তরুণটি বললো, ‘চালাইয়েন না লঞ্চ?’
‘ওই পুংটার মতন কতা কস ক্যান? জানডা হাতে লইয়া যাইতাচি- আর হে কয় কত কতা। গজব থেইক্যা বাঁচনে লইবি আল্লার নাম, হে কয় বাড়তি কতা। ’
‘কি কইচি?’
তার দিয়ে পেঁচানো মেশিনরুমের নিরাপত্তা থেকে আবদুল্লাহ বেরিয়ে কয়েক লাফে এগিয়ে গেলেন তরুণের কাছে। তার হাতে সেই লোহার হ্যান্ডেল। কলার ধরে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, ‘তুই লঞ্চ থেইক্যা নাম। তরে নিমুনা, তরে নিমু না। ’
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তরুণকে ঠেলে লঞ্চের সিঁড়ি দিয়ে নামাতে নামাতে বললেন, ‘তুই পাকিস্তানি মিলিটারিগো চর। তুই দেশের শত্রু। ’
শতাধিক নারী-পুরুষে বোঝাই লঞ্চ। নদীর বুক চিরে দুই পাড়ে ঢেউ তুলেছে। নিজের মতো ছুটে চলেছে সুরমা রিভার এক্সপ্রেস। যাত্রীদের চোখমুখ পড়ে সুচরিতা বুঝতে পারে- তাদের বুকেও পাহাড়সমান কষ্ট। ফুঁপিয়ে কাঁদছিল এক নারী। হঠাৎ কান্না বন্ধ করে জিঞ্জেস করলো, ‘তুমি একলা?’
‘হ্যাঁ একা। ’
দুপুর বেলা। সাচনাবাজারের লঞ্চঘাটে ভিড়। বাড়ি পৌঁছানোর অচেনা পথের কথা ভাবতেই নানারকম দুশ্চিন্তা মাথায় এলো। লঞ্চের সিঁড়ি ধরে নামতে নামতেই চোখের সামনে প্রতিবেশি দীননাথের চেহারার মতো এক লোক। গায়ে চড়ানো হাফহাতার রঙওঠা শার্ট। লুঙ্গি পরা বৃদ্ধ। কিন্তু লোকটির লুঙ্গি নয়, চিরকালের পছন্দ ধুতিই। দিকভ্রান্ত হয়ে কারো অপেক্ষা করছেন। কাছে গিয়ে দেখা গেলো সত্যিই দীননাথ।
সুচরিতাকে এভাবে পেয়ে অবাক, দুনিয়ার বিস্ময় তার চোখে। বাকরুদ্ধ হয়ে থাকলেন কয়েক সেকেন্ড। এরপর দীননাথ বললেন, ‘মাই, তুমি এইখানে?’
উত্তরের অপেক্ষা না করেই সুচরিতাকে সরিয়ে আড়ালে টেনে নিতে নিতে বললেন, ‘এখানে গোপন কিছু বলা ঠিক হবে না। ’
একটি বড়গাছের আড়ালে এসে থামলেন তিনি। এরপর সুচরিতার ওপর আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে দীননাথ বললেন, ‘আমাদের পুরা গ্রাম মিলিটারিরা জ্বালাইয়া দিছে, রেজাকাররা কাজটা করেছে। ওরা সঙ্গে ছিল তো। তোমার বাবা-মা পালাইছেন। গ্রামবাসী সবাই পলাতক। আমরা ইন্ডিয়ার মৈলাম ক্যাম্পে যাইতেছি। আমরার গ্রামের সবাই ওইখানে। ’
জানতে চেয়ে সুচরিতা বললো, ‘কীভাবে?’
‘নৌকা ঠিক হইছে। আমরা সবাই একটাতে যাইবো। ’
‘আমি?’
‘বাহ্ এইটা কি কথা? তোমারে রাইখা যাইবো নাকি? মাথা খারাপ। ’
‘বাবা-মা, উনারা?’
‘মিলিটারিরা উনাদের পায় নাই। পাইলে লাইন ধরাইয়া রাইফেল দিয়া গুলি করত। ভাগ্য ভালা পালাইয়া বেঁচে গেছেন। শুনেছি, উনারাও মৈলাম ক্যাম্পেই যাবেন। ’
এরপর মানুষে গিজগিজ করা একটি নৌকা এসে দাঁড়ালো। ছইয়ের ওপর একটি সাদা-নীল রঙের কাপড়ের পাল ও মাস্তল এলোমেলো করে ফেলে রাখা। দীননাথের হাত ধরে সুচরিতা ধীরে ধীরে নৌকার দিকে এগিয়ে যায়। ওর বুকের ভেতর একটা চোরকাঁটা খচখচ করে ওঠে, দেবুর জন্য। শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদীরা এখন কোথায়, কে জানে?
চার মাস চলছে মৈলাম ক্যাম্পের জীবন। শরণার্থীরা আরো আসছে, বানের স্রোতের মতো। প্রতিদিন এই ক্যাম্পে শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ে। নতুন নতুন মানুষজনের ভিড় এই শিবিরে। সুচরিতা সত্যি সত্যি খুব ভয় পায় এখন। দিনে লোকজনের গিজগিজ থাকলেও রাতে ঝুপ করে গোটা শরণার্থীশিবির যেন ঘোর অন্ধকার হয়ে পড়ে। তখনই যেনো দেবুর অপেক্ষা, বাবা-মায়ের অপেক্ষা ওকে তাড়া করে। কিছুদিন ধরে কানের পাশে ঘনঘন ওদের গলার আওয়াজ। শুনেছিল দেবু মুক্তিযুদ্ধে যেতে নাম পাঠিয়েছে ওপরে। এখন কোথায়, কেমন আছে- এসবের কিছুই জানা নেই ওর।
দীননাথ খুড়া মাঝেমধ্যে বলে থাকেন, ‘ মাগো, তুমি অন্যরকম হইয়া যাইতেছ? বেশি বেশি চিন্তা করো, সুচরিতা?’
জবাব দিতে ইচ্ছে হয় না। কেনো যেন মুখে ওঠে না এসব প্রশ্নের উত্তর।
রেশন থেকে ওঠানো মসুরডাল বাছাই হলে সুচরিতা বসা থেকে দাঁড়ায়। ওদিকে মুখ ঘোরাতেই রাজেশ কণ্ট্রাক্টর। চোখ দুটো কেন ওর দিকে তিরের মতোর গেঁথে থাকে তা জানে সুচরিতা। কথা বলার সুযোগ পেলেই রাজেশ ওর আপাদমস্তক দেখে। সুচরিতার বুকের কাছে এসে স্থির হয় রাজেশের চোখ। পিটপিট চোখে থাকায়, ঠোঁটে সিগারেট সারাক্ষণ। পঞ্চাশ বছরের রাজেশ এখানকার শিবিরের বড় কন্ট্রাক্টর। তার কাছে কেন যেনো মনে হয় লোকটার চোখভরা অসুররাজ্য। কয়েকদফা দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে। পান খাওয়া মুখ। ওপরের দাঁতপাটি উঁচু। চাউর হয়েছে- শরণার্থী ক্যাম্পের গোলপাতার ছাউনি, বাঁশ-বেতের ঘরগুলোর কন্ট্রাক্টর রাজেশ রঞ্জন। সারিবাঁধা হাজার হাজার ঘর সে বানিয়েছে, টাকা ভারত সরকারের। সেই দ্বিতীয় কন্ট্রাক্টর। মূল কন্ট্রাক্টর এখানে আসে না। কোনোঘরে ত্রুটি দেখা গেলে তার লোকেরা এসে মেরামত করে দিয়ে যায়। এ কারণে সবারই সমীহ। কিন্তু সুচরিতার কী কিছু আসে-যায় তাতে? এসব কথা কেন ভাবছিলো নিজেও জানে না সুচরিতা। নাকি জীবনের অভিশপ্ত সময়গুলো ভুলে যাওয়ার চেষ্টা?
দীননাথ খুড়ার ঘরে ঢোকে সরকারের দেওয়া রেশনের চাল-ডাল-তেল-সবজি-কাঁচামরিচ দক্ষিণের কোণে রাখে। সবকটি আইটেম পাচ্ছে শরণার্থীরা। সেও বাংলাদেশের মানব সন্তানদের একজন, ওরও ভাগ রয়েছে এতে।
সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। অনেকে ঘুমিয়েও পড়েছে। বিশেষ করে যারা লাকড়ি আনতে পাহাড় চড়ে ওঠে, গাছ নামিয়ে আনে তাদের ঘুম ভাঙে ভোরে। এ কারণেই ক্লান্তদেহে সন্ধ্যাকালেই ঘুমিয়ে পড়ে।
সুচরিতার অনুমান রাত ন’টা। কেউ একজন দরজায় দাঁড়িয়েছে, ও বুঝতে পারে। মানুষের শ্বাস ফেলার শব্দ পাওয়া যায়, পায়ের হাঁটাহাঁটি। ক্যাম্পের হাবভাব যদিও বুঝে উঠতে পেরেছে সুচরিতা কিন্তু মানুষের মতিগতি বোঝা তো মুশকিল।
দ্বিতায়বার দরজায় শব্দ। বাঁশের দরজাটা ভেজানো ছিলো।
সুচরিতা বললো, ‘কে?’
নিরুত্তর।
মাথা ঘোরাতেই আবারো ক্যাচ করে শব্দ।
এবার ওর কণ্ঠ খানিকটা জোরের। ‘কে? কে এইখানে?’
উত্তর না পেয়ে সুচরিতা বিছানা থেকে ওঠেই দরজা খুলে দাঁড়ালো। চারদিক তাকালো। অন্ধকার রাত। ক্যাম্পেই ডানের সারিতে কুপিবাতি জ্বলছে দুটি ঘরে। তবে এদিকটা অন্ধকার। দীননাথ জানতে চান, ‘কে সুচরিতা?’
‘কেউ না, বাতাস দরোজা নাড়াইছিলো। ’
ঘরে ঢোকার মুহূর্তে খানিক দূরে চোখে ভাসে রাজেশ কন্ট্রাক্টরের মুখ। আবছা-অন্ধকারেও বোঝা যায়। ভয় তাড়াতে এবার ঈষৎ জোরের কণ্ঠে সুচরিতা হাঁক দেয়, ‘কে এইখানে?’ রাজেশ কন্ট্রাক্টরের ছায়া ধীরে ধীরে দূরে গিয়ে মিলিয়ে যায়।
সুচরিতা বিছানাটা টান করে। শুতে যাবে এ সময় দেখে ঘাড় বেয়ে উঠছে একদল পাহাড়িপোকা। পোকাগুলো ক্রমে সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কালো পোকারা কিলবিল করছে যেনো। হয়তো পোকাগুলো মানুষ কামড়ায় না। তবু ভয় আর অস্বস্তি জানান দেয় শরীরে। পিছন ফিরে নিশ্চিত হয় দরজা ভেজানো। নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে মিশিয়ে নিতে লজ্জা লাগলেও এদিক ওদিক তাকায়। নারী শরীর, লজ্জা-শরম বলে কথা। কেউ নেই দেখে কিছুটা ভয়মুক্ত হয়। তবে জড়তা থাকেই। এরপর ঘরের অন্ধকারে পেটিকোটে আর পিঠছেঁড়া ব্লাউজ গায়ে রেখে কাপড় খুলে ঝেড়ে নেয়। ফিসফিসিয়ে বলে, ‘পোকার দল আর মানুষ পায় নাই। ’
সুচরিতা আধভাঙা আয়নার সম্মুখে দাঁড়ায়। কচি অথচ টানটান শরীর। নিজের রূপ দেখে, মুখ দেখে, সত্যিই সতেজ। দেবু বলতো- তোমার চোখ দুটো হরিণীর চোখের মতো। মেয়ের সৌন্দর্য্য নিয়ে মা গর্ব করতো। পাকমিলিটারিদের রাইফেল কেড়ে নিয়েছে মানুষকে, সন্দেহ জাগে মনে, বাবা-মা বেঁচে আছে তো! শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ ওরা কোথায় এখন? বুকটা হাহাকার করে। ওর জীবনের শেষ ভরসাও কেড়ে নিয়েছে এই যুদ্ধ। দেবুর সঙ্গে কারো কী তুলনা হয়?
সুচরিতার চোখে ঘুম এসে যায়। ঘুমের মধ্যে এক ধরণের আওয়াজ অনুভূত হয়। কেবলি মনে হয় ও কেবল দৌড়াচ্ছে। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে দেবুর হাত ধরে। ঘুম আর জাগরণের ভিতর কঠিন কষ্ট অনুভব করে। স্বপ্নেরা ভিড় করে। দেখতে থাকে- দেবু তাকে কোলে তুলে পাঁজাকোলা করে দুষ্টুমি করছে। জোর করে ঠোঁটে ওর ঠোঁট ছোঁয়াতে চাইছে। নদীর ঢেউয়ের বুকে পাশাপাশি ভাসতে থাকে। প্রায়ই এ স্বপ্নটা ওর মধ্যে উঁকি দেয়, চরের মতো জেগে ওঠে।
ক্যাম্পের বাসিন্দাদের রান্নার লাকড়ির সূত্র পাহাড়। সাত সকালে স্মৃতি উঠোনে থাকা গাছগুলো লাকড়ি করতে থাকে। পাহাড় থেকে দীননাথের আনা গাছের টুকরোগুলো আরো খণ্ড খণ্ড করে। এরপর চুলো জ্বালানোর যোগ্য হয়ে ওঠে এসব খড়ি। তবে স্মৃতি চুলোয় লাকড়ি পোড়াতে পারলেও রাঁধতে জানে না। ঘর ঝাড়ু দেয়। কাপড় ধোয়। দীননাথের দ্বিতীয় স্ত্রী স্মৃতির জীবনকাহিনী ভীষণ কৌতূহলী করে তুলে সুচরিতাকে। ওর আফসোস্ আর আক্ষেপ হয়- চোখের সামনে নিজেকে নষ্ট করে ফেলার উদাহরণ স্মৃতি। প্রায় সমান বয়স। চঞ্চলমতির হলেও অপরূপ সুন্দরী স্মৃতি। ফর্সা, নাক উঁচু, চোখজোড়া টানা টানা।
প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিয়েই দ্বিতীয় বিয়েটা হয়েছিল। অথচ দ্বিতীয় স্ত্রী ঘরে তুলবার পর থেকেই নিঃসন্তান দীননাথের প্রতি চরম ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছেন প্রথম স্ত্রী, সুচরিতার খুড়িমা। কারণে অকারণে স্বামী-স্ত্রীর এমন ঝগড়ায় ক্যাম্পের অনেকেই বিষাদাচ্ছন্ন। তাদের কথা-কাটাকাটি, তুচ্ছ ঘটনায় ঝগড়াঝাটি হরহামেশার বিষয় হয়ে উঠেছে। সর্বনাশটা ঘটে গেছে দ্বিতায় বাসররাতেই। নতুন স্ত্রীর সঙ্গে একবিছানায় ঘুমোতে গিয়েই সমস্যার উদ্ভব। কৌতূহলী চোখে প্রথম স্ত্রী কাপড়ের পর্দা সরাতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন দীননাথ। এরপর থেকেই প্রথম স্ত্রীর ত্রুটি খোঁজা শুরু।
তাদের সংসারের আয়ু পঁচিশ বছর। এরমধ্যে তাবিজ, কবিরাজ, গাইনী চিকিৎসক বাকি রাখা হয়নি তল্লাটে। একটি সন্তানও জন্মলাভ করেনি। নিঃসন্তান দম্পতির মধ্যে ততদিন মনোমালিন্য ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, ক্যাম্পেরই অসহায় প্রতিবেশি বৃদ্ধ রামচরণের কলেরায় মৃত্যু ঘটলে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। অকালে পিতৃহারা বিয়েযোগ্যি স্মৃতির গতি করা প্রয়োজন হয়ে পড়লো। অহেতুক ঝামেলায় শরণার্থী শিবিরের কেউ জড়াতে চায় না নিজেকে। সম্ভবত এ কারণেই এসময় এগিয়ে এলো না কেউ। পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় বিয়ে দেওয়ার প্রশ্ন উঠলো। মোটামুটি সুন্দরী স্মৃতি। অবশেষে অভিভাবকশূন্য মেয়েকে বিয়ে করার পাত্র না জোটায় এগিয়ে এলেন দীননাথ।
বিয়ে হলেও স্ত্রীর সঙ্গে মেলামেশার সুযোগবঞ্ছিত এই প্রৌঢ় পাত্রের। রফা হলো, জটিল পথে। রাতের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সুচরিতার ঘর বেছে নিলেন দীননাথ। ফলে গভীর রাতের সময়টুকু খুড়িমার সঙ্গেই কাটাতে হয় সুচরিতাকে।
নিঃসন্তান নারীটির জন্য মাঝেমধ্যে মায়াও হয়। পেটে না ধরলেও পঞ্চাশোর্ধ খুড়িমার সন্তানের মতো সুচরিতা। অসুখ-বিসুখ শরীরে লেগেই থাকে তার। দীননাথের পরিবারের সকল কাজের সহযোগী সুচরিতা রান্নাবাড়ায়ও সাহায্য করে।
রাত একপ্রহর। অবশ্য নিস্তব্ধতা নেই এখানকার ক্যাম্পে।
যথারীতি দরোজার কাছে দীননাথের পায়ের চপ্পলের শব্দ শোনা গেলো। কিছুক্ষণ পর ক্যাচ করে আরো একটা শব্দ হলো, দরোজায়। উঠে দেখার প্রয়োজন বোধ করলো না সুচরিতা। অঘোর ঘুমের ভান করেই যেন ছিল স্মৃতি। পূর্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে শব্দের একটা সহজ সমাধান করতে পরপর দু’বার পিঠধাক্কায় স্মৃতিকে জাগিয়ে দেয় সুচরিতা। এরপর ফিসফিসিয়ে বলে, ‘এই স্মৃতি উঠস্ না কেন!’
কিছুক্ষণ পরই দীননাথের দ্বিতায় স্ত্রী স্মৃতির ফিসফিস কথা শোনা যায়, অস্পষ্ট শব্দ ভেসে আসে পাশের ঘর থেকে। বিশেষ কিছু সুপরিচিত শব্দ। এ জাতীয় শব্দের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিলো নিজেরও। শরীর ছনছন করে। হাসি পায় সুচরিতার।
প্রৌঢ়া খুড়িমার পাশে এসে শুয়েছে সুচরিতা। বোঝা যায় তিনি জেগে আছেন, শব্দহীন কান্না বুকে, আঁচল চেপে ধরেছেন মুখে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
একইভাবে সুচরিতার অন্তরজুড়ে থাকা হাহাকারগুলো নড়ে ওঠে। যেন কষ্টগুলো একত্র হয়ে জড়িয়ে ধরেছে ওকে। প্রায় মরার মতো শুয়ে থাকে। নিত্যদিন অনেক রাত অবধি ঘুম না এলেও আজ একপর্যায়ে চোখজুড়ে ঘুমের রাজা গ্রাস করে। যখন ঘুম ভাঙে তখন ভোর হয় হয় সময়। এর কিছুক্ষণ পরে প্রতিরাতের মতো আজো স্মৃতি চোখমুখে বিরক্তি আর লজ্জা ছড়িয়ে ঘরে ঢোকে। সুচরিতা আড়চোখে দেখে স্মৃতিকে।
উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা সুচরিতার শিরদাঁড়ার দিকে ঈষৎ নাড়া দেয় স্মৃতি। ওকে উদ্দেশ করে বলে, ‘শেষ, শেষ হয়ে গেছে। ’
সুচরিতা খুড়িমার বিছানা ছাড়ে। হঠাৎ বেড়ার অপাশে চোখে পড়ে একটি ছায়া। ভোররাতের ছায়া। কার ছায়া? নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে বেড়ার ফাঁক গলিয়ে।
ছায়ার মতো কেউ এসে যেন দাঁড়িয়ে আছে। খানিকটা ভয় জাগে মনে। সুচরিতা জানতে চায়, ‘ কে ওইখানে?’
‘আমি। ’
কণ্ঠ অতিপরিচিত। জানলাহীন গোলপাতার ঘর। নচেৎ আড়াল থেকে ভালো করেই দেখা যেত। অনুমান করা যায়- বেড়ার অপাশে দাঁড়িয়ে আছে কোনো পুরুষ।
‘সরু আমি?’
‘আমি কে?’
‘আমি, সরু দরোজাটা খুলেই দেখো না?’
সুচরিতা দ্রুত দরজা খোলে, কণ্ঠ চিনতে মোটেই কষ্ট হয় না।
মুখে লম্বা দাড়ি, গোঁফ, লম্বা সেই মানুষ। কোঁকড়া চুল, এলোমেলো। ক্রমে ক্রমে ব্যপারটা যেন অস্বাভাবিক মনে হতে থাকে। দেবুর বুকে মাথা রেখে মনে হলো জীবনে এতো সুখী কখনো হয়নি সুচরিতা।
‘জানলে কীভাবে এখানে আছি?’
‘সবকিছু খুলে বলবো তোমাকে। তবে বেশিক্ষণ আজ থাকতে পারবো না। ’
অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে ওরা।