ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

যেভাবে লিখিত হয় ‘রাত্রি চতুর্দশী’

তমাল রায়, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০২০
যেভাবে লিখিত হয় ‘রাত্রি চতুর্দশী’

 

১৩সি ঘোষ লেন, মাণিকতলা। কলকাতা-৬।

উহুঁ। মেছুয়াবাজার। সিমলা পাড়া। বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর, রবি ঠাকুর এবং পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল। বাংলার নবজাগরণের আঁতুড় ঘরেই থাকতেন পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল। তফাৎ শুধু একজায়গায়, তারা ছিলেন নিজ নিজ ভিটে বাড়িতে। আর পার্থপ্রতিম ভাড়া বাড়িতে। পরে নিজের বাড়িও হলো উত্তর কলকাতার সিঁথিতে। কিন্তু এত মেধাসম্পদ, ঐশ্বর্য, বিদগ্ধতা নিয়েও এত প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন নিজেই নিজের, তার আর নিজ বাড়ি কী করে হয়! “তাই সিঁথির মোড়ে নেমে রিকশাওয়ালাকে বলবে ‘কুমার শানুর বাড়ি’ তাহলেই পৌঁছে যাবে। " বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, নিজের বসবাসস্থলের পরিচয় করাচ্ছেন কিশোর কণ্ঠী কুমার শানুর বাড়ির পরিচয় দিয়ে।

শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণার ভাস্কর চক্রবর্তীর রেপ্লিকা। যার সব থেকেও কিছুই নেই, কেবল আত্ম-হাহাকার! কেন? অথচ শুরু তো এমন নয়। আর্তুর র‍্যাঁবোর মতো উত্থান যার, তার কেন এমন অবস্থা? মাত্র কুড়ি বছরে শেষ করে ফেলেছেন প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ১৯৭০-এ প্রকাশ পেল 'দেবী'। বইটির প্রকাশ সমন্ধে পার্থপ্রতিম নিজেই কী বলছেন পড়া যাক, “প্রথমে ‘দেবী’ বেরিয়েছিল অভিজ্ঞান প্রকাশনা থেকে ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে। প্রকাশক হিসেবে ছিলেন নিশীথ ভড়। আরও একটু গল্প: তরণী পত্রিকার সম্পাদক ও কবি দিলীপ কুমার বসু আমাকে ও নিশীথকে কিছু টাকা দেন, যাতে অভিজ্ঞান প্রকাশনার জন্ম হয় এবং অমিতাভ গুপ্তের ‘আলো’ বইটি বার হয়। ‘আলো’ বার হোলো অক্টোবরে (১৯৭০), সেই বইয়ের বিক্রয়লব্ধ অর্থের সবটাই অমিতাভ দিয়ে দিলেন ‘দেবী’ বার করতে। এতে দিলীপ কুমার বসুর সম্মতি ছিলো। দেবী বেরিয়েছিল মডার্ন ইন্ডিয়া প্রেস থেকে, সেখানে তখন আমার বাবা চাকরি করতেন। ”

দেবী মূলত একটি নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক আবাহন ও বন্দনা গান। যার সৃজনশৈলী ও সম্ভাবনা প্রসঙ্গে পার্থ তার বন্ধু রণজিৎ দাশকে জানিয়েছিলেন, সত্তরের নভেম্বরে শেষ কবিতাটি মুসাবিদা করার পরই ভয় ঘিরে ধরে। একদিকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা, অপরদিকে বইটি যদি ফ্লপ করে? যে নিখিলজ্ঞানে বইটি নির্মিত, তার বোধ চেতনার সাথে পাঠক যদি অন্তরঙ্গ না হতে পারেন?
 
সংশয় দুন্দুভি পেরিয়ে বইটি কিন্তু সফল হয়ে যায়। আর তিনি সেলেব। যাকে বলে রীতিমতো সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস। পার্থপ্রতিম, তখন স্কটিশচার্চ কলেজের ছাত্র। অন্য ছাত্ররা তখন পার্থকে দূর থেকে দেখান, ওই যে পার্থপ্রতিম। পৃথিবীর সকল সৃষ্টি রহস্যের সাথেই সফলতা থাকে কিনা জানা নেই। এ ক্ষেত্রে ছিলো।

 

বন্দনা বিলাপ ধ্বনি

দেবী, মুদ্রা ব্যবহারে আজ সকল সম্পর্কগুলি হয়েছে কুটিল 
অস্পষ্ট, একদেশদর্শী, বন্ধ। যাকে পিতা বলে জানি
তিনি অবান্ধব, অবান্তর, যাকে জেনেছি প্রেমিকা, সেও নয় 
হৃদয়জননী, যে বন্ধু, তার ব্যবহারে থেকে যায় অনভিভাবক
উদাসীন দৃষ্টিপাত। মানুষের মুদ্রা ব্যবহারে, যশ ব্যবহারে
এ সকল বিপত্তি হয়েছে। আজ কোন কবিতার স্তব শুদ্ধভাবে 
শুক্লতার সঙ্গে তুলে আনবো, পুনর্বার হিরন্ময় হবে তোমার রূপের অমলতা।

যেমন সম্পর্কে আমরা অনভিজ্ঞ, তেমন রয়েছি আয়ুভাগে। শিশু ভুলে যায় 
তার মুগ্ধতা আমাদের গ্লানি থেকে উদ্ধার করে পুনর্মুগ্ধ করে, কিশোর ভুলেছে তার ব্রীড়ানত উৎসাহের রেখা আজো কালজয়ী, 
যৌবন ভুলেছে তার মধুর ভঙ্গিমা আজো প্রকৃতির কোন ঐশ্বর্যই
                                                আয়ত্ত করেনি,
প্রৌঢ়তা ভুলেছে তার প্রসন্নতা
শীতের রৌদ্র থেকে আরো বেশি প্রার্থিত এই পৃথিবীতে।  
আমরা কেবল
ক্ষমতা ও বোধের অভাবে শিশু, 
সীমাজ্ঞানহীনতার জন্যেই আমরা কিশোর 
ভ্রান্তমত্ততা ছাড়া আমাদের যৌবনের অন্য কোন অভিজ্ঞান নেই

কুটিলতাপ্রিয় বলে আমরা প্রত্যেকে প্রৌঢ় স্বেচ্ছানির্বাসনে 
কণ্ডুয়নসুখে।
মানুষের ব্যবহারে আজো রঙ্গ আছে, চৈতন্যে রহস্য আছে- পাশাপাশি
এইসব থেকে গেছে, বড়ো দীর্ঘযাত্রার, পর পর কচিৎ রূপোলি রেখা
দৈন্য আরো ঘনীভূত করে।

কোন বেদীমূলে
তোমার উৎসবের জন্য সংগ্রহ করবো উপচার, সমিধ্  জ্বালাবো
কয়েকটি বিরলকণ্ঠের নান্দীপাঠ ডুবে যায় অসুরনিনাদে
এরা প্রত্যেকেই সেই মুদ্রারাক্ষসের আর মহিষাসুরের সহচর, এরা দূর্যোধন।
তোমার ও রক্তবর্ণ আনন ফেরাও, হে দারুণ, তুমি খড়্গ তোলো  
অস্ত্র উপচারে নি তুমি পুজা করো এই রোগগ্রস্ত মানুষের।  

তখন সকাল। ঘোষ লেনের ভাড়া বাড়ির খাট, একটা ছোট ট্রাঞ্জিস্টার সেট থেকে বেরিয়ে আসছে মাদার ইন্ডিয়া, মুঘল-এ-আজমের গান, নীচু ভ্যলুমে। আর বিড়িতে সুখ টান দিয়ে এক মনে লিখে চলেছেন পার্থপ্রতিম। কাজের মধ্যে দুই কফি হাউস যাওয়া আর কবিতা লেখা। বাড়িতে যদিও তেমন আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই, তবু কবিতাও তো এক নেশাই, অনেকটা প্রেমের মত, মূহ্যমান্যতার মত। তখনও অঞ্জনার সাথে আলাপ তেমন জমে ওঠেনি, চাকরি নেই কিন্তু কফি হাউসের টেবিলটা কিন্তু নির্দিষ্ট। ওইখানেই কিছু পর এসে বসবে অমিতাভ গুপ্ত, নিশীথ ভড়, রণজিৎ দাশ। আর বিকেল কখন চলে যাবে সন্ধ্যে পেরিয়ে রাতের দিকে। কিছু পর এদিক ওদিক চাইতে চাইতে আসবেন সদ্য কবি মৃদুল দাশগুপ্ত, গৌতম চোধুরী। তখন হয়তো পার্থ গাইছেন পুরনো হিন্দি গান, আর সাথে ঠেকা দিচ্ছেন রণজিৎ দাশ। এবার রাজা উজির মারা পড়বেন। অথবা গৌতমের দিকে তাকিয়ে পার্থ জিজ্ঞেস করে উঠবে, গান শোনো? শামশাদ বেগমের গান শুনেছো? 

কিছু পর হেদুয়ার পাড়ে বসে চলবে নেশা চর্চা। তুরীয় জগতে বসে কখনও মাথা ছোঁবে মহাকাশ... মহাকাল…

রাত্রি চতুর্দশী প্রকাশ পেলো ১৯৮৩। মাঝের তের বছর পার্থপ্রতিম কী করলেন? 
- বেঁচে থাকতে অর্থ লাগে, একটা ঘর ছোট সংসার। পথের ধারে থাকা শিবলিঙ্গও তো প্রতিষ্ঠা পায়। কেউ মন্দির গড়ে দেয়, কেউ সামনের চাতালটা বাঁধিয়ে দেয়, আর এভাবে ভিখিরি দেবতাও তো প্রতিষ্ঠা পায়। মানুষ সেও তো এক প্রতিষ্ঠান। কবি মানুষ নয়? 

চাকরি হলো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। তার আগের সময়টায় আড্ডা ছিলো কফিহাউস, কলেজস্ট্রিট, বইপাড়া, বাগবাজার। অনুজপ্রতিম প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়দের বাড়ির ঘরে লম্বা আড্ডা। সেখানে সকলেই আসে। কথাবার্তা হয়। কবিতার আড্ডা, কবিতার বাইরের আড্ডা। অঞ্জনার সাথে বিয়েটাও হয়ে গেল। সন্তান এলো। কন্যা সন্তান। মণিকর্ণিকা। তারপর আবার কবিতায় ফেরা। অথবা ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতিপর্ব চলছিলোই। মাঝের সময়টা জুড়ে বিশ্বের বিবিধ ছন্দ নিয়ে চর্চা, চতুর্দশপদী যেখানে যা যেমন আছে, পড়তে হবে জানতে হবে, শিখে ফেলা। চতুর্দশপদীকেই ভেঙে চুরে দেখা। ১৯৮৩-তে প্রকাশ পেলো 'রাত্রি চতুর্দশী'। পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল ও তার দেবী কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ

বাড়ি
(দান্তে গ্যাব্রিয়েল রসেটির সনেটের মিলকাঠামো)

যাদের এ-গ্রহে স্বীয় বাড়িঘর নেই, আজ তারা
আমার বৃত্তের বাইরে, আমার সিঁথিতে হালে থাকা
বাড়ি কিনে, আইনি কাগজ তার সযত্নেই রাখা—
পূর্বতন সামগ্রীতে চলছে অনেক নাড়াচাড়া।

আগে ভাড়া-বাসা ছিল, ছয় দশক তো এমনধারা
ছিল এই জীবৎকালে, আজ তাকে কে যে পালটালো,
সংখ্যাগুরুদের সঙ্গে মিশে-থাকা দৃঢ় আটকালো
এ-আমার। হয়তো এসেছে কোনো বদলের তাড়া।

“তোমার কপালে তবে এ-ও ছিল?” সংখ্যাগুরুচোখে
এই প্রশ্ন উঠে আসে। “হ্যাঁ, মানছি, গলি, তস্য গলি
ঘুরে ঘুরে আসতে হয়, যেতে হয় তোমার বাড়িতে,
জটিলতাকুটিলতা জন্ম থেকে তোমার নাড়ীতে,
বুঝি হ’তে চাও আজও যেরকম হয় না ত্রিলোকে,
তাই গ্রীষ্ম স্নেহহীন, বাসা খরতাপের কুণ্ডলী। ”


চাকরবর্বরিক
(স্যার টমাস ওয়াটের সনেটের ধরণে)

মহিলা ও বৃদ্ধদের নেমে-যাওয়া অবধি শালীন
ছিল প্রতিবন্ধী-জানা, নারী-জানা প্রাইভেট বাস;
পরে যেই নামতে গেল জনৈক তরুণ গৃহদাস
বহুবিধ বোঝা নিয়ে, বাস হলো তখনই উড্ডীন।

হাওড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম থেকে এরা আসে।
জড়-প্রতিবন্ধী নয়, বৃদ্ধ নয়, মহিলাও নয়।
ওর জন্য বাস থামবে? বিজ্ঞাপনে কই পরিচয়?
লাফিয়ে নামতে হবে ওকে কাঁচা নর্দমার পাশে….. 

একস্টপ বাদে একসঙ্গে নেমে তার অল্প ভার
নিয়ে দেখি, এত ভারি! অথচ সে এর বারোগুণ
দুহাতে টানছে, সিধে, যেন মাথা তুলেছে আগুন—
এরকম ঋজু হতে পারবে না বুভুক্ষা-অঙ্গার।

মৃত্যু হলে, নৃদেহে ঔরস আরো তিনদিন বাঁচে—
এ-তথ্য জানে না বলে, এ-ও সেরকম বেঁচে আছে।

‘টেবিল, দূরের সন্ধ্যা’ প্রকাশ পেল ১৯৮৪।  

 

টেবিল

টেবিল, দূরের সন্ধ্যা
ঘনিয়ে আসছে। ফল, মৃতদেহ
অফিসফাইল, জোড়া-খোয়া দুল
নেগেটিভ প্রিন্ট, অ্যালবাম, প্যাড
কি রাখবো তোমার উপর?
চেয়ার, রাখতে হবে সামান্য সরিয়ে!

(টেবিল, দূরের সন্ধ্যা)

তারপর আবার দীর্ঘ নীরবতা। 'পাঠকের সঙ্গে ব্যক্তিগত' প্রকাশ পেল ২০০১ এ। মাঝের সতের বছর? 
- কবিতা লিখতে গেলেই নিয়মিত প্রসব করতে হবে তার কী মানে? আর অজ্ঞেয়বাদ, আধ্যাত্মিকতা চেপে বসছিলো যে।  
- আর তন্ত্র, জ্যোতিষচর্চাও তো একই সাথে। কিন্তু কেন? ঈশ্বর occult এ বিশ্বাস কেন? 
- কোনো লেখক বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী হয় না। সে বিশ্বাসার্থী। বিশ্বাসী অবিশ্বাসী - এসব হয় মুহূর্তগত বর্ণনা নয় বাংলা যাত্রার ভাবালু শব্দ। আমার কথামত ঈশ্বরবিশ্বাসী আমি। প্রথমে ছিলাম না-নাস্তিক। পরে ঈশ্বরের এই প্রমাণনিরপেক্ষতার দিকটা পছন্দ হলো। তবু জানেন, ঈশ্বরের এক মজার প্রমাণ আছে, সেটা হলো গান। এরপর দেখলাম সাহিত্যও প্রমাণ করা যায় না। আসল কথা হলো আমি জুয়াড়ি। '৮৩ সালে বিশ্বকাপ ফাইনাল। সেদিন আমি কবি গৌরাঙ্গ ভৌমিকের বাড়িতে। ভারত যে রানে তার ইনিংস শেষ করে। কেউ ভাবেনি ভারত জিতবে। তৎক্ষণাৎ জুয়া ধরলাম, ঈশ্বর থাকলে এ-ই জিতবে। জিতেও গেল! 

এই যে জুয়া, এর মধ্যেই আমি ঈশ্বরের আকাট প্রমাণ হ্যাঁ কি না-কে পেতে চেয়েছিলাম। তবে কি জানেন, ঈশ্বর আমায় ততো বিশ্বাস করে না। মাঝেমাঝেই বিরক্ত করে। আমাকে বিশ্বাসকে টানতে হয় না, ওই আমায় টানে। Occult নিয়ে আমার বক্তব্য হলো, যতোক্ষণ পর্যন্ত কেউ মানুষের মায়ায় যথেষ্ট মুগ্ধ, ততোক্ষণ পর্যন্ত তিনি বিষয়টি ধরতে পারবেন না।  

বিরহ
মাঝে মাঝে আমাকে বেপাড়ায় দেখা যায়। বলা দরকার যে পুরুষদের বেশ্যাগমনে যেহেতু সমাজের মৌন সমর্থন আছে, সেই কারণে, এই
অঞ্চলকে আমার নিষিদ্ধ মনে হয়নি; এছাড়াও অভাবীদের সঙ্গে যৌনতা 
হয় না—
খ্যাতিহীন কবিদের স্ত্রীরা প্রায়ই যা বুঝে ওঠেন। তা-ও, আমাকে এই 
যৌন পল্লীতে বা সংলগ্ন এলাকায় দেখা যায়।
মাঝে মাঝে দুটি একটি স্বভাবী রমণী এসব পাড়ায় আসে। একবার
একজনের খবর পেয়েছিলাম, আর দশটি ভিন্নভিন্ন
রাজনৈতিক দলের সক্রিয়
যুবকর্মীদের পাঠিয়েছিলাম তার কাছে। পরে নিজে তার কাছে যাই।
সেদিন দুপুরে খুব বৃষ্টি।
খুব জেদ নিয়ে জানতে চাই— শুধু জানতে চেয়েছিলাম দশজনের
তফাৎ কী কী। কে কীভাবে। কিন্তু, সে এমনি ধূর্ত যে খালি সঙ্গম 
করাতে চায়। প্রায় দেড়ঘণ্টা কাটিয়ে কথা বের করতে না পেরে উঠে
আসি। চা খেয়ে আঁচ করি যে ওসব করলে হয়তো তারপর
জানা যেত— যদিও লিপ্ত হ'লে জানতে ইচ্ছে না-ও করতে পারতো, সে সম্ভাবনাও ছিলো।
আমি পরে তাকে পাইনি, জায়গা বদলেছে। কিন্তু তারই মতো কাউকে 
আমি খুঁজছি— আরিয়াডনে, তোমার কাছ থেকে ঐ উলসুতো না পেয়ে
ভারতবর্ষের গভীরে যাবার মতো পুত্রতান্ত্রিক আমি নই, আরিয়াডনে,
যদি দেখা না দাও, সুতো না দাও, আমি এই জীবন নিম্নরাজনৈতিকতার 
সিন্ধুবালির গর্তে থেকে যাব।

১৯৪৯ এর ২৩ ডিসেম্বর মধ্য কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রথম বই ‘দেবী’ প্রকাশ পায় ১৯৭০ এ। স্বতন্ত্র ভাষাভঙ্গির জন্য প্রকাশের পর পরই তৎকালীন পাঠকমহলে আলোড়ন ফেলে দেয় কাব্যগ্রন্থটি। কবির পরবর্তী প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলো- রাত্রি চতুর্দশী (৮৩), টেবিল, দূরের সন্ধ্যা (৮৪), পাঠকের সঙ্গে ব্যক্তিগত (২০০১), ধর্মপুত্র, এখানে আসুন (২০০৭), বিজিবি সিলেট (২০১৩), বহিরাগত (২০০৮), সাদা পাথরের গোলাপগুচ্ছ (২০১৫) এবং নবান্ন (২০১৯)।

তাই তো? এত লম্বা বিরতি। এত কম লেখা।  
- চাইলে অনেক লেখাই যেত। যায় তো। অনেকেই লেখে। আমি আমার মতো। সকলের মতো নই। হতেও চাইনি কখনও।
- কেন লেখেন? কবিতাই বা কেন? 
লেখালেখি যে কারণে সবাই আরম্ভ করেন-
মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্যে। প্রথম শুরু ১৩ বছর বয়সে অঙ্কের প্রশ্নপত্রের শাদা পশ্চাদ্দেশে। বাবা প্রেসে কাজ করতেন, মা চেয়েছিলেন লেখক হিসেবে যেন অর্থযশ পাই।  
- পেলেন? 
- চাইলেই সব হয়? আর চাওয়াও তো বদলে যায়। জগৎসংসারের সাথে বিবর্তনবাদের এটাই যে সম্পর্ক।  

 

নির্ণয়

মাটি তো তেমন নেই, কিন্তু ভূমি আছে;
পশুর মতো প্রিয় লোকজন, কবিতা রচনা।
আলোই ক্লান্তির যজমান ব'লে
আলো মাঠ, ধ'রে নিতে হয়।
মাটি এখনো বাঙ্ময় ততো নয়—
ধুলোবালি, ভাবপ্রবণতা
এসব রয়েছে তার; মাঠে পশু গেলে
আকাশে তখন দৃষ্টি যায়; নির্ণয়েচ্ছু সেই 
পলায়ন।

-তারপর? একা হতে শুরু করলেন কবে? এই যে প্রবল একাকীত্ব, ভয় উদ্বেগ অস্বস্তি। এসব কেন? এত নির্জনতা কেন? 
- যে কোনো মানুষ বা প্রাণীর মতো, আমারও বেঁচে থাকার মুখ্য অবলম্বন কোনো অজ্ঞাত কারণ বা কারণগুচ্ছ। আমি তারই এক তুচ্ছপুচ্ছ…

 

দেয়ালগিরি
(ফরাসি সনেটের আদলে। উৎসর্গ: শ্রীবিষ্ণু দে/ শ্রীউত্তম দাশ)

ঘিয়ের প্রদীপ আছে দেয়ালগিরিতে।
এ-মধু মেশাও ওতে। পলতে জ্বেলে দাও।
ওই তো আলো, ওইদিকেই চেয়ে থাকো, চাও
ভুলেও ভেব না কেউ উঠছে সিঁড়িতে...

আজ ঘাস দুলে উঠছে বর্ষার নিভৃতে।
দুর্বাশ্যামমায়াঞ্জনে ওরাও উধাও
পূর্বজন্মে। তুমিও সেখানে চলে যাও... 
মেঘে-মেঘে, সবার, নিজেরও অলক্ষিতে।

এই তো এগিয়ে যাচ্ছে, বৃষ্টিবিলেখন
পূর্বনাগলোক খুলে দিয়েছে এখন…
ঘোরো ঘোরো স্মৃতিপুর, বিস্মরণপুর।

উঠে যাচ্ছ ধূপধূম, এদিকে, তোমার
জীবনের সব দণ্ড হলো দীপাধার;
ধারা শেষ! ... ফিরে এস, কারণকর্পুর...

-আপনি তাহলে বন্ধুবিহীন? নিশীথ ভড়? 
- সেও তো চলে গেছে কবেই... মানুষ আসলেই একা। সৃষ্টিশীল মানুষ আরও একা!

 

নিয়তিনিশীথ

আভ্যন্তরীণ তেল, ডুবোপাথরের
আক্রমণে ছুটে চলে জল'; 
ঘোলা, উন্মাদনাময় সেই পীড়িত নিশীথ
স্বপ্নের আপৎ-ধর্ম, আজানের অন্তর্গত অন্যমনস্কতা।

 

বন্ধুদের

তেমন চোখের জল আমার ছিল না কোনোদিন
জলের ভিতরে চোখ ভেসে গিয়েছিল
জলের ভিতরে চোখ বহে গিয়েছিল,

জলের ভিতরে চোখ বাষ্প হয়ে শূন্য উপছে মেঘ হয়েছিল

জল সব দ্যাখে, এই জেনে। আমার আগুন আছে, অন্ধের আগুন
ধ'রে আছে জিভ-কণ্ঠা, হাত-ঊর্ধ্ববুক।
আগে, তা নিভুক।


পার্থপ্রতিম কি সময়ের আগে জন্ম নেওয়া একজন মানুষ? প্রকৃত জ্ঞানী একা হন। ভোরাসিয়াস পাঠক, লো সেল্ফ এস্টিম? না'কি অনেকটা বেশি এস্টিম? পাল্লা দিয়ে বাকিরা চলতে পারছেন না তাই সিনিকালি ও প্রকৃতপক্ষেই একা! তাই কি প্রতি কথাতেই মিশিয়ে দিতেন তীর্যকতা, উইট? এক রহস্যবলয় তৈরি করেছিলেন নিজের চারদিকেই। তরুণদের প্রতি তার ভালোবাসার কার্পণ্য ছিল না। কিন্তু সমবয়সী, একই দশকের অন্য নিকটজনদের প্রতি অভিমান? না'কি বীরশ্রেষ্ঠ কর্ণের মত, অন্য ট্রাজেডির হিরোদের মতই একা! পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল (১৯৪৯-২০২০) কবি ও মানুষ এবং একা পার্থপ্রতিম চলে গেছেন ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে। ঘরে অথর্ব কবি পত্নী অঞ্জনা একা। সিঁথির মোড় থেকে রিকশায় কুমার শানুর বাড়ির উল্টোদিকের বাড়িটার সামনের রাস্তায় কর্পোরেশনের উজ্জ্বল সোডিয়াম আলোকে ম্রিয়মাণ করে বৃষ্টি নেমে আসছে, অকারণ শরত-বৃষ্টি! কেন কে জানে! 

শ্মশানের সৎকার কার্য শেষে যে কালো ধোঁয়া মিলিয়ে যাচ্ছে তা একা একাই বলছেন,
'পাঠকের পরিপাকশক্তির উন্নয়নে আমার কোনো স্থান নেই। দায়ী ওই উল্টোশৈশবকৈশোর! এরপর বোদলেয়ার পড়ে কবিতার পুস্পল প্রদেশ সম্পর্কে ভুল ধারণা হয়েছিল। '
মানুষ তো জেনে বা না জেনেই স্বয়ংজাত ভুল-ওমনিবাস! এইসব ভুল সঙ্গে করে একা চলে গেলেন পার্থপ্রতিম।  

রাত্রি এখন হয়তো নিজেই কোনো এক দূরগম্যতায় বসে চতুর্দশপদী লেখায় ব্যস্ত…

ঋণ: রণজিৎ দাশ, গৌতম চৌধুরী, সমরজিৎ সিংহ, সুব্রত সরকার, অনুরূপ ভৌমিক, বিকাশ গণচৌধুরী

কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল আর নেই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।