ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ভাবাও সকলে

শামীম আজাদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০২১
ভাবাও সকলে মুস্তাফিজ শফির

শফিকে দেখার আগে তার বাঁশি শুনেছিলাম। দেখা হয়েছে তার প্রায় কুড়ি বছর পর।

সে বাঁশি যাদের বুকের বাতাসে পুষ্ট হয়ে ওষ্ঠ থেকে বাণী হয়ে আমার কানে পৌঁছেছিল তারা সবাই লন্ডনের বাসিন্দা ও আমার অনুজসম। তখন তাদের বয়স ছিল কুড়ি বা একুশ। আমি তখন বিলেতে পড়াতে এসেছি মাত্র।
 
ধারণা করি তাদেরও শফির মতোই ১৯৭১-এ জন্ম হয়েছিল। আর না হলেও তার কাছাকাছি সময়েই হবে। সে আজ থেকে কুড়ি বা বাইশ বছর আগের কথা। লন্ডনের সাপ্তাহিক সুরমা পত্রিকায় মুস্তাফিজ শফির লেখা নিয়ে আমি আমার আগ্রহ প্রকাশ করতেই সে বাঁশিগুলো বেজে উঠেছিল। আর আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। না, স্বরব্যঞ্জনার জন্য নয়, আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম ফারুক আহমেদ রনি ও আবু তাহের কীভাবে তাদের বন্ধু শফিকে চেনাচ্ছিলেন। মানুষ অচেনা জিনিসকে চেনা বিষয় বা বস্তুর সঙ্গে তুলনা করেই তাকে মূর্ত করে তোলে। ওই তরুণ কবি ও লেখক তাদের বন্ধুকে বর্ণনা করতে গিয়ে সব ভালো লেখা ও দেখা নিয়ে এসেছিল। তাদের চোখে-মুখে শুধু গর্বই নয়, শফির প্রতি তাদের প্রগাঢ় আস্থাও লক্ষ্য করেছিলাম। তাদের শেষ কথা ছিল, শামীম আপা আপনি ওকে দেখলে বুঝতেন।  

অতঃপর আমি মুস্তাফিজ শফির কিছু প্রতিবেদন পড়ি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার অবস্থান ও স্থানান্তর লক্ষ্য করি। কিন্তু তার লেখার বিষয়বস্তুতে একটা ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করি। সবচেয়ে বড় কথা আমি তার সৃজনে যে মনন প্রত্যক্ষ করতে সমর্থ হয়েছিলাম তা তার বন্ধুদের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল এবং তা কিন্তু তাকে বাস্তবে দেখার আগেই। বাস্তবে যেদিন দেখি, প্রথম সম্ভাষণেই আমরা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কুশল বিনিময় করি। সুদর্শন শফিকে দেখে মনে হচ্ছিল তার মাথার ভেতরে একটি ফ্রিজ বসানো। এতই স্থিত সে। কিন্তু স্বভাবের পরিচয় পেয়ে বুঝি এই মিষ্টত্ব আসলে তার জন্মভূমের জলঢুপি আনারসের মতোই।

তার গাত্রবর্ণও সে রকমই সোনালি। মুখের হাসিটি আবার কিন্তু প্রাজ্ঞের। আমি দেখে ভাবতাম, এমন ভাবুক হাসি সে কোথা থেকে পেল। পরে বুঝলাম, সাধারণত যে সময় আমাদের দেশের অধিকাংশ তরুণ অতিস্বচ্ছ বিষয় নিয়ে, বিনোদিত হওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে তা থাকেনি, থাকে না। ততদিনে নানান সময়ে আমার বাংলাদেশ আসা-যাওয়ার ও দেশের সাহিত্য জগতে নিরন্তর লেখালেখির কারণে আমি তার ‘আপা’ হয়ে গেছি। আর বিলেতে ফিরে এসে কথা প্রসঙ্গে তার প্রশংসা করলেই রনি ও তাহের লাফিয়ে উঠে বলেছে, আমরা কইছলাম না? আফা অনে দেখলা তো! 

শফির ‘একাত্তরের বিজয়িনী’ পড়ে আমাদের তৃণমূল পর্যায়ের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা জেনে বিস্মিত হয়ে ভেবেছি বাংলাদেশের জন্মের সময় যে ছিল শিশু, সে কী করে এভাবে আমাদের দেশের আত্মার ক্রন্দন তুলে আনছে! আমার চোখ ভিজে গেছে। আর সে সময়টাই ছিল আজকের বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যের সূচনাকাল। পঁচাত্তরের পর যে ধারার ধোঁয়া দেশের ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে আবছা করতে করতে মিথ্যাকে মিথে পরিণত করছিল, তখন এই তরুণের সত্য কথন আমাকে অবাক করেছে। বুঝে প্রত্যাশার বীজ বুনেছে। আজ মনে হয় পরাজিত শক্তির গোড়ায় শুধু দেশের বিরুদ্ধশক্তি একাই জল দেয়নি, দিয়েছে আত্মপ্রেমে বিভোর রাজনীতিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবীরাও। দেশকে দেখানোর সময় বিউটিপার্লারের মতো বাইরে থেকে মেনিকিউর আর পেডিকিউর করা হয়েছে। দেশের স্বাস্থ্য সংরক্ষণ করা হয়নি।

দেশপ্রেমের ব্যাপারে আমি একটা কথা বলি। তা হলো, দেশপ্রেমও বাল্যকাল থেকে ধর্মের মতো করে শিক্ষা দিতে হয়। আমরা যে পরিবারে জন্ম নিই তার ধর্মীয় আচার-আচরণ রপ্ত করে পরকালে বেহেশতের ব্যবস্থা করি। আর সে বাড়ির সরাসরি নির্দেশনায় বিদ্যা শিক্ষা নিই অর্থ আয়ের জন্য, আরামে থাকার জন্য। কিন্তু ও দুটো বা তার সঙ্গে অন্য আনুষঙ্গিক আয়ত্ত করার জন্য যে দেশ আমাকে একটি জাতীয়তা দিয়েছে, ভূমি দিয়েছে, একটি ভাষা দিয়েছে তা নিয়ে ভাবি না। তা এত অনায়াস লব্ধ হয়ে যায় যে তার আর স্বাস্থ্যরক্ষা নিয়ে আমরা ভাবিই না। দেশকে ভালোবাসাও প্রেমের মতোই একই রকম, চর্চায় এর বৃদ্ধি এবং অবহেলায় তার সমাপ্তি। ধারণা করি আমাদের এই পঞ্চখণ্ডের ছেলেটির পরিবার তা করেনি।  

সাংবাদিক ছাড়াও শফির কবি ও লেখক হিসেবে প্রগাঢ় পরিচয় রয়েছে। এবং তার সব কিছুরই ভিত দেশের ইতিহাসের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা থেকেই। এ আমাদের বড় সৌভাগ্য।  

সুবর্ণজয়ন্তীতে তাই শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে মনে হলো, শফির আপা বলে আমারও গর্ব তাকে নিয়ে। বেঁচে থাকো ভাই। আপনি আচরি ধর্ম ভাবাও সকলে। তোমার মঙ্গল হোক।

লেখক: কবি ও কলামিস্ট

বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০২১
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।