ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

৫০তম জন্মদিনে শামীম কবীরকে স্মরণ 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০২১
৫০তম জন্মদিনে শামীম কবীরকে স্মরণ 

পরিচিতি: শামীম কবীর

৭১ সালের ১৯ এপ্রিল যুদ্ধের এক দিনে বগুড়ার কালাইনাটাইপাড়া গ্রামে নানাবাড়িতে শামীম কবীরের জন্ম। বাবার কর্মসূত্রে শামীম কবীর বেশিরভাগ সময় বগুড়াতেই কাটিয়েছেন।

ক্লাস সেভেন থেকে রংপুর ক্যাডেট কলেজ এবং সেই সূত্রে কবিতার সঙ্গে অধিক সখ্যতা। ক্যাডেট বন্ধু তাজুল হক সম্পাদিত নব্বইয়ের ছোট কাগজ ‘নদী’র সঙ্গে সম্পর্ক শামীমের কবিতা প্রেমকে ইমাজিনেশন থেকে বাস্তবের পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিল। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ‘কোথায় দেবো রাজস্ব’ নামে কবিতার পান্ডুলিপি তৈরি করে শামীম। সেখানে তাকে লিখতে দেখি...

‘এই ঘরে একজন কবি আছে রক্তমাখা গালিচায় শুয়ে
কুয়াশার মতো তার নিদ্রামগ্ন ভাসমান চেখে ধীর লয়ে
শীর্ণ এক নদীর প্রতিমা ফ্যালে সুরমায় ছায়া, শতাব্দীর
শুদ্ধতম শিলাখণ্ড শিয়রে তার- ঠিক একগুঁয়ে ধীবরের মতো...."
-এরকম সব বাক্যগুলো। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পর ক্যাডেট কলেজ কর্তৃপক্ষ দেয়াল পত্রে নিয়ম না মেনে কবিতা লেখার দায়ে কলেজ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়।

১৯৯১ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করার পর শামীম প্রথাগত পড়ালেখা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একমাত্র কবিতার সঙ্গেই দিন কাটাতে থাকেন। ১৯৯০ থেকে শুরু করে ৯৪-এর জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ঢাকায় বন্ধুদের সঙ্গে চলে বোহেমিয়ান জীবন-যাপন। সমসাময়িক এবং পূর্ববর্তী কবিদের সাথে ঘনিষ্ঠতা, রাত-যাপন, বিরামহীন আড্ডা, তরল, কঠিন সবরকম জীবনের মধ্যে দিয়ে ভ্রমণ। ৯৪-এর জানুয়ারিতে প্রত্যাবর্তন রওশনভিলা রহমান নগর বগুড়া ৫৮০০ এই ঠিকানায়্। বেশিরভাগ কবিতা তখনই লেখা হয়, পাশাপাশি আঁকাআঁকিও চলতে থাকে। মা’র সঙ্গে বাক্যালাপ, মনে হচ্ছে যাচ্ছে রেল, নভেরা, মরিচিকা পাঠ, তিন ছাড়া অন্য সংখ্যা কিছু নয়...কবিতাগুলো তখনই লেখা। যা তাকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করে তুলেছিল।  

৯৫-এর ২ অক্টোবর, সোমবার সন্ধ্যা ৭টায শামীম বগুড়ায় নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেন। বন্ধুরা কেউ সেখানে উপস্থিত ছিলেননা, কেউ জানতেই পারেনি কবিতার সঙ্গে শামীমের এই সাময়িক বিচ্ছিন্নতার কথা। তবু কবিতা হ্যাঁ কবিতাতেই সে নিমগ্ন হয়ে আছে, এতোটা দিন, এত এত বছর পরেও।

৯৭-এ দ্রষ্টব্য শামীমের অধিকাংশ লেখা নিয়ে প্রকাশ করে ‘শামীম কবীর সমগ্র’।

২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নভেরা হোসেন এবং পিয়াস মজিদের সম্পাদনায় অ্যাডর্ন পাবলিকেশন খেকে প্রকাশিত হয় ‘নির্বাচিত কবিতা: শামীম কবীর’।  
……………………………………………………………………………………


শামীম কবীরের কবিতা

পৈত্র

হর্হে লুই বোর্হেসের সাথে দ্যাখা হলো অকস্মাৎ
তিনি আপেল বিক্রেতা আর
ক্রেতা সাধারণ সেই আপেল কিনেছে আর
খেয়ে বহু গল্প বানিয়েছে
কেউ ক্রেতা বলে : বড়ো ঝাল ফল
সে বা তিনি উষ্মাভরে লিকার ঢালেন
কেউ বলে : এরকম সাক্ষ্য দেওয়া আমাকে সম্ভব নয়
তবে ভরা সৌম্যতায় ঘর ছিলো অতীব চতুর
এর ওর সবাকার সাক্ষ্য নিলে দেখো সুন্দরক
ফলে তারা তারাও জানে না হত্যাকালে
কোমল মসৃণ এক চাতালের মধ্যে রাখে
পাটাতন আর কার্পেটের নিচে ঠেসে ধরে কেউ
উগ্র শিক্ষিকাকে তাঁর রাগ খুব বেশি
কারাগার থেকে তাই মুক্তি পেয়ে গেনু
রক্তমাখা ছুরি হাতে বেরিয়ে এসেছি

বলে দাও কোথা মাতা পিতা কোথা চলো
তাদের মিলনক্রিয়া বন্ধ ক’রে বেকুব বানাই
কেবল খড়ের গাদা নিরাপদ ভেবে যারা সেইখানে
টেপাটেপি করছিলো তবুও তো কথা
শামুকের সঙ্গে বার্তা কহো
অবশ্য সে কথা শিখে নাই যদি আগুন লাগাই
সেইসব খড়ে
বোর্হেসের কতো পুত্র হিসাব তা নেই পুড়ে যাবে
ঘোরানো সিঁড়ির মতো পাক খেয়ে কড়ি উঠে গ্যাছে
সেইপথ বাৎলে নিয়ে
বাবারা খোঁজেন ছেলেদের
মায়ের নোলক আর বোনের কোমরবিছা বৃথা গ্যালো
বিদায়ের ঘণ্টাকালে আর ফিরে দেখি নাই
কারণ সে আদ্যোপান্ত কান্না সঞ্চয়ন করে ক’রে
একফালি ধ্বংসখণ্ড ছাপা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে
মেয়েটি প্রস্তাব করে : এসো
সাপের কুণ্ডলী খাও ব্যাঙ সেদ্ধ যতো দিন যাক

নকল প্রভাত এসে প্রশ্ন করে : আমি কি প্রভাত?
তৎক্ষণাৎ কফি আসে তার সাথে তার
ঈশ্বরের কমতি পড়া মাটি দিয়ে ঐ ছুকরি গড়া
উঁচানিচা নেই তাও অনায়াসে ভালোবাসা হয়

বোর্হেসের ক্ষুদ্র হিসেবেও
এতোবড়ো গণ্ডগোল হ’লো ক্যানো কবে
পৃথিবী যেদিন থেকে চূড়ান্ত গতির থেকে ক’মে যাচ্ছে যায়
আমি বোর্হেসের অতি শুদ্রবুদ্ধি পরীক্ষণ ক’রে
যাকে তাকে দ্যাখাবো বা দেবো এরকম
এমন ধাঁধাটি বলি:
শুরু করি: সেই গল্প হারাবোনা
গল্পটি যে শেষ হ’য়ে যাচ্ছেই
তার চেয়ে পোস্টাপিসে যান
এবং শেষের পরে বিন্দুমাত্র ট্র্যাক থেকে যায়
স’রে গিয়ে বেহিসাবে অচেনা বা কেউ চেনা
প্রকাণ্ড মাছের স্তূপ উঠানে শুকিয়ে শুঁটকি হয়
যে যে শুঁটকি হতে চাও ঐ সেই ঝুলে ঝুলে থাকো
বাঁশের ফলায় মাচা মাচা


অবলা সংলাপ


কী যে ভুল ঘোর লাগে কাহ্নু বাশি শুনে দুর্বল গাছের ডালে আমার যে প্রাণপাখি বাঁধা আহ আগাই পিছাই শুধু হ্নৎপিণ্ডে খুন্তি ছ্যাঁকা পুরান কাঁথার নক্সা কতো আর চক্ষেসয় জানালায় টিয়া ডাকে তীরন্দাজ কোন সে দর থেকে বুকে মারে বাণ আমার চোখের জলে বন্যা নামে বুঝি আমি কি ফ্যালানী ছাই প্রাণসখা আমাকে পোছে না কতোজন আসে যায় হাট ভাঙে করল্লার লতাটাও কঞ্চিমাচা জড়িয়ে ধরেছে ওই কলাঝড়ে হাঁটে বুঝি কেউ মর ছাই আলতা গাই ওটা কী যে ভুল নিদ নাই গলায় শাদা নলা নামতে না চায় হায় প্রাণনাথ কোন বনে ঘোরে ঘরে শান্তি মনে নাই আমার যে প্রাণ বিষ কেউ জানলে সর্বনাশ হবে ওলো সই তোকে কই কাহ্নু প্রিয় এলে বলে দিস পোড়ামুখী কলস নিয়ে যমুনা গিয়েছে।

একটি নোম্যানসল্যান্ডের স্বপ্ন
একটি নোম্যানসল্যান্ডের পথ বেয়ে বসে আছি
অন্য এক দোল খাওয়া মাঠে
মাঠের উত্তরে আছে উঁচু এক বিম্বনাশী টিলা
সে টিলার খাঁজে ভাঁজে ফুটে থাকে দোদুল ফুলেরা

দক্ষিণের বায়ু এসে পরগায়নের সাথে
পাখি ও প্রজাপতির দীর্ঘশ্বাস মেশায়
অন্য সকলও

পূর্বে আছে পিত্রালয়
পথের কিনারগুলো কেটে ছেঁটে কুরতি
সেই পথে বহু মৃদু শ্যাফ্ট-এর সুরে
ভেসে আসে মায়েদের ব্যথা

অমরার নিভু নিভু বিচ্ছুরণ কালে
সে আসবে পশ্চিমের প্রকাণ্ড পশ্চিমগুলি ভেঙে
আর আমি সেই নোম্যানসল্যান্ডেতে শুয়ে ব’সে

হস্তমৈথুনের জন্য ঝোপ ঝাড় তৈরি করে নেবো
আর আজ আমি উষ্ণ উজ্জ্বল কাঠের জুতোয় ঢুকে
মজা লুটি সাত-রশ্মি দিবস রজনী


এই ঘরে একজন কবি

এই ঘরে একজন কবি আছে রক্তমাখা গালিচায় শুয়ে
কুয়াশার মতো-তার নিদ্রামগ্ন ভাসমান চোখে ধীরলয়ে
শীর্ণ এক নদীর প্রতিমা ফ্যালে সুরময় ছায়া, শতাব্দীর
শুদ্ধতম শিলাখণ্ড শিয়রে তার-ঠিক একগুঁয়ে
ধীবরের মতো : ছিন্নভিন্ন-ছেঁড়া জালে কৌশলে মরা নদীর
শ্রোণী থেকে অপরাহ্ণে রূপালী ইলিশ ছেঁকে নেবে; পঁচাঘায়ে
গোলাপের মধু ঢালা-অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে য্যান। ভীষণ অস্থির
হাতে সে ক্যাবল বিষণ্ন খুঁড়ে চলে শব্দের গোপন তিমির।

কবির আঙ্গুল থেকে অনর্গল রক্ত ঝরে আর মূর্তিবৎ
অন্ধকারে পড়ে থাকে সে-ক্যামন মর্মন্তুদ অদৃশ্য বল্কলে
ঢেকে অস্তিত্বের ক্ষত। অবশ্য মাঝে মাঝেই বদ্ধ ঘরময়
গলিত বাতাস কাঁপে-অন্তর্গত সজীব গর্জনে: বাঁধা গৎ
ভুলে গিয়ে-নিদ্রিত কবির বীণা সহসা কী প্রখর আদলে
গড়ে সুরের প্রতিমা, অথচ খোলে না তার অন্ধচক্ষুদ্বয়।


স্বপ্ন

         যা মনে হয় তা মনে করার জন্য যা লাগে
         তা এক অপার উজ্জ্বল উপত্যকা
         ওই সেখানে চ’রে বেড়ায় ভাঁজে ভাঁজে
          তোমার গন্ধলোলুপ সন্তান
         খেয়ে খেয়ে কর্কশ রুগ্ণ পাথর
         ও প্রকৃতি
         আজ দেখলাম মেঘমন্দ্র উচ্ছলতার  দাগ
         এবং বাহান্ন জন প্রপিতামাতার
         সেইসব চেহারা
         আমি আজ
         আর দেখলাম সেই
         আজ পুত্র শোকে ছেয়ে যাক আকাশ
         আকাশ থেকে ঘেমে আসুক
           বাতাসের গর্তে গর্তে ভরা গর্বে
         এবং পাতালের থেকে ওঠা থাক থাক ঈশ্বরলীলার দেহময়
         গোপনে প্রবিষ্ট হও এর প্রাচীনতা
         ওঁ মোজেইক ধাম
          ও পাথরের শিখা
         তুমি আর জ্বালতে জ্বালতে জ্বালতে
         পারো না
         হায়

         আমি
                  এ
                      ই
                        ভা
                           বে
                               ই
                                   কি ভেসে ভেসে থাকবো প্রান্তরে
         তোমার ঘর আমাকে নিয়েই ছোটে
         আর তার গা’য় মেঘ
         জ’মে
          জ’মে
          জ’মে
         ঝাপসা হ’য়েছে রং
         মেঘ প্রান্তরে  শিশুমেষ চমকায়
        পুলকে
         আলোকে
         ঝলকে
         উড়ে থাকো আবহ কাঁকাল
         উড়ে থেকো

থৈ থৈ

         ভেসে যেতে যেতে যেতে যেতে
         শোকএ এসে ঠেকলো স্কন্ধহীন পায়া
         বদ্ধ শোকে
         চারবার
        তারপর
        তখন আসলে আর কিছুই ছিলো না

বাংলাদেশ সময়: ১১১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০২১
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।