ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

তুমি আমাকে শিকড়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাও

অমর মিত্র | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২১
তুমি আমাকে শিকড়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাও

ইমদাদুল হক মিলনের ফোন আজ থেকে বছর তিরিশ আগে প্রথম পেয়েছিলাম। নামটি ওপার থেকে এপারে ভেসে এসেছিল তখনই, নামি-জনপ্রিয় লেখক।

কলকাতায় এসেছেন, আলাপ করবেন আমার সঙ্গে। সেই প্রথম পরিচয়। অবাক হয়েছিলাম, মিলন আমার ১৯৭৭-৭৮ সালে লেখা গল্পও পড়েছেন। ১৯৭৯ সালে লেখা উপন্যাস ‘পাহাড়ের মতো মানুষ’ও পড়েছেন। এত আন্তরিক, এত পড়ুয়া লেখক মিলন, আমি তখন তাঁর কিছুই পড়িনি। সেই সময়ে এখানে বাংলাদেশের বই ছিল অমিল। বাংলাদেশের লেখকদের খবর আমরা পেতাম না। হাসান আজিজুল হক এ দেশে পরিচিত ছিলেন। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহকে চিনতাম, পড়েছি। আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ পড়েছি। কিন্তু আলাউদ্দিন আল আজাদ ছিলেন অচেনা। পরে আমরা অনেক অনেক লেখককে চিনেছি, পড়েছি। অপরিচয়ের গণ্ডি মুছে গেছে। এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে সব কিছুই পেতে পারি। যোগাযোগ হয়ে গেছে সহজ। মিলন জনপ্রিয় লেখক। কিন্তু নিজে লেখেন, “সৃজনশীল লেখক কোনো নির্দিষ্ট জায়গায়, তা যত মনোরমই হোক না কেন, থেমে থাকেন না। থাকতে পারেন না। জনপ্রিয়তার পিছুটান নিরন্তর তাঁকে বিক্ষত করলেও সব ঝেড়েঝুড়ে দাপটে এগিয়ে যান তিনি। তাতে পাঠকহৃদয় ছিন্নভিন্ন হলেও লেখকের কিছু করার থাকে না...জনপ্রিয়তার লোভ লেখককে খুব বিভ্রান্ত করে” (‘শ্রেষ্ঠ গল্পে’র ভূমিকা)। আমার মুখে মিলনের কথা শুনে, কেউ কেউ বললেন, তিনি প্রেমের উপন্যাসই শুধু লেখেন। নাক উঁচু একজন বললেন, তেমন কিছু নন। কিন্তু কোনবার এসে নাকি সেবারই মিলন তাঁর ‘নূরজাহান’ উপন্যাসটি আমাকে দিয়ে যান। “দাদা, পড়ে দ্যাখবা তো! ম্যালা বইয়ের ভেতর এ-ও একটা বই। ” আমি ‘নূরজাহান’ পড়ে স্তম্ভিত হয়েছিলাম। এমন উপন্যাস লিখেছেন মিলন, অথচ নাক উঁচুরা বলেন, মিলন তেমন কিছুই লেখেননি। আমার মনে হয়, সাহিত্যক্ষেত্রে অনেক সত্য উচ্চারিত হয় না। আর এমন কিছুকে অতি বৃহৎ করে দেখানো হয়, যা আসলে বাতাসভরা বেলুন। পিন ফুটলেই তার বৃহৎ রূপ ফেটে যাবে। মিলন যে সত্যিকারের উঁচুমানের লেখক, তা ‘নূরজাহান’ পড়লে প্রত্যয় হয়। একটি মেয়ে একা। একা মেয়েটির লড়াই ‘নূরজাহান’। বাংলাদেশের সমাজজীবন ক্রমশ কিছু ধর্মান্ধ মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠছে। এখন এই চিত্রটি আরো প্রকট হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশে এই মধ্যযুগীয় চিন্তা আর আধুনিক চিন্তার একটা দ্বন্দ্ব রয়েই গেছে সেই সাবেক পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘বৃষ্টি’ গল্পে তার ছায়া আছে। আরো নিশ্চয় আছে, আমি পড়িনি। সব বই হাতে আসে না, সব গল্পও। কিন্তু ‘নূরজাহান’ হাতে এসেছিল।

‘নূরজাহান’ উপন্যাস কতকাল আগে লেখা, সাহসী লেখা, মিলন তা লিখেছেন। পড়ে মনে হয়েছিল, ইমদাদুল হক মিলন খুবই গুণী লেখক। তিনি বাংলাদেশকে চেনেন নিজের হাতের তালুর মতো। দেশ চেনা মানে দেশের মানুষ চেনা, প্রকৃতি, গাছপালা, মেঘ-বৃষ্টি, নদী-নাও, লতাগুল্ম, মাছ...সব। ‘নূরজাহান’ নিয়ে আমি একটি প্রতিক্রিয়া লিখেছিলাম ‘অমৃতলোক’ পত্রিকায়। সেই লেখাটি হারিয়ে গেছে। গত বইমেলায় মিলন কলকাতায় এসেছিলেন, বললেন, তাঁর কাছে সেই লেখাটি আছে। কী করে সংগ্রহ করেছিলেন, তা আমি জানি না। মিলন ওই দেশে বসেই খোঁজ রাখেন সব। আমার কিছু বই ওঁর কাছে আছে। আমি দিয়েছি, তিনি কিনেছেন আমার অজ্ঞাতে। বয়সে ছোট ইমদাদুল হক মিলনই কলকাতায় এসে আমাকে বলেন, “তোমার ‘ধনপতির চর’ কোথায় পাব দাদা, স্বপ্নময় কোথায়? ওর কী কী বই বেরিয়েছে বলো দেখি। জয়ন্তর বই কে ছেপেছে?” সব খোঁজ রাখেন। এত খোঁজ এপারের অগ্রজরা রাখেন না, অনুজরাও সবাই রাখতে পারেন না।

মিলনের গল্প পড়েছিও পরে। পড়ে মনে হয়েছে, তাঁর সম্পর্কে কত ভুলভাল কথা এপারে রটেছিল। ‘নিরন্নের কাল’, ‘মেয়েটির কোনো অপরাধ ছিল না’, ‘মানুষ কাঁদছে’, ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’, ‘লোকটি রাজাকার ছিল’, ‘মমিন সাধুর তুকতাক’...এসব গল্পের জন্যই মিলন বহুদিন পঠিত হবেন সাহিত্যের পাঠকের কাছে। আর এসব গল্প পড়লে ধরা যায়, মিলন কেন স্বতন্ত্র। ‘নিরন্নের কাল’ বাংলাদেশে এসেছিল। অনাবৃষ্টি-ফসলহানি বহু কৃষক পরিবারকে ভিখারি করে দিয়েছিল। এই গল্প সেই গল্প। এর বাস্তবতা ভয়ানক। দুর্ভিক্ষে দুই নাচার ভাইবোনের গল্প। বড় বোন, ছোট ভাই। বোনটি যেন সেই হতশ্রী ক্ষুধার্ত দুর্গা আর ভাই তেমনই অপু। না, তা নয়। তাদের কথা আমাদের জানাই হয়ে ওঠে না। দুর্ভিক্ষে মা গেছে ভিখ মাগতে। বাপ গেছে কাজের সন্ধানে। না পেলে ভিক্ষা। ভাই আর দিদি বাড়ি। দীনু আর বুলবুলি। পুরো গল্প লেখা হয়েছে উপভাষায়। ভাইবোনের কথোপকথনই গল্প। ভাই দেখেনি সোনার বাংলা। ক’বছরের খরায় সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। ভাই জিজ্ঞেস করে ধানের কথা, চালের কথা, ভাতের কথা। দিদি তা বলে। দীনু জিজ্ঞেস করে—
“পাকা ধানের রং কেমুন অয়, বুবু?
সোনার লাহান, গেন্দাফুলের পাপড়ির লাহান।
ঘেরান অয় না?
অয় না আবার! সাই ঘেরান অয়...”
অন্নের অভাব নিয়ে এই গল্প শুধু ধান, ধান চাষ, ধান কাটা, ধান ঝাড়া, চাল কোটা, ভাতের ফুট, গরম ভাতের বাসের কথা বলে যায়। মিলন যে শিকড় থেকে উচ্ছিন্ন কোনো শহরবাসী লেখক নন, তা তাঁর গল্প পড়লে ধরা যায়। ‘নিরন্নের কাল’-এর মতো গল্প বাংলা সাহিত্যে খুব কমই লেখা হয়েছে। আর এই গল্প পড়লে ধরা যায়, বাংলাদেশের গল্পে যে শিকড়ের ঘ্রাণ আছে, তা আমরা হারিয়েছি অনেক কাল। মিলন এই গল্পে একটু একটু করে ক্ষুধার পৃথিবীকে উন্মোচন করেছেন। বুলবুলি ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য কত রকম কথা বলে অন্ন নিয়ে! কামারবাড়ি যায় ভাইকে নিয়ে। তাদের বাগানে গয়া ফল আছে। কচুর লতি থাকতে পারে, তা দিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি হতে পারে। ক্ষুধা নিয়ে কামারবাড়ি যেতে যেতে বালকটি কিচ্ছা শুনতে চায়। কিচ্ছা শুনতে শুনতে পথ হাঁটলে পথ তাড়াতাড়ি ফুরাবে। কিসের কিচ্ছা? না, ধানের কিচ্ছা, মাছের কিচ্ছা...। আহা! পড়তে পড়তে চোখ ভিজে আসে নিজের অজান্তে। অন্নের খোঁজে গিয়ে বুলবুলি ধর্ষিত হয়। কী ভয়ানক এক সময়ের কথা লিখেছেন মিলন! ভাইবোন কামারবাড়ি গিয়ে কিছু পায় না। বড় সড়কের ধারে যে পুরনো দেবদারুগাছটি, তার ছায়ায় যেতে গিয়ে তারা সেই লোকটিকে দেখে, যে এক বস্তা চাল নিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল ছায়ায়। গঞ্জে চাল লুট হয়েছে, সে এক বস্তা পেয়েছে। চাল দেখে বুলবুলির লোভ হয়। চাল, থালা-বাসন ভর্তি ভাত, অন্ন। লোকটি ক্ষুধার্ত দীনুকে চার আনা দিয়ে বাজারে বিস্কুট খেতে পাঠিয়ে বুলবুলিকে চালের লোভ দেখিয়ে জঙ্গলে টেনে নিয়ে যায়। বুলবুলি বাধা দেয় না। তার চোখে ভাতের স্বপ্ন। তারপর আড়াই সেরের মতো চাল বুলবুলির আঁচলে ঢেলে দিয়ে চলে যায়। দীনু ফিরে দেখে চাল পেয়েছে দিদি। লোকটা চাল দিয়েছে দিদিকে। উল্লসিত হয় সে ভাতের স্বপ্নে। তখনই দেখে দিদির পাছার কাপড়ে রক্ত। “বুবু, তোমার কাপড়ে দিহি রক্ত! এত রক্ত বাইর অইলো কেমনে!”
বুলবুলি বলে, একবার ধান কাটতে গিয়ে তার বাবার আঙুল কেটে কত রক্ত বের হয়েছিল। পেট ভরে ভাত খেতে একটু রক্ত দিতে হয়...“আমিও আইজ পেড ভইরা বাত খাওনের লেইগা রক্ত দিছি। এইডি হেই রক্ত...”

মিলন অতি সাধারণ নিরুপায় মানুষের কথা জানেন, লেখেন। তাঁর গল্প পড়লে ধরা যায়, মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ তাঁকে লিখিয়ে নেয় ‘মানুষ কাঁদছে’ বা ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’-এর মতো অসাধারণ সব গল্প। এই দুটি গল্প পড়লে চেনা যায় একজন অতি আধুনিক গল্প বলিয়েকে, যিনি কিভাবে গল্প বলতে হয়, তার কত রকমই না জানেন। আমি বলছি আঙ্গিকের কথা। ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ গল্পটি পড়লে ধরা যায়, গল্পটি যত না এক ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের, তার চেয়ে বেশি ভালোবাসার। নেতার প্রতি ভালোবাসা। মিলনের ভালোবাসা আছে বাংলাদেশের স্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। তা তিনি প্রকাশ করেছেন অতলস্পর্শী করে। ‘মানুষ কাঁদছে’ গল্পটি অনেক মানুষের অনেক কান্নার গল্প। সেই গল্পের এক সামান্য ঠিকাদারের সামান্য কর্মচারী নিহত শেখ মুজিবের জন্য কাঁদে। কত রকম দুঃখ নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে, সেসব দুঃখ নিয়ে কাঁদে। এ এক আশ্চর্য গল্প। ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ গল্পে সন্দেহভাজন একটি লোককে থানায় ধরে এনেছিল পুলিশ। সে নেতার বাড়ির উল্টো দিকে বসে ছিল। কেন তা গুছিয়ে বোঝাতে পারে না। পুলিশের সন্দেহ, সে নিশ্চয় কোনো মতলবে গ্রাম থেকে শহরে এসে নেতার বাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করছিল। লোকটির সঙ্গে পোঁটলায় কী আছে? না, চিঁড়া। তার বাড়ির নামায় একচিলতে জায়গায় কালিজিরা ধান হয়েছিল সামান্য। তাতে পোনে দুই সেরের মতো চিঁড়া হয়েছে। সেই সুস্বাদু চিঁড়া নিয়ে সে নেতার কাছে এসেছে। নেতাকে সে বড় ভালোবাসে। গরিবের ভালোবাসা। পুলিশ বিশ্বাস করে না তার কথা। মনে করে, লোকটা নিশ্চয় কোনো মতলব নিয়ে এসেছে। রতন মাঝি আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলে, সে নেতাকে দেখতেই এসেছে দূর মফস্বলের গ্রাম থেকে। সেই লোকটার চিঁড়ার পোঁটলা পুলিশ কনস্টেবল নিয়ে নেয়। চিঁড়ার সুগন্ধে ঘর ভরে যায়। থানার দারোগা বলে ওই চিঁড়া টেস্ট করিয়ে আনতে, তার সন্দেহ ওর ভেতরে কিছু মেশানো আছে। লোকটিকে হাজতে ভরে দেওয়াও হলো। লোকটি হা-হুতাশ করতে থাকে, সে তো নেতার জন্যই চিঁড়া এনেছিল। পুলিশ তা নিয়ে নিল। থানার দারোগা সন্দেহ করেছিল, রতন মাঝি নেতাকে হত্যা করার জন্য এসেছে শহরে। পরদিন সকালে দারোগা ডেকে নেয় রতন মাঝিকে। বলে, তাকে আর আটকে রাখার দরকার নেই, কেননা তার প্রিয় নেতা আগের রাতেই নিহত হয়েছেন। সে এবার যেতে পারে। রতন মাঝি তখন বলে, না, তাকে আটকেই রাখা হোক, কেননা ছাড়া পেলেই সে নেতার হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে হত্যা করবেই। শোধ নেবে। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। আদ্যন্ত রাজনৈতিক গল্প মিলন কী সহজভাবে লিখে দিলেন। প্রকাশ করলেন তাঁর ভালোবাসা। বাংলাদেশের গল্প এটি, আবার এই গল্প পৃথিবীর যেকোনো ভাষার হতে পারে, এমনই এর সুগন্ধ। কালিজিরা ধানের চিঁড়ার মতো সুগন্ধ। মিলন সাহসী লেখক। ‘নূরজাহান’ উপন্যাসেই তা স্পষ্ট হয়েছিল। আমি তাঁর আরেকটি গল্পের কথা বলি, ‘লোকটি রাজাকার ছিল’। এই গল্প লিখতেও বুকের জোর লাগে। একটা লোককে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা ধরে এনেছে চোখ বেঁধে। জেরায় সে প্রথমেই স্বীকার করে নিল, হ্যাঁ, সে রাজাকার। তাতে হয়েছে কী? তার অপরাধটা কী যে এভাবে চোখ বেঁধে হাত বেঁধে ধরে আনতে হবে? তাতে মুক্তিবাহিনীর লোক অবাকই হলো। এখন তো তাকে জেরা করে নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারা হবে। মুক্তিবাহিনী ওই শাস্তিই দেয় রাজাকারদের। স্কুলঘরে নিয়ে এসে তাকে জেরা করা হতে লাগল। লোকটার মুখ দেখলেই ধরা যায় নির্বোধ ধরনের। সে বুঝতে পারছে না কারা তাকে ধরে এনেছে হাত বেঁধে চোখ বেঁধে। এই ছেলেরা কারা? হ্যাঁ, চেয়ারম্যান সাহেব বলল, রাজাকার হলে টাকা পাবে আর চাল-আটা পাবে। আর তা পেয়েছেও। রাজাকার হওয়ার পর তার বিবি-বাচ্চার পেটে ভাত পড়ছে। সে এত দিনে একটু সুখের মুখ দেখেছে। বন্দুক সে পায়নি। লাঠি দিয়েছে চেয়ারম্যান সাহেব। পরে বন্দুক পেলেও পেতে পারে। সে নিচের তলার রাজাকার। লাঠি নিয়ে হাটে-মাঠে, নদীর ঘাটে ঘোরাই তো তার কাজ। মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পেলেই চেয়ারম্যান সাহেবকে জানিয়ে আসা তার ডিউটি। চেয়ারম্যান সাহেব বলেছে, দেশের মালিক পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা লেগেছে। দেশের মালিকের পক্ষে যাওয়াই তো তার ফরজ। তাই সে পাকিস্তানকে উদ্ধার করতে রাজাকার হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কারা সে জানে না। তাদের সে চোখে দেখেনি। চেয়ারম্যান সাহেবের কথায় তারা অতি খতরনাক। তারা পাকিস্তান শেষ করে দিতে চায়। একটি হতদরিদ্র মানুষের কথা এই গল্প। সে যখন শোনে তাকে যারা ধরে এনেছে তারাই মুক্তিযোদ্ধা, অবাক হয়ে যায়। এরা তো তার গ্রামের ছেলেদের মতো। মুক্তিবাহিনীর নেতার কাছে একটা বিড়ি চায় সে, বদলে সিগারেট পায়। সুখটান দিয়ে তার দারিদ্র্য, রাজাকার হয়ে কী লাভ হয়েছে—সে কথা বলতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা তাকে তখন বোঝায় কেন মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানিরা কেন খারাপ। কী অত্যাচার করছে দেশের মানুষের ওপর। সে পাকিস্তানি মিলিটারি দেখেনি। তাদের গাঁয়ে তখনো পৌঁছায়নি। অবাক হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সব শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে উঠতে থাকে। বলে, তাহলে তো পাকিস্তানিদের হাত থেকে দেশোদ্ধার করাই তার কাজ। রাজাকার হয়ে খুব খারাপ করেছে। রাজাকারদের শাস্তি হওয়া দরকার। মুক্তিযোদ্ধারা যখন বলে, রাজাকারের শাস্তি হলো গুলি করে মেরে ফেলা, নদীর পাড়ে গিয়ে তা হয়, সে ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে বলে, তাহলে তাকে নিয়ে গিয়ে তা-ই করা হোক। কী অসামান্য এই গল্প বলা। অসহায়, নিরুপায় মানুষের প্রতি তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা, তাই এমন সব গল্প লিখতে পারেন। ‘নূরজাহান’-এর লেখক ‘নূরজাহান’ উপন্যাসের জন্যই স্মরণীয় থাকবেন। এসব গল্পের জন্যও। আমি স্মরণ করি একটি ভয়ানক মৃত্যুর কথা, যা ‘নূরজাহান’ উপন্যাসে আছে। বাংলা সাহিত্য অনেক মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছে, তৃষ্ণার্ত ছনু বুড়ির মৃত্যুকেও ভুলবে না। আমি ভুলিনি সেই বছর বিশ-পঁচিশ আগের পাঠ। তৃষ্ণার্ত ছনু বুড়ির মৃত্যুর পর লেখক যে পঙ্‌ক্তিটি লিখেছিলেন তা উদ্ধৃত করি:
“আকাশের ক্ষয়া চাঁদ তখন সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুর মতো অতিক্রম করছে কয়েক পা, জ্যোৎস্না হয়েছে আরেকটু ফিকে। কুয়াশার ঘেরাটোপ হয়েছে অবিকল মুর্দারের কাফন। পুরো থান খুলে সেই কাফনে কে যেন ঢেকে দিয়েছে সমগ্র প্রকৃতি, ছনু বুড়ির পর্ণকুটির। এই কাফন পেরিয়ে বয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই উত্তুরে হাওয়ার। ফলে বহতা হাওয়া হয়েছে স্তব্ধ। ”

মিলন, তোমার লেখার ভেতর দিয়ে আমি আমার পিতৃপুরুষের সঙ্গে কথা বলতে পারি। চিনতে পারি আমাদের ফেলে আসা সেই দেশ, আমার শিকড়ে ফিরতে পারি। তুমি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, কলকাতা

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২১
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।