ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

‘বিদ্রোহী’ মাথা উঁচুর নামগান

আসমা চৌধুরী  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০২১
‘বিদ্রোহী’ মাথা উঁচুর নামগান

স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর বেশ আয়োজন করে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। নতুন একটি ক্লাসের প্রস্তুতি হিসেবে একটু তৈরি করে নেয়া, একটু খুশি যোগ করে একটানা ক্লান্তির দিনগুলোকে চাঙ্গা করে নেয়া।

তখন প্রতি বৎসর নাটকও হতো নিয়মিত রিহার্সালের মাধ্যমে। আমাদের জীবনে সেই কয়েকটি দিন ছিলো দারুণ আমোদ আর আকাঙ্ক্ষার। কারণ আমরা বড় হচ্ছিলাম কোন স্বপ্ন ছাড়াই, আমাদের পেছনেও কিছু ছিলো না সামনেও কোন প্রত্যাশা ছিলো না। খেলাধূলায় নয় আমরা দলবেঁধে নাম দিতাম আবৃত্তি প্রতিযোগিতায়। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করা, বিশেষ ভঙ্গিতে নৃত্য করা, অভিনয়ে পাকা হওয়া সম্ভব না হলেও আমরা ভয় কাটিয়ে বুক ফুলিয়ে আবৃত্তি করতাম। কয়েকটি কবিতা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের' দুই বিঘা জমি', 'পুরাতন ভৃত্য 'প্রশ্ন' আর 'বীরপুরুষ '। নজরুলের 'বিদ্রোহী', 'মানুষ 'আর 'মোহররম'। আমরা সবাই ‘বিদ্রোহী’ বেছে নিতে চাইতাম। যখন উচ্চারণ করতাম, 'বল বীর চির উন্নত মম শির', কোথা থেকে ঢেউয়ের মতো ভেতরে জেগে উঠতো শক্তি। বেশ জোর পেতাম। কণ্ঠ আর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকতো না। যেন সেই ক্ষুদ্র মঞ্চে আমিই আমার কর্ণধার। চারপাশ চুপ হয়ে যেতো এক অমোঘ শক্তিতে। অথচ সেই বয়সে 'বিদ্রোহী' কবিতার কিছুই বুঝতে পারিনি। 'বিদ্রোহী' মানে তখন একটিমাত্র বাক্য, একটি মাত্র শব্দ, 'বল বীর...'

এই যে একশত বৎসর জুড়ে সমগ্র নজরুলকে প্রকাশ করছে একটি অরূপ কবিতা তার স্পর্শ, স্পর্ধা আজও কতটুকু ধারণ করতে পেরেছি? 

'আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে’

এই অসম্ভব শক্তি, ভয় ভাবনাহীন তারুণ্যের অন্য নাম কাজী নজরুল ইসলাম। তারুণ্যকে বুকে ধারণ করেছিলেন বলেই তিনি যত বড় কবি তার চেয়েও বড় যুগমানব। পরাধীন ভারতবর্ষকে শোষণ, শাসন করেছে ইংরেজ রাজশক্তি। নির্মম শোষণ, শাসনে অতিষ্ঠ এদেশের জনগণ। কবি হয়ে নজরুল কী চুপ করে থাকবেন? নজরুল যুগের সৃষ্টি, অফুরন্ত তাঁর প্রাণশক্তি, ভাষা মানবতার। তারুণ্যের শক্তিতে তাই তিনি গোটা বিশ্বকে অভিন্ন ভাবতে পেরেছিলেন। এক ধর্ম, এক ভাষা, এক সীমানার বন্ধনে বাঁধতে চেয়েছিলেন। আঠারো বৎসর বয়স তাকে অন্যরকম খোঁজ এনে দিলো, তিনি পল্টনে নাম লেখালেন। বুঝলেন অস্ত্র দিয়ে লড়াই করে ছিনিয়ে আনতে হবে স্বাধীনতা। ছাব্বিশ বৎসর বয়স তাকে নতুন করে জাগালেন, বুঝলেন নিজের শক্তি দিয়েই আদায় করতে হয় স্বাধীনতা। এটাই যুদ্ধ তবে ভিন্নরকম যুদ্ধ। দেশের আসল শক্তি দরিদ্র, নিরক্ষর জনগণ। এদের জাগাতে শুরু করলেন জাগরণের গানে, বিদ্রোহের কবিতায়, বক্তৃতায়। 'বিদ্রোহী' কবিতায় নজরুল সর্বাত্মক বিক্ষোভকে প্রশস্তি জানিয়েছেন। নতুন সৃষ্টির জন্য ধ্বংসকে অনিবার্য ভেবেছেন। এ কবিতা দিয়েই নজরুল ইসলামের বাংলা কাব্যক্ষেত্রে পরিচয়, এ কবিতাই তাঁর স্থায়ী প্রতিষ্ঠার কারণ কারণে।  

'বিদ্রোহী' এমন একটি কবিতা যার বয়স বেড়েছে কিন্তু উচ্ছাস আরো ঘন, আরো তীব্র হয়েছে অহংকার। একশত বৎসর জুড়ে সমগ্র বাংলাভাষী মানুষের মনের দরজাকে দুরন্ত আহবানে খুলছেন প্রবল প্রতাপে। 'বিদ্রোহী' রচিত হয় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে, সাপ্তাহিক 'বিজলী' পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং 'অগ্নিবীণা' কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়।

নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের যে চারটি স্তর রয়েছে তার প্রথম স্তরে রয়েছে 'বাঁধন-হারা' পত্রোপন্যাসের অভিমানী, ব্যর্থপ্রেমের বেদনায় আহত প্রেমিক। সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর আবির্ভাবের দুবৎসরের ভেতরেই 'বিদ্রোহী' প্রকাশের পরপরই দ্বিতীয় স্তরে এসে নজরুল নিজের ভেতরে অনুভব করলেন সাইক্লোনের শক্তি আর 'চপল মেয়ের কাঁকন চুড়ির কনকন'।

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে নজরুল যখন কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে পরিচিত হন তখন থেকেই তিনি ছিলেন বিদ্রোহী। 'বিদ্রোহী' প্রকাশের আগেই যে সব জনপ্রিয় কবিতা লিখেছেন সে সবে মুসলমানসমাজের গতানুগতিক জীবনের প্রতি ধিক্কার আর তাদের এক নবজীবনের জন্য তীব্র কামনা তবে 'বিদ্রোহী'তে এসে নজরল নতুন এক প্রাণশক্তিতে জেগে উঠলেন, সবকিছুকে দেখতে শুরু করেন নতুন এক শক্তিতে। 'বিদ্রোহী'তে এমন একটা সুর, এমন একটা চরম প্রত্যাখ্যান, পরাক্রম, প্রতিবাদ, এমন এক গৌরব আর দার্শনিক ভাব প্রকাশ পেলো তা সম্পূর্ণই নতুন। এই দ্বিধাহীন তারুণ্যই 'বিদ্রোহী' কবিতাকে দান করেছে চিরগৌরব। নজরুল এখান থেকেই লাভ করেন গভীর আত্মপ্রত্যয়, নিজেকে জ্ঞান করেন দুস্থ মানবতার অগ্রনায়ক হিসেবে।  

নিজেকে চিনতে পারার গভীর প্রত্যয়ে তিনি বলে ওঠেন, 

    'আমি উন্মাদ আমি উন্মাদ--
     আমি চিনেছি আমারে আজিকে আমার
                  খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ। '

'বিদ্রোহী' বিখ্যাত এ কারণে কবি এ কবিতায় পৃথিবীর সব উৎপীড়ন ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অক্লান্ত সংগ্রামে স্থির। 'বিদ্রোহী' আজ একটি বিখ্যাত কবিতা মাত্র নয়, একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে। সেই অমোঘ চরিত্র আজ দুর্বলের আশার মন্ত্র। প্রতিবাদের ভাষা। এখানের বহু ব্যবহৃত 'আমি' নানা মাত্রায় প্রকাশ করেছে ব্যক্তির স্বাধীনতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও শ্রেণি সাম্য। এই 'আমি' ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের, আত্মশক্তির, আত্মপ্রত্যয়ের, আত্মবিশ্বাসের ধারক। একটি কবিতায় এত এত জাগরণ যেন এক ঐশ্বরিক ক্ষমতায় স্রোতের মতো প্রবহমান। এই সূত্রে 'বিদ্রোহী'তেই নজরুল ইসলাম প্রথম প্রকাশ ঘটালেন কবিতায় এক আশ্চর্য ভাবগত ও ছন্দগত সৌন্দর্য। 'বিদ্রোহী'যেন নাচের শব্দ, গানের সুর, খণ্ড খণ্ড ছবি আর দুর্দান্ত এক পিপাসাকাতর শক্তি। কবিতার শিরোনামকে পাহাড়ের মতো অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছেন কবি সমস্তটা শরীর বেয়ে।

    'আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
    আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়। '

সেই কবে নজরুল তাঁর 'যৌবনের গান' প্রবন্ধে বলেছেন, 'পথ-পার্শ্বের ধর্ম-অট্টালিকা আজ পড় পড় হইয়াছে, তাহাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া দেওয়াই আমাদের ধর্ম, ঐ জীর্ণ অট্টালিকা চাপা পড়িয়া বহু মানবের মৃত্যুর কারণ হইতে পারে। যে- ঘর আমাদের আশ্রয় দান করিয়াছে, তাহা যদি সংস্কারাতীত হইয়া আমাদেরই মাথায় পড়িবার উপক্রম করে, তাহাকে ভাঙ্গিয়া নূতন করিয়া গড়িবার দুঃসাহস আছে একা তরুণেরই। 'আজও এই ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলার প্রেরণা ভেতরের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। 'বিদ্রোহী'ও এই একই আহবান জানায়।

কবির ব্যক্তিত্বের প্রবল স্ফূরণও ঘটেছে এই 'বিদ্রোহী' কবিতায়। স্বদেশ ও সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সেই ব্যক্তিসত্তা ধ্বংসের ভেতর দিয়ে চায় নতুন সৃষ্টি। হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম রণ দামামা বাজিয়ে ঘরে ফিরলেন, সেই সাথে যুক্ত হলো রাশিয়ার লাল পল্টনের রণ হুঙ্কার। এই বিপুল উত্তেজনা ও উন্মাদনা  যে তাঁর কাব্য প্রয়াসে ব্যর্থ হলো তা নয়, কারণ 'বিদ্রোহী' যুগ বিশেষভাবে উঠে এসেছে নজরুলের কাব্য আলোচনায়। সর্বস্তরের মানুষ খুঁজে পেয়েছে নতুন এই শক্তি, যা তাদের আরাধ্য ছিলো। যেন নিজেরা এই নতুন প্রাণশক্তির ছোঁয়ায় জেগে উঠেছে নতুন উদ্যমে। নজরুলের বিদ্রোহী চেতনার ধারাবাহিকতা পরিণতি পায় বিপ্লবে। তাঁর বুকের ভেতরে যে গভীর সত্য তা মুক্তির ও কল্যাণের। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি পূর্ণভাবে ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছেন। অখণ্ড ভারতের স্বপ্নও ছিলো নজরুলের মনে। তিনি বিশ্বাস করতেন পরাধীন দেশের প্রতিটি মানুষের অধিকার রয়েছে স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ করার। কবির 'রাজবন্দীর জবানবন্দিতে' সেই মুক্তির জন্য বিদ্রোহের কথা, দেশপ্রেমের সত্য উন্মোচিত হয়েছে। এই সংকল্প যে নিছক ঘোষণা বা রোমান্টিক কবির নিছক বলা নয় তা প্রমাণ পাওয়া যায় নজরুলের জীবন ও সাহিত্যে। 'বিদ্রোহী' কবিতার শেষ স্তবকে তাই দেখি কবি ভগবান বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেয়ার সাহস করতে পারেন। কবি যখন  বলতে পারেন--

     'মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না-/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না/বিদ্রোহী-রণ-ক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত। '

তখন আমাদের সামনে মাথা উঁচু চির বিদ্রোহী এক কবি বারবার সামনে এসে দাঁড়ায় অনন্য এক উচ্চতায়। আজও আমরা উপলব্ধি করি সেই গভীর সত্য, হয়তো দিন বদলে গেছে প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক বদলে দিয়েছে জীবন-মান কিন্তু 'বিদ্রোহী' কবিতার যে দর্শন, যে আজন্মের প্রতিবাদ তা এখনো ভীষণ ভীষণ টাটকা। এখনো রক্তে জাগায় আশা আর আবর্জনা পরিষ্কারের ইশারা।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০২১
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।