ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

পর্যটকমুখর সুন্দরবন

মাহবুবুর রহমান মুন্না, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৪
পর্যটকমুখর সুন্দরবন

খুলনা: রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ফের পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে সুন্দরবন। পুরনো চেহারায় ফিরে এসেছে এখানকার পর্যটন স্পটগুলো।

আর বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও সুন্দরবন দিবস এক দিনে হওয়ায় শুক্রবার যেনো একটু বেশিই ভিড় জমেছে সুন্দরবনে।

অপরূপ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের জোয়ার ভাটা, বনের সুন্দরী গাছ, বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী চিত্রা হরিণ আর বিচিত্ররূপের এ বনকে দেখতে দেশ বিদেশের পর্যটকরা প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন এখানে। বিশেষ করে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস শুক্রবার হওয়ায় সরকারি-বেসকারি চাকরিজীবীরাও ছুটে আসছেন সুন্দরবনে। আর এ কারণে পর্যটক সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বিগত দিনের লোকসানের ধকল কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।

বাংলানিউজের বিশেষ অনুসন্ধানীতে জানা যায়, সুন্দরবনকে ঘিরে খুলনা অঞ্চলের ছোট-বড় প্রায় অর্ধ শতাধিক পর্যটন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চলতি শীত মৌসুমের প্রথমে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকায় পর্যটক না আসায় প্রতি মাসে তাদের এসব প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। তবে মৗসুমের শেষ প্রান্তে এসে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থির হওয়ায় পর্যটকরা আবারও আগের মতো সুন্দরবনে আসতে শুরু করেছেন।

শুক্রবার খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সুন্দরবনপ্রেমীরা বনের করমজল, হাড়বাড়িয়া, কটকা, কচিখালী, ত্রিকোন আইল্যান্ড, টাইগার পয়েন্ট, দুবলা ও হিরণ পয়েন্ট এলাকায় গত দু’দিনে ভিড় জমিয়েছেন। ফলে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়েছে এসব এলাকায়।

বন বিভাগ, মংলা বন্দরের রেস্ট হাউজ ও সুন্দরবন অভ্যন্তরে ৫টি ঘুর্নিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে এখন পর্যটকদের ভিড় লেগেই আছে।

সিলেট থেকে সুন্দবনে ঘুরতে আসা পর্যটক মো. মাহমুদ বাংলানিউজকে জানান, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস শুক্রবার হওয়ায় ও শনিবার সরকারি ছুটি থাকায় তিনি সুন্দরবনে ঘুরতে এসেছেন।

বীমা কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন বাংলানিউজকে জানান, এ বছর তাদের বাৎসরিক পিকনিক করতে সুন্দরবনে এসেছেন।

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও সুন্দরবন দিবস একদিনে হওয়ায় আনন্দটা একটু বেশি হচ্ছে বলে জানান তিনি।

ঢাকা থেকে আসা পর্যটক ইখতিয়ার হোসেন জানান, ডিসেম্বর মাসে বিয়ের পর ঠিক করেছি স্ত্রীকে নিয়ে সুন্দরবন ভ্রমণে যাব। কিন্তু রাজনৈতিক অস্তিরতার কারণে সেসময় সুন্দরবনে আসা সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমান দেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় শুক্রবার ভোরে আমরা সুন্দরবনে এসেছি।

খুলনার হোটেল ক্যাসেল সালামের কর্মকর্তা জোসেফ ডি কস্তা বাংলানিউজকে জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতার কিছুটা অবসান হওয়ায় পর্যটন মৌসুমের শেষ সময় দেশ বিদেশের ভ্রমণ পিপাসুরা সুন্দরবনে আসতে শুরু করেছেন। যার কারণে হোটেলের বুকিং সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।  

মংলার পশুর হোটেলের কর্মকর্তা মুনসুর আহমেদ বাংলানিউজকে জানান, ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকেই দেশ বিদেশের ভ্রমণ পিপাসুরা সুন্দরবেন আসতে শুরু করেছেন। যে কারণে প্রতিদিনই তাদের অতিথি বাড়ছে বলে জানান তিনি।

লঞ্চ মালিক মো. আব্দুল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, সুন্দরবনের পর্যটনকেন্দ্রগুলো এখন জমজমাট। পর্যটকদের আনাগোনা অনেক বেশি। অন্য বছরের তুলনায় এবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও সুন্দরবন দিবস উদযাপন করতে কয়েকগুণ বেশি পর্যটকের আগমন ঘটেছে সুন্দরবনে।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও সুন্দরবন দিবস উপলক্ষ্যে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ এই বনের নয়ানাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য ও চিত্রল হরিণ, রয়েল বেঙ্গল টইগার, কুমিরসহ বন্যপ্রাণীর চলাচল উপভোগ করতে বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসছেন হাজার হাজার পর্যটক।

সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আব্দুর রব বাংলানিউজকে জানান, সুন্দরবনের করমজলসহ কয়েকটি পর্যটন স্পটে প্রচুর সংখ্যক পর্যটকের আগমন ঘটতে শুরু করেছে। যার কারণে খুলনা, বাগেরহাটের শরণখোলা, মংলায় অবস্থিত পর্যটন করর্পোরেশনের মোটেলসহ সকল আবাসিক হোটেল এমনকি সুন্দরবনের রেস্টহাউজগুলো পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। চলতি মৌসুমে সবচেয়ে বেশি পর্যটক গত সপ্তাহে সুন্দরবনে ভ্রমণ করেছেন।

তিনি আরও জানান, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২ হাজার পর্যটক সুন্দরবন করমজল পর্যটন কেন্দ্রে ভ্রমণ করেন। যে কারণে সরকারের রাজস্ব বাড়তে শুরু করেছে।

খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর ও বরগুনা এই পাঁচটি জেলার ১৭টি উপজেলায় প্রায় দুইশ’টি ইউনিয়নে সুন্দরবন অবস্থিত হলেও বেশি অংশ রয়েছে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলাতে।

তবে নাম নিয়ে যত মতভেদ থাকুক না কেন আমাদের সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জোয়ার ভাটা দ্বারা প্রভাবিত ব-দ্বীপ যেখানে লবণাক্ত বা ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের আধিক্য।

বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ৪.২ শতাংশ এবং সমগ্র বনভূমির প্রায় ৪৪ শতাংশের এ বনে প্রাকৃতিক সম্পদের কি নেই? গাছ, মাছ, বহুজাতির প্রাণী, মধু, কাকড়া, ঝিনুক, চিংড়ি, গোলপাতা, পাখি, সাপ, নদ-নদীসহ অমূল্য সম্পদের আধার এই সুন্দরবন।

সুন্দরবনে মোট দুইশ’ ৪৫টি পরিবারের তিনশ’ ৩৪টি প্রজাতির বড় বৃক্ষ, গুল্ম-লতা ও পরজীবী উদ্ভিদ পাওয়া যায়। মাছ পাওয়া যায় ২৭টি পরিবারের ৫৩টি প্রজাতির (সমুদ্রচর) ও ৪৯টি পরিবারের দুইশ’ ২৪ প্রজাতির (তলদেশ বিহারী)। চিংড়ি পাওয়া যায় ৫ পরিবারের ২৪ প্রজাতির।

সুন্দরবনের প্রায় ৩৫ ভাগ জলাভূমি, যার ১ লাখ ৭৫ হাজার ছয়শ’ ৮৫ হেক্টর এলাকায় ছোট বড় চারশ’ ৫০টি নদী ও খাল রয়েছে।

শুধু এ পর্যন্তই নয়, মধু, গোলপাতা ছাড়াও এ বনে রয়েছে তেল ও গ্যাস। বাংলাদেশের পেট্রোবাংলা পেট্রোলিয়ামজাত তেল-গ্যাস কার্যক্রমকে ২৩টি ব্লকে ভাগ করেছে। যার মধ্যে সুন্দরবন  ৫ ও ৭ নং ব্লকের অন্তর্গত।

এ বনে বন্যপ্রাণী রয়েছে চারশ’ ২৫ প্রজাতির, যার মধ্যে তিনশ’ ১৪ প্রজাতির পাখি, ১৪ প্রজাতির কাছিম, ৯ প্রজাতির অজগর, কালকেউটে, বোড়া, গোসাপসহ ৩০ প্রজাতির সাপ ও কুমির, ৫৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী।

সব কিছুর মধ্যে এখানের অন্যতম প্রাণী হচ্ছে পৃথিবীর বিরল প্রজাতির রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ১৯৮৫ সালের জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা চারশ’ ৫০টি। ১৯৯৩ সালের গণনা অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা তিনশ’ ৫০ থেকে চারশ’ ৫০টি। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের জরিপ অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা তিনশ’ ৬৯টি এবং সর্বশেষ ২০০৪ সালে সুন্দরবনের বাঘ শুমারী ফলাফল পুরুষ বাঘ একশ’ ২১টি, স্ত্রী বাঘ দুইশ’ ৯৮টি ও ২১টি বাচ্চাসহ সব মিলিয়ে চারশ’ ৪০টি।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।