ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

সাদা মাটির দেশে...

শাকুর আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৪ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১৪
সাদা মাটির দেশে...

বৃহস্পতিবার, অফিস শেষ করে বের হয়েই দৌঁড়... বাসায় গিয়ে গোসল, খাওয়া, সামনে যা পেলাম ব্যাগের ভেতর ঢুকালাম। জরুরি জিনিস, ক্যামেরা, মোবাইল আর চার্জার... আর কিছু না নিলেও চালিয়ে দেওয়া যাবে।

ট্রেনের টিকেট আগেই কাটা ছিল। এখন শুধু কমলাপুর গিয়ে ট্রেনে উঠে বসলেই হয়।
এবার গন্তব্য নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি।

আমার সঙ্গী ছিলেন আরও চার জন। তারেক, অলি, প্রভাত আর মুকিত। সবাই স্কুল ফ্রেন্ড, বাচ্চাকাল থেকে একসঙ্গেই ঘোরাঘুরি। এখনো সুযোগ পেলেই বের হয়ে যাই অজানার উদ্দেশ্যে।

‘হাওর এক্সপ্রেস’ ঢাকা থেকে রাত ১১টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে ময়মনসিংহ জংশনে পৌঁছলো ৪টার দিকে। তখনো নিকষ অন্ধকার, ঠাণ্ডার রাতে অপরিচিত জংশনে ঘুরে ফিরে, নাস্তা করে আবার ট্রেনে উঠে পড়লাম, গন্তব্য দুর্গাপুর জেলার জারিয়া।

লোকাল ট্রেন, ১৮ টাকার টিকেটে মোটামুটি ২ ঘণ্টার পথ পারি দিয়ে জারিয়া স্টেশনে নেমেই সিএনজি, ৩০ টাকা জন প্রতি ভাড়া। ২০ মিনিটেই দুর্গাপুর বাজার। সিএনজি তে বসেই খোঁজ খবর নেওয়া হয়ে গেল কোথায় উঠবো। সরকারি একটা ডাকবাংলো আছে, বাজারের কাছেই।

ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার গোল-গাল সাইজের মানুষ, ডাকবাংলো দেখাশোনা করে আর বাংলোর সামনে চায়ের টং-দোকান চালান। হোটেলগুলোর তুলনায় বাংলোর পরিবেশ ভালো, আর অভিজাত অভিজাত একটা ভাব!  ভাড়াও হোটেলের সমান, প্রতি রুম দিনপ্রতি ৬০০ টাকা।

রুমে ঢুকে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে ঘণ্টা খানেক বিশ্রাম, তারপরই আবার ছুট। দুইটা মোটর সাইকেলে পাঁচ জন চড়ে বসলাম। কিছু দূর গিয়েই বুঝলাম, এই রাস্তায় মোটর সাইকেল ছাড়া আর কোনো বাহন সম্ভব না, রাস্তা খুবই খারাপ।

মাঝে সোমেশ্বর নদী পাড় হলাম ট্রলারে করে। এখন নদীতে হাঁটু পানি, তাও আবার  পরিষ্কার। নিচের বালু দেখা যায়। নদীর পাড়ে অনেক লোকের আনাগোনা। নদী থেকে ট্রাক ভরে ভরে বালু তোলা হচ্ছে।

নদী পাড় হয়ে যে রাস্তা ধরলাম তার অবস্থা আরও কাহিল! বাইকের পেছনে বসে থাকাই কষ্ট। অবশ্য রাস্তার কাজ চলছে, কিছু দিন পর হয়ত আরামে যাওয়া যাবে। বাইক চালক-কাঞ্চন ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে আর ঝাঁকি খেতে খেতে সাধু জোসেফের আশ্রমে পৌঁছলাম।

অসম্ভব সুন্দর জায়গা, সাজানো-গোছানো! পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রম, পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সোমেশ্বর নদী। নদীর ওপাড়ে আর একটা পাহাড়, ওই পাহাড় আর উপরে কাঁটাতার দেওয়া, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত!

বের হয়ে আবার কিছুক্ষণ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে নিয়ে গেল কমলা বাগান দেখাতে, দুঃখজনক হলেও সত্য একটা কমলাও খুঁজে পেলাম না, ফাঁকা বাগান! ওখান থেকে বিজয়পুর বিডিআর ক্যাম্প কাছেই, পাহারের চূড়ায় কয়েকটা ছাওনি দেওয়া, পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সোমেশ্বর নদী, এখান থেকে ভারত সীমান্ত আরও কাছে।

চূড়ায় এক বয়স্ক লোক ঝালমুড়ি আর আচার বিক্রি করছে। এতক্ষণ ঘুরে ফিরে আর পাহাড়ে উঠতে উঠতে গলা শুকিয়ে কাঠ, চালতার আচার খেতে খেতে চাচা মিয়াঁর সাথে কথা বলে জেনে নিলাম আর কোথায় যাওয়া যায়। বললেন, সাদা পাহাড়ে। তার বাড়িও সাদা পাহাড়ের কাছে। ঐ পাহাড় নাকি অসম্ভব সুন্দর। তাড়াতাড়ি নেমে পরলাম, সাদা পাহাড় যেতে হবে। আবার ঝাঁকি!

ও... আসল কথাই বলা হয়নি, পথে এক জায়গায় বাইক এর টায়ার গেলো পাংচার হয়ে! আমাদের অলি! দৈত্য বন্ধু! ওর ওজন সব সময় ৮০ কেজির আশপাশে থাকে! আর একজন প্রভাত... তার অতটা না হলেও ওজনের দিক দিয়ে রানার্সআপ!

ওদের দুই জনকে এক বাইকে দিয়ে, আমরা বাকি তিন জন এক বাইকে ছিলাম। কিন্তু বেচারা বাইক, এত ভার নিতে পারলো না! ওদের বাইকের পেছনের চাকা পাংচার! আমাদের রাস্তার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে গেলো চাকায় হাওয়া দিতে।

গেল তো গেলই, এক ঘণ্টা দাঁড়িয়েই আছি! কিচ্ছু করার নাই! তাদের এলাকা, যা বলবে তাই শুনতে হবে! দাঁড়িয়ে না থেকে পাশেই একটা মেলা হচ্ছিল, রাণী খং মেলা, উপজাতিদের। ঘুরে ফিরে আসলাম।
 
সাদা পাহাড় এলাকায় ঢুকেই বুঝতে পারলাম মানুষ বিরিশিরি কেন আসে। শুধু নাম-ই সাদা পাহাড় না, সত্যি সত্যি সাদা মাটির পাহাড়। কয়েকটা পাহাড় পাশাপাশি, সামনে একটা লেক। লেকের পানি আশ্চর্য রকম নীল। চীনা মাটির পাহাড়, পাহাড় কেটে কেটে চীনা মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে।

সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে উঠলাম পাঁচ জন, ওপর থেকে দেখে তো আরও টাসকি (অবাক)! যতদূর চোখ যায়, ধান খেত, বাঁশঝার, জঙ্গল, চারদিকে সবুজ আর সবুজ। মাঝখানে উঁচু উঁচু সাদা পাহাড়, পাহাড়ের পাশে নীল রঙের লেকের জল বয়ে যাচ্ছে। আর সবচেয়ে ভালো লাগেছে আকাশটা, মনে হচ্ছিল আমাদের জন্যই গাড় নীল রঙ করা হয়েছে আকাশে। পরিষ্কার নীল রঙ, মাঝে ছোপ ছোপ সাদা সাদা মেঘ ভাসছে। এত রঙ এর ছোঁয়া চারদিকে, চোখ ভরে যাচ্ছে।

বান্দরবান, রাঙামাটি, সিলেটে ঘুরে ফিরে অনেক পাহাড় দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, ওইগুলো আরও বড় বড় পাহাড়, অন্য রকম সুন্দর। কিন্তু এমন কালারফুল পাহাড় দেখিনি কোথাও। ছবি তুলতে তুলতে ক্যামেরার চার্জ শেষ করে ফেললাম!

পাহাড় চূড়া থেকে একটু দূরে আর একটা ছোট পাহাড় দেখতে পেলাম, ওখানে যেতে হবে! পাহাড় বেয়ে নেমে আবার দৌঁড়... এখানে পরিবেশটা কেমন জানি, মায়াবী!!! আমাদের মতো বান্দর মার্কা পোলাপানও চুপ হয়ে গেল।

দু’টি পাহাড়ের মাঝখানে নীল জলের লেক। একটা পাহাড় এ উঠে পাঁচজন বসে পড়লাম, সবাই চুপ... শুধু পাখির কিচির-মিচির শোনা যাচ্ছে। একটু শব্দ হলেও প্রতিধ্বনি হচ্ছে। ১৫ মিনিটের বেশি কারও কোনো কথা নেই, মনে হচ্ছে থেকে এখানেই থেকে যাই!!!

বাইক ওয়ালাদের চেচামেচি শুনে অগত্যা উঠে পড়তে হলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়েই বুঝলাম আসলেই দেরি হয়ে গেছে, একটু পরই সন্ধ্যা নামবে।   ফিরতি পথ ধরলাম।

২৪ ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে দৌঁড়ের ওপর আছি, তারপরও সবাই খুব খুশি। এত কষ্ট করে এত দূর আসা সার্থক মনে হচ্ছে। বাংলোতে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আবার বের হওয়ার কথা, রেস্ট নিতে গিয়ে সবগুলা মরার মতো ঘুম...

উঠে দেখি রুমের দরজা খোলা! রাত ৯টা বেজে গেছে! বের হলাম আশপাশে ঘুরে দেখতে, রিকশা নিয়ে বিরিশিরি বাজার, দুর্গাপুর বাজার ঘুরে খাসির মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে রুম এ আসলাম।

গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দুঃসংবাদটা পেলাম। কাল ওই এলাকার এমপি আসবেন, উনি এই বাংলোতেই উঠবে। আমদের রুম ছেড়ে দিতে হবে ১০টার মধ্যে! সকালে সোমেশ্বর নদীতে গোসল করতে যাওয়ার প্ল্যান ছিল, এখন এই ব্যাগ-বস্তা নিয়ে ক্যামনে কি !!

কি আর করা, শনিবার সকালে উঠে বের হয়ে পড়লাম। নাস্তা করে ট্রাক খুঁজতে লাগলাম, ট্রাকের পেছনে উঠে ময়মনসিংহ গিয়ে ওখান থেকে ট্রেনে করে ঢাকা যাওয়ার ইচ্ছা। ট্রাক অনেক, কিন্তু সব বালু ভর্তি। সোমেশ্বর নদী থেকে তোলা।

কি আর করা, একটা নসিমন রিসার্ভ নিয়ে ভটভট ভটভট শব্দ শুনতে শুনতে জারিয়া স্টেশন পৌঁছলাম। এখানে এসে তো আরও ভয়ানক অবস্থা। কয়েকশ’ মানুষ ট্রেনের অপেক্ষায়। টিকেট কাটার সাহস করলাম না, দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলাম।

২ ঘণ্টা লেট করে ট্রেনটা আসলো, কিন্তু আফসোস... আমরা পাঁচটা যুবক ছেলে ট্রেন থাকা সত্ত্বেও উঠতে পারলাম না। ট্রেনের সিঁড়িতেও নারীরা বসে আছে। আর ভিতরে তো যুদ্ধ! মুরগি, হাঁস, ছাগল, বস্তা সব নিয়ে তেলে-গোবরে অবস্থা।

ট্রেনের ছাদে ওঠার সাহসী সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলেছিলাম, কিন্তু দেখতে দেখতে ট্রেনের ছাদও ভরে গেল! উপায় না দেখে ট্রেনটা স্টেশন ছাড়ার আগেই আমরা স্টেশন থেকে বের হয়ে বাস খুঁজতে লাগলাম। বাসে করে ময়মনসিংহ এসে আন্তঃনগর ‘অগ্নিবীণা’ এক্সপ্রেসে চরে বসলাম।

রোববার থেকে সবার অফিস খোলা, দু’দিনের ছোট্ট একটা ট্যুর দিয়ে ফিরে যাচ্ছি সেই রুটিন বাঁধা জীবনে। কাল থেকেই আবার সেই প্যাঁ পোঁ মার্কা ঢাকা শহর... সেই অফিস, খাওয়া, ঘুম, আবার অফিস, আবার খাওয়া, আবার ঘুম,... আবার কাজ... আবার...

আমাদের জীবনে এমনিতেই সময় পাই খুব কম, সেই জীবনটা ‘জীবনযাপন’ করতে করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে, জীবন উপভোগ করার সুযোগ পাই না বললেই চলে। আমি তো তারপরও ব্যাগ রেডি করেই রাখি, শুধু চান্স পেলেই হয়.. দে ছুট...

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে। আর ‘ট্রাভেলার্স নোটবুক’র সেরা লেখকের জন্য তো থাকছেই বিশেষ আকর্ষণ..

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।

আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়।


বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।