ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

বান্দরবান থেকে সেন্টমার্টিন: হারিয়ে যাওয়ার ৭ দিন

মো. আশরাফুল আলম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৪
বান্দরবান থেকে সেন্টমার্টিন: হারিয়ে যাওয়ার ৭ দিন ছবি:লেখক

‘মন চায় মন চায়, যেখানে চোখ যায়, সেখানে যাবো হারিয়ে’ হুমায়ূন আহমেদের দারুচিনি দ্বীপ সিনেমার গানের মতো করেই পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকতে ৭টি দিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি অনুষদের শেষবর্ষের শিক্ষার্থীরা। একাডেমিকের অংশ হিসেবে গত ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখ রাতে ৭ দিনের উদ্দেশ্যে বাকৃবির হ্যালিপ্যাড থেকে রওনা দেন তারা।

প্রায় ২৩০ জন শিক্ষার্থীকে ৬ ভাগে ভাগ করে পরিচালনা করা হয় শিক্ষা সফর-২০১৪। বাকৃবিতে ভর্তি হওয়ার পর ক্লাস-পরীক্ষার চাপে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সময়ই পাওয়া যায় না। তাই শিক্ষা সফরের দিনগুলি শিক্ষার্থীদের কাছে ভীষণ আনন্দের।

বাকৃবির প্রতিটি অনুষদের শিক্ষার্থীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে শিক্ষা সফরের ওই ৭টি দিনের জন্য। আর তাই ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই সবার মধ্যে একটা উত্তেজনা কাজ করে। শেষ বর্ষের ৩টি সেকশনকে মোট ৬টি গ্রুপে ভাগ করে দিয়ে শিক্ষা সফরের আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আর প্রতিটি গ্রুপের জন্য গাইড হিসেবে নির্বাচন করা হয় দু’জন শিক্ষককে। তারাই মূলত সফরের দিক নির্দেশনা প্রদানকারীর দায়িত্ব পালন করেন। তাদের সহায়তা করার জন্য দু’জন ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়। ৬টি গ্রুপের মধ্যে আমরা ছিলাম ৫ নম্বর গ্রুপ। আমাদের সাথে সফরের দিক নির্দেশনা প্রদানকারীর দায়িত্ব পালন করেন উদ্ভিদরোগতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শাহজাহান মঞ্জিল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাহাদত হোসেন সুমন। আর ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন আশরাফুল ও অজিহুল্লা।

সপ্তাহ জুড়ে চলে সফরের প্রস্তুতি। বাস ভাড়া করা থেকে শুরু করে সকল কাজকর্ম শেষ হয়ে যায় সময়মতো। এরপর অপেক্ষার প্রহর গণনা শুরু। হঠাৎ করেই চলে আসে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকেই শুরু হয় বাস যাত্রা। একের পর এক বাস ছেড়ে যেতে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমাদের বাস ছাড়ে রাত ৮টায়।

কুমিল্লা রোড হয়ে আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করে দ্রুত গতিতে আর আমাদের আনন্দও চলে সমান তালে। সারারাত চলার পর সকাল ৮টায় আমাদের গাড়ি পৌঁছায় চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। সেখানে সকালের খাওয়া শেষ করে আবার যাত্রা শুরু করি, সাড়ে ১০টায় আমরা বান্দরবন পৌঁছাই। সেখানে মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ শেষে আমরা ফিরে যাই বান্দরবন হার্টিকালচার সেন্টারে। সেখান থেকে বিকেলে স্বর্ণমন্দির ও পরের দিন নীলগিরি, নীলাচল ও চিম্বুক পাহাড় ঘুরে বিকেলেই রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে রওনা দেই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে রাত্রিযাপন করে সকালে কাপ্তাই লেকের উদ্দেশ্যে রওনা হই। কাপ্তাই লেকের উপর দিয়ে আমরা শুভলং এর ঝর্না দেখে বিকেলে আবার রওনা দেই কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। রাত প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে আমরা পৌঁছাই কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। রাতেই সব বন্ধুরা মিলে চলে যাই পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে।

সকল যাত্রার ক্লান্তি যেনো নিমিষেই দূর হয়ে গেলো সমুদ্রের কাছে গিয়ে। রাত ৩টার দিকে সবাই আবার নিজেদের রুমে ফিরে ঘুমিয়ে নেই। সকালে উঠেই সবাই আবার দৌড় জমায় সমুদ্র সৈকতে। সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে নিজেদের শরীর ভিজিয়ে মনে হলো জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সবাই মিলে একসাথে পানিতে নামার যে কি মজা তা ওই দিন উপভোগ করলাম। লাবণী পয়েন্টে প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টা আনন্দ করার পর আমরা যার যার মতো করে রুমে ফিরে আসি।

দুপুরের খাওয়া শেষ করে আবার পাড়ি জমাই কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ইনানী বিচে। এর বিশেষত্ব হচ্ছে এই বিচে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের বুকে সূর্যের আত্মসমর্পণ খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করা যায়।

সৈকত থেকে সন্ধ্যায় সবাই মিলে চলে যাই বার্মিজ মার্কেটে। সেখানে সবাই মিলে কেনাকাটা শেষে রাতে ফিরে আসি। রাতের খাবারের পর থেকে রাত ২টা পর্যন্ত আবার আড্ডা চলে সমুদ্র সৈকতে। এভাবেই কেটে যায় কক্সবাজারের দিনগুলো। রাতে মাত্র ২ ঘণ্টা ঘুমিয়ে সকাল ৬টায় রওনা দেই টেকনাফের উদ্দেশ্যে। গন্তব্যস্থল আকাঙ্ক্ষিত সেন্টমার্টিন দ্বীপ।  

সোমবার সকাল ৯টায় আমাদের জাহাজ টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে বঙ্গোপসাগরে পাড়ি জমাই আমরা। প্রচণ্ড রোদে আমরা যখন প্রায় অস্থির ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের মনকে প্রশান্তি প্রদান করে বাংলাদেশ ও মায়ানমারকে বিভক্তকারী নাফ নদী। দুই রঙয়ের পানির ফলে স্বচক্ষেই ধরা পড়ে সাগরের বুকে একমাত্র নদীর মোহনা। আর এর প্রধান আকর্ষণ গাঙচিল।

বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আমরা পৌঁছাই আমাদের সেই আকাঙ্ক্ষিত সেন্টমার্টিন দ্বীপে। মনোমুগ্ধকর ও মনোরম পরিবেশের জন্য এক নিমিষেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেন্টমার্টিন্স। অসাধারণ এক পরিবেশে নিজেদের আবিষ্কার করতে পেরে সবাই আনন্দে মেতে ওঠে। দুপুরের খাবারটা কোনো মতে শেষ করেই পাড়ি জমাই এখানকার সৈকতে। এক সেকেন্ড সময়ও নষ্ট করা যাবে না। আর তাই কোনো সময় নষ্ট না করেই নেমে পড়ি সমুদ্রের পানিতে।

সেন্টমার্টিনে এসে আমরা ছিলাম হোটেল অবকাশে যা প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট সমুদ্র বিলাশের খুব কাছে। সন্ধ্যায় সবাই মিলে চলে গেলাম মার্কেটে। ঘুরতে এসেছি বলে কি মার্কেট করবো না, তাই কি হয় নাকি। সেন্টমার্টিনে এলাম আর তার যদি কোনো প্রমাণই না থাকে তাহলে তো আর মনকে শান্তি দেওয়া যায় না। তাই সবাই কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বার্মিজ আচার, চকলেট, প্রসাধনী থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের শুটকি কোনটাই বাদ পড়েনি পছন্দের তালিকা থেকে।

শুধু নিজের জন্য নয়, হলের বড় ভাইদের জন্য, ছোট ভাইদের খুশি করার জন্যও চলে কেনাকাটা। রাতে আমরা বার-বি-কিউ পার্টিরও আয়োজন করি। শুধু তাই নয়, সামুদ্রিক মাছ যেমন রূপচাঁদা, লৈইট্টা, কোরাল ইত্যাদিসহ কাকড়ার ফ্রাইয়ের স্বাদ উপভোগ করি।

রাতে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে হোটেল কর্তৃপক্ষ। অনেক সুন্দর একটি দিন পার করার পর ক্লান্ত দেহে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম যার যার রুমে। আমাদের সেন্টমার্টিন ট্যুরের গাইড হিসেবে ছিলেন মশিউজ্জামান ভাই। আমাদের সকাল ৬টার মধ্যে ঘুম থেকে ওঠার কড়া নির্দেশ দিয়ে তিনিও ঘুমাতে চলে যান। কিন্তু আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রায় সারারাতই কাটাই সমুদ্র সৈকতে।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই নাস্তা সেরে দৌড় দেই সবাই। উদ্দেশ্য সেন্টমার্টিনের সবচেয়ে সেরা আকর্ষণ ছেঁড়াদ্বীপ। সময় আর ইচ্ছা পূরণের জন্য ট্রলারে না গিয়ে আমরা ভাড়া করি স্পিড বোর্ড। আর মাত্র ১৫ মিনিটেই পৌঁছে যাই ছেঁড়া দ্বীপে।

প্রবালের মাঝে প্রায় ঘণ্টা ২ এর জন্য হারিয়ে যাই আমরা সবাই। সেখানে গিয়েই গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে শুরু হয়ে যায় ফটোসেশন। এর আগে বড়দের মুখে ছেঁড়া দ্বীপের অনেক নাম শুনেছি। কিন্তু আজ আমি নিজেই সেখানে দাঁড়িয়ে। ভাবতেই কেমন যেনো বিজয়ের হাসি এসে গেলো আমার মুখে। ছেঁড়া দ্বীপে গেলাম আর ডাব খাওয়া হবে না, এমনটা হতেই পারে না। সবাই মিলে একসাথে ডাব খাওয়া শুরু করি। সেখানে যেনো ডাবের পানি খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছিল।

সব কিছু উপভোগ শেষে আমরা আবার রওনা হলাম হোটেলের উদ্দেশে। হোটেলে পৌঁছেই সুমন স্যারের নেতৃত্বে নেমে পড়ি সমুদ্রে। প্রায় ২ ঘণ্টা পানিতে আনন্দ করার পর আমরা আবার হোটেলে ফিরে আসি। দুপুরের খাওয়ার পর আমরা আবার কক্সবাজারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। ফিরে আসার সময়টা ছিল আরও বেশি আনন্দদায়ক। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে জাহাজও দুলতে থাকে। আর সেই সাথে ভয়ে আর আনন্দে আমাদের মনও দুলতে থাকে। এভাবে দুলতে দুলতে আমরা টেকনাফে চলে আসি। সেখান থেকে আমরা টেকনাফ ঘুরে আবারও চলে যাই কক্সবাজারের গ্র্যান্ড বিচ রিসোর্টে। রাতটা কাটিয়ে বুধবার সকাল ৬ টায় রওনা দেই আমাদের চিরচেনা প্রিয় ক্যাম্পাসের উদ্দেশে।

৭ দিন অনেক আনন্দ করার পরও ফিরে আসার সময় কেনো যেনো মনটাকে মানাতে পারলাম না। মনের ভেতরে কেমন যেনো একটা হারানোর ব্যথা অনুভূত হতে লাগল। ৭ দিনে অনেক আপন করে নিয়েছিলাম আমরা ভ্রমণের জায়গাগুলোকে। কিন্তু আনন্দের কথা হলো- বন্ধুদের নিয়ে একসাথে শিক্ষা সফরে যাওয়াটা আসলেই কোনদিন ভোলার নয়।

বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।