ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

চাকচিক্য নেই, তবুও স্বগৌরবে নবরত্ম মন্দির...

রেজাউল করিম নোমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৯ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০১৪
চাকচিক্য নেই, তবুও স্বগৌরবে নবরত্ম মন্দির... সংগৃহীত

সিরাজগঞ্জ শহরে কয়েক বার আস‍া হলেও হাটিকুমরুল আসা হয়নি। পাবনা জেলার ইতিহাস পড়ে প্রথম খোঁজ পেয়েছিলাম এই মন্দিরের।

জনৈক রামনাথ ভাদুড়ী মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর আমলে (১৭০৪ থেকে ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দ) কারুকার্যমণ্ডিত তিন তলা নবরত্ন মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।

যমুনা নদী পার হতেই ম্যাপ যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল। বাস থেকে নামলাম কড্ডার মোড়ে। ডানদিকের পথটা চলে গেছে সিরাজগঞ্জ শহরে। সেখান থেকে যেতে হবে অন্য বাসে। একটা লোকাল বাসে চড়ে বসলাম। এখানে লোকাল বাসের ধারণা কিছুটা আলাদা। মাত্র ৫/৬ কিলোমিটার পথ। পথটুকু যেতে কেটে গেল প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। সেই বাস জার্নি সত্যিই মনে রাখার মতো।



বাস থেকে নেমেই পাওয়া গেল চৌরাস্তা মোড়। বামদিকে পাবনা আরিচা, ডান দিকে বগুড়া হয়ে উত্তরে আর সোজা বনপাড়া হয়ে চলে গেছে রাজশাহী। রাস্তার পাশেই  একটি ড্রিংকসের পাইকারী দোকান। মাঝ বয়সী একটি লোক হিসেব কষছিলেন। তার কাছে জানতে চাইলাম হাটিকুমরুল মন্দির কোন পথে? হাটিকুমরুল কি পেছনে ফেলে এসেছি? বাস থেকে এই জমির মালিক টাইপের একটা সাইনবোর্ডে হাটিকুমরুল লেখা দেখেই এই প্রশ্ন।

লোকটা বলল, না। তারপর বলল, কই যাইবেন? বললাম, মন্দির। হাটিকুমরুল মন্দির।

ভদ্রলোকের দেখানো পথে ডানে বগুড়ার দিকে রওনা দিলাম।

রিকশাওয়ালাকে হাটিকুমরুল মন্দিরে যাওয়ার কথা বললে নাও চিনতে পারে। কারণ স্থানীয়দের কাছে ভাদুরী জমিদারের মন্দির আবার দোলমঞ্চ নামেও পরিচিত এটি। মোড় থেকে হাটিকুমরুল মন্দিরে যাওয়ার জন্য রিকশার খোঁজ করতেই একটা ছেলে কাছে এসে বলল হাটিকুমরুল মন্দির এরা চেনে। মাত্র ২০ টাকা ভাড়া। ওই গ্রামেই আমার বাড়ি

উঠে বসলাম রিকশায়। সামান্য এগুতেই মূল রাস্তা থেকে ডানে নেমে ঢালু মাটির রাস্তা। রাস্তার দুপাশেই গ্রাম। মাঠজুড়ে আলু। মাঝে মাঝে ধানক্ষেত। পথের ডান পাশে পরপর কয়েকটা পুকুর।


রিকশাওয়াল‍া ছেলের কাছে জানতে চাইলাম মন্দির বিষয়ে। মন্দিরটি জমিদাররা বানিয়েছে এর চেয়ে বেশি কিছু তারা জানে না।

মিনিট দশেক পথ পেরুতেই ডান পাশে চোখে পড়ল ছোট একটা দোচালা ছোট মন্দির। মন্দিরের দেয়ালে মুঘল আমলের ছোঁয়া। দেখতে গেলাকারমতো হলেও আসলে অষ্টকোণাকৃতি। গম্বুজও তাই, শীর্ষভাগ ধীরে ধীরে সরু হয়ে উপরে উঠে গেছে গম্বুজের। মন্দিরের ভেতরে শিবলিঙ্গ থাকায় লোকমুখে শিবমন্দির হিসেবেই পরিচিত মন্দিরটি। শিব মন্দিরের আট গজ দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় মূল মন্দির।



শিব মন্দিরের কিছুদূর পরেই দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মূল মন্দির। যেটা দেখতেই অতদূর ছুটে যাওয়া। ধারণা ছিল এটি মোটমুটি আকৃতির পুরোনো কোনো মন্দির হবে হয়ত। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবেই কেবল দেখতে যাওয়া। খুব বেশি আশাও করিনি।
মন্দির নিয়ে নানা কল্পনা করে গেলেও মুগ্ধ হলাম মন্দিরের পরিচ্ছন্নতা দেখে। দিনাজপুর জেলার কান্তজীর মন্দিরের কাছাকাছি দেখতে তিন তলা এ মন্দিরটি।

হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির। পোড়ামাটির ফলক সমৃদ্ধ নয়টি চূড়া থাকায় এটিকে নবরত্ন মন্দির বলা হয়। পাশেই রয়েছে দোচালা ছনের ঘরের আদলে নাট মন্দির। স্থানীয় লোকজনের ভাষায় বাংলা মন্দির আর নবরত্ন মন্দিরের ঠিক পেছনে রয়েছে আরেকটি শিব মঠ।

দুই ফুট বেদীর ওপর নির্মিত মন্দিরের দেয়াল এক সময় পোড়ামাটির ফলকে সাজানো ছিলো, তা এখনও বোঝা যায়।



কালের বিবর্তন, অবহেলা আর সংস্কারের অভাবে মন্দিরের ওপরের রত্ন বা চূড়াগুলো অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। তবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মন্দিরটি নতুন করে সংস্কার করে। মন্দিরের নীচতলায় রয়েছে দু’টি বারান্দা বেষ্টিত একটি গর্ভগৃহ। বারান্দার বাইরের দিকে সাতটি এবং ভিতরের দিকে রয়েছে পাঁচটি প্রবেশ পথ।

নবরত্ন মন্দিরের বাইরে পূজার আয়োজন করা হলেও স্থানীয় লোকজনের কোনো পুরুষের স্মৃতি থেকেই মন্দিরের ভেতরে পূজার কথা জানা যায়নি। সরকারের পক্ষ থেকে নবরত্ন মন্দিরে পূজা আয়োজনের প্রস্তাব দেওয়া হলেও সম্মতি দেয়নি হিন্দু পরিবারগুলো। প্রথমত প্রজা হিসেবে জমিদারের সম্পত্তি ব্যবহার ন্যায়সঙ্গত মনে করেনি তারা। অন্যদিকে পূজা চালিয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্যও নেই পরিবারগুলোর।



এলাকার দুই-তিন মাইল জুড়ে ২০/২৫ ফুট মাটি খুঁড়লে পুরনো লম্বা প্রাচীর বেরিয়ে আসে তাই স্থানীয় লোকজন বিশ্বাস করে অনেক আগে জমিদার বাড়ি মাটির নিচে হারিয়ে গেছে। তবে মন্দির জমিদার বাড়ির চেয়ে উঁচু ছিল কিংবা দৈববলে মন্দির মাটির নিচে হারিয়ে যায়নি।

মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে যে ধারণাটি সবচেয়ে যৌক্তিক তা হলো মথুরার রাজা প্রাণনাথের অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন জমিদার রামনাথ ভাদুরী। প্রাণনাথ দিনাজপুরের কান্তনগরে ঐতিহাসিক কান্তজীর মন্দির নির্মাণে বিপুল অর্থ ব্যয় কর‍ার পরে তার অর্থ সংকট দেখা দেয়। তিনি বাৎসরিক রাজস্ব পরিশোধ করতেও ব্যর্থ হন। কান্তজীর মন্দিরের আদলে হাটিকুমরুলে একটি মন্দির নির্মাণের শর্তে নিজ কোষাগার থেকে টাকা দিয়ে বন্ধুর বকেয়া পরিশোধ করে দেন তিনি।



ভিন্ন মতে, রাখাল জমিদার নামে পরিচিত রামনাথ ভাদুরী তার জমিদারি আয়ের সঞ্চিত কোষাগারের অর্থ দিয়েই এ মন্দির নির্মাণ করেন এবং সেসময় থেকেই ধুমধামে এ চারটি মন্দিরেই পূজা অর্চনা করা হতো। কালের বিবর্তনে ভারতীয় উপমহাদেশে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি, দেশ বিভাগ ও নানা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে অরক্ষিত নবরত্নের মূল্যবান প্রাচীন সামগ্রী লুট করে দেশি-বিদেশি দুর্বৃত্তরা। স্বাধীনতার পর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ পর্যায়ক্রমে বের করে নিয়ে আসে এর প্রাচীন সৌন্দর্য। যা আজও দাঁড়িয়ে আছে স্বগৌরবে।

  
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়।


বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, মে ১৬ , ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।