দিনাজপুর থেকে : দিনাজপুর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধান-চাল পরিবহনের ক্ষেত্রে চাদাঁবাজি, লুট ও ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনা এখন নিত্যনৈমেত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধান-চাল পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের এসব সামাল দিতেই মাসে নিম্নে ২২ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়।
পাশাপাশি পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ট্রাক শ্রমিকদের দুটি সংগঠনের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের কারণে দিনাজপুরের ট্রাক শ্রমিকরা যেমন নিজেরা বিভক্ত, তেমনি একটি সংগঠনের শ্রমিক অন্য সংগঠনের শ্রমিক দ্বারা নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে। বছরখানেক আগে সরকারের ট্রেড ইউনিয়ন নীতিমালার আওতায় একটি শ্রমিক সংগঠন মামলা করলে দ্বন্দ্ব আরও প্রকাশ্য রূপ নেয়।
দিনাজপুরের দুটি সংগঠনের একটি হচ্ছে দিনাজপুর ট্রাক ও ট্যাংক লরি শ্রমিক ইউনিয়ন। ১৯৭৯ সালে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যটি হচ্ছে বাংলাদেশ ট্রাক বন্দোবস্তকারী শ্রমিক ইউনিয়ন। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালে।
দিনাজপুর থেকে যেসব স্থানে চাল পরিবহন হয়:
নব্বইয়ের দশকেও দিনাজপুর থেকে মূলত রাজধানীতে চাল পরিবহন করা হত। এর সেসব চাল ঢাকা থেকে দেশের অন্যান্য স্থানে পাঠানো হতো। আর ধান যেতো নওগাঁ, জয়পুরহাট, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নোয়াখালিতেই বেশি।
কিন্তু চাল পরিবহনের সেই চিত্র কিছুটা পাল্টে গেছে। বর্তমানে দিনাজপুর থেকে সবচেয়ে বেশি চাল পাঠানো হয় দেশের উপকূলীয় এলাকায়। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নোয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, কুয়াকাটা, ফেনী, কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম।
এসব অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা এখন সরাসরি দিনাজপুর থেকে চাল সংগ্রহ করেন। এরপরই রয়েছে রাজধানী ঢাকা। এছাড়া যশোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহেও দিনাজপুর থেকে ধান ও চাল সরবরাহ করা হয়।
মুল সমস্যা চাদাঁবাজি, ছিনতাই
দিনাজপুর থেকে চাল বা ধান বোঝাই একটি ট্রাক রাজধানীতে আসতে অন্তত ১৫টি স্থানে চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদার পরিমাণ একশ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা। দিনাজপুর ট্রাক ও ট্যাংক লরি শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ ট্রাক বন্দোবস্তকারী শ্রমিক ইউনিয়নের শ্রমিক নেতা, চালক ও মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। এজন্য চাল পরিবহনে তাদের অতিরিক্ত ব্যয় হয় ২৩ থেকে ২৫ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দিনাজপুর থেকে প্রতিদিন গড়ে দেড়শ’ ট্রাক ধান-চাল দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। প্রতিটি ট্রাক রাস্তায় চলাচল করলে বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ৫শ’ টাকা চাদাঁ গুনতে হয়। সে হিসেবে প্রতিদিন দৈনিক চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৫ হাজার টাকা। মাসে শুধু চাঁদার পেছনেই অতিরিক্ত ব্যয় হয় সাড়ে ২২ লাখ টাকা।
দিনাজপুর থেকে রাজধানীতে ধান বা চাল পরিবহনে দিনের বেলায় প্রশাসন বিশেষ করে ট্রাফিক পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। বিষয়টি এখন একেবাইে ‘ওপেন সিক্রেট’ বলে জানালেন ট্রাক চালকরা।
তারা জানান, দিনের বেলায় প্রকাশ্যেই পুলিশের চাঁদাবাজী চলে। এছাড়া জেলায় সরকারি কোনো অনুষ্ঠান হলে হাইওয়েতে ট্রাক থামিয়ে নির্দিষ্ট অংকের চাঁদা আদায় করা হয় বলেও ট্রাক চালকরা জানান।
দিনের বেলায় দিনাজপুর থেকে ধান বা চাল বোঝাই ট্রাক বের হলে প্রথমেই চাদাঁ দিতে হয় দিনাজপুর সদর এলাকায়। চাঁদাবাজীর অন্য স্পটগুলো হচ্ছে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট, ফুলবাড়ী উপজেলার ঢাকার মোড়, শেরপুর, গোবিন্দগঞ্জ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, এলেঙ্গা, কালিয়াকৈর, চান্দুয়া চৌরাস্তা, জয়দেবপুর, বাইপাইল, আশুলিয়া, টঙ্গি ও গাবতলী।
এছাড়াও রাতে দিনাজপুর থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে কোনো মোড়ে যদি কোনো সার্জেন্ট ট্রাক থামনোর সংকেত দিলেই চাঁদা গুনতে হয়।
চাঁদাবাজীর বিষয়ে ট্রাক ও ট্যাংকলরি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজগার আলী বাংলানিউজকে জানান, চাঁদাবাজীর কারনে ধান চাল পরিবহন খরচ বাড়ছে। এসব চাঁদাবাজী করে ট্রাফিক পুলিশ।
তিনি বলেন, দিনাজপুর থেকে বিভিন্ন স্থানে ট্রাক পাঠাতে হলে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। সময়সীমার মধ্যে ট্রাক না পৌঁছালে ট্রাক মালিককে দুই হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হয়। কিন্তু দিনাজপুর থেকে ঢাকা যেতে বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক পুলিশ ইঞ্জিন, টায়ার, গাড়ীর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খারাপসহ বিভিন্ন অজুহাতে চাঁদা দাবি করে। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছানোর জন্য বাধ্য হয়েই ট্রাফিক পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। অন্যথা ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রাক আটকে রাখা হয়।
একইভাবে দিনাজপুরে ঢুকতে হলে ট্রাফিক পুলিশকে লোকাল ট্রাক ৫০ টাকা ও বাইরের ট্রাক একশ’ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় বলেও তিনি জানান।
একই কথা জানালেন বাংলাদেশ ট্রাক বন্দোবস্তকারী শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সুকুমার দাস। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, দিনের বেলায় ট্রাক চালাতে গেলে ঢাকা পর্যন্ত অন্তত ১৫টি স্থানে আমাদের টাকা দিতে হয়। ট্রাফিক পুলিশকে টাকা না দিলে চালকদের মারধর করে। গাড়ি আটকে রাখে।
তিনি জানান, নানা অজুহাতে পুলিশ গাড়ি আটকে রাখে এবং মামলা করে।
পুলিশের এই চাদাঁবাজীর টাকা কার পকেট থেকে দিতে হয় জানতে চাইলে দু’জনই জানান, চাঁদাবাজির টাকা ট্রাক ভাড়ার সঙ্গে নিয়ে নেওয়া হয়।
এতো গেল চাঁদাবাজীর কথা। এছাড়া ধান-চাল বোঝাই ট্রাক ছিনতাইও এখন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো ঘটে মূলত কালিয়াকৈর, সাভার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মোড়, শেরপুর, জয়দেবপুর, কাঞ্চন (ঢাকা বাইপাস), চান্দুরা, গোবিন্দগঞ্জ এলাকায়।
দিনাজপুরের দু’টি সংগঠনের নেতা, চালক ও শ্রমিকরা জানিয়েছেন, ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি ঢাকার আশপাশের এলাকায়। বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ফুট ওভারব্রিজ এলাকা ট্রাক চালকদের কাছে রীতিমত আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ট্রাক চালক আয়নাল জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মোড়ে দু’টি গতিরোধক আছে। এর ঠিক ওপরেই রয়েছে ফুট ওভারব্রিজ। ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে মূলত রাতে। ছিনতাইকারীরা রাতের বেলায় ফুট ওভারব্রিজ বা গতিরোধকের কাছাকাছি ওৎ পেতে থাকে। ট্রাকের গতি কমানো হলে পেছন থেকে ট্রাকে উঠে পড়ে। পরে চালক ও হেলপারকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নির্জন স্থানে নামিয়ে দিয়ে ট্রাক নিয়ে পালিয়ে যায়।
বন্দোবস্ত ইউনিয়ন এবং ট্রাক ও ট্যাংকলরী শ্রমিক ইউনিয়নের দ্বন্দ্ব
পরিবহন ব্যবস্থায় আধিপত্য বিস্তার করা নিয়েই দিনাজপুরের দু’টি শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলছে দ্বন্দ্ব, যা এখন একেবারেই প্রকাশ্যে।
ট্রাক ও ট্যাংকলরী শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা বলছেন বাংলাদেশ ট্রাক বন্দোবস্ত শ্রমিক ইউনিয়নের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। অন্যদিকে, বন্দোবস্তকারী শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা বলছেন, সরকার সমর্থিত ট্রাক ও ট্যাংক লরি শ্রমিক ইউনিয়ন তাদের সংগঠন কর্তৃক পরিচালিত ধান-চাল পরিবহনকারী ট্রাক থেকে চাদাঁ আদায় করছে। চাদাঁ দিতে না চাইলে মারধর করছে, ট্রাক আটকে রাখছে। এছাড়া বন্দোবস্তকারী শ্রমিক ইউনিয়ন বন্ধ করে দেয়ারও হুমকি দিচ্ছে।
দিনাজপুর ট্রাক ও ট্র্যাংকলরি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ও দিনাজপুর জেলা শ্রমিকদের সভাপতি এ বিষয়ে বাংলানিউজের প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে জানান, সরকার ১৯৯৬ সালে ২৭ সেপ্টেম্বর ট্রেড ইউনিয়ন আইন করে। এই আইন ২০০৮ সালে আরও যুগোপযোগী করা হয়েছে। আইনানুযায়ী প্রতিটি জেলা শহরে চারটি শ্রমিক সংগঠন থাকবে। সে হিসেবে দিনাজপুরে ট্রাক ও ট্যাংকলরি শ্রমিক ইউনিয়নই বৈধ।
বৈধতা না থাকলেও ওই সংগঠনের সরকারি নিবন্ধন আছে কিভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরশাদ সরকারের সময় এই সংগঠনের নিবন্ধন দেওয়া হয়। পরে আর তা বাতিল করা হয়নি।
তিনি আরো জানান, স্থানীয় শ্রম আদালতে সংগঠনটির নিবন্ধন বাতিলের জন্য মামলা করা হয়েছে। শিগগিরই মামলায় রায় হবে বলে তিনি জানান।
বন্দোবস্তকারী ইউনিয়নের প্রতিটি ট্রাক থেকে দেড়শ’ টাকা করে চাঁদা নেওয়ার বিষয়ে সভাপতি বলেন, এটি একটি মহলের অপপ্রচার। এই ধরনের অভিয়োগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
বন্দোবস্তকারী শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সুকুমার দাস বলেন, তাদের সঙ্গে রয়েছে দিনাজপুরের অধিকাংশ ট্রাক শ্রমিক। কিন্তু এখন তাদের শান্তিপুর্ণভাবে ইউনিয়ন চালাতে দিচ্ছে না ট্রাক ও ট্র্যাংকলরি ইউনিয়ন। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর দিনাজপুরে ট্রাক পবিহনের চাঁদা নেওয়া শুরু করেছে ট্রাক ও ট্যাংকলরি ইউনিয়নের নেতারা।
তিনি জানান, ট্রাক ও ট্যাংকলরি ইউনিয়নের সভাপতি শ্রমিক লীগেরও সভাপতি। তিনি ও তার লোকজন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দিনাজপুর সদর থেকে বের হওয়ার সকল পথে তাদের সংগঠনের শাখা অফিস স্থাপন করেছে। শাখা অফিসগুলোর মাধ্যমে তাদের সংগঠন ছাড়া অন্য সংগঠনের ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করছে।
তিনি আরও জানান, তারা বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সাংসদ ইকবালুর রহিমের কাছে গিয়েছিলেন। সাংসদ তাদের অভিযোগ শুনে কলেছেন- এভাবেই চলবে দেশ। জোর যার মুল্লুক তার।
দিনাজপুর সদর থেকে বের হওয়ার পথ হাজীর মোড়, ঢাকার মোড়, বিরল, মোহনপুর ব্রীজ, বালুডাঙ্গা বাস স্ট্যান্ড, কলেজ মোড় রাস্তা, শেরশাহ মোড় (মহারাজার মোড়), পুল হাট এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি মোড়ে ট্রাক ও ট্যাংকলরি শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানার টাঙ্গিয়ে সংগঠনের লোকজন প্রতিটি ট্রাক থামিয়ে চাঁদা তুলছে।
সেখানে হাশেম নামে ট্যাংকলরি ইউনিয়নের এক শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে আলাপকালে তিনি জানান, বন্দোবস্তকারী ইউনিয়নের ট্রাক থেকে চাঁদা আদায়ের ব্যাপারে নেতাদের নির্দেশ রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গড়ে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি ট্রাক থেকে চাঁদা তোলা হয়।
দিনাজপুরের চাল পরিবহনের পরিমাণ
দিনাজপুর থেকে প্রতিদিন দেড় শতাধিক ট্রাক ধান ও চাল নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। প্রতিটি ট্রাকের ধারণক্ষমতা ১৪ টন। সে হিসেবে প্রতিদিন দুই হাজার টনের বেশি চাল পরিবহন করা হয়। আর মাসে তা ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময়: ০৮৩৫, ১৮ অক্টোবর, ২০১০।