দেশের সবচেয়ে বেশি ধান-চাল উৎপাদককারী জেলা দিনাজপুর, জয়পুরহাট ও নওগাঁ। সদ্য শেষ হওয়া বোরো মৌসুমে এসব জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন হলেও সরকারের সংগ্রহ অভিযান সফল হচ্ছে না।
সংগ্রহ অভিযানের এই ব্যর্থতার পেছনে এককভাবে মূল্য নির্ধারণকে দায়ী করেছেন তিন জেলার উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও মাঠ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ অটো, মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি কেএম লায়েক আলী জয়পুরহাটে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘সরকারের একগুয়েমির কারণেই ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান সফল হচ্ছে না। ’
তিনি বলেন, ‘শুরুতে সরকার যখন ধান-চালের মূল্য ঘোষণা করে, তখনই আমরা দাম যৌক্তিকভাবে নির্ধারণের জন্য বলেছিলাম। কিন্তু সরকার শোনেনি। ’
লায়েক আলী আরও বলেন, ‘সরকার যখন দাম পুনঃনির্ধারণ করে, তখন মিল মালিকদের কাছে সেই পরিমাণ চাল ছিল না। পাশাপাশি যারা পরে চাল দিচ্ছেন তারা নতুন দাম পাবেন আর যারা আগে থেকেই অল্প অল্প করে করে চাল সরবরাহ শুরু করেছিলেন তারা সেই সুবিধা পাবেন না। এটা হতে পারে না। ’
তিনি সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ নীতির সমালোচনা করে বলেন, ‘সরকারের একগুঁয়েমির কারণে আজ চালের বাজারে অস্থিরতা চলছে। তবে এর খেসারত দিতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদেরই। ’
তিন জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সদ্য শেষ হওয়া বোরো মৌসুমে দিনাজপুরে সরকারিভাবে নির্ধারণ করা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদন হয়েছে।
দিনাজপুর জেলা কৃষিম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলাম মণ্ডল বাংলানিউজকে জানান, সদ্য শেষ হওয়া বোরো মৌসুমে এক লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে ৬ লাখ ৪১ হাজার ২২৬ মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর বিপরীতে উৎপাদন হয় ৬ লাখ ৮০ হাজার ২৪০ মেট্রিক টন। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪০ হাজার মেট্রিক টন বেশি।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বোরো মৌসুমে এক লাখ ৯৩ হাজার ৯৫৭ হেক্টর জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর বিপরীতে চাষ হয় এক লাখ ৯৮ হাজার ৮৪৫ হেক্টর জমিতে। এই পরিমাণ জমিতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৭ লাখ ৬৪ হাজার ৫১২ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয় ৭ লাখ ৯৭ হাজার ২৩৪ মেট্রিক টন।
জয়পুরহাট জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অদিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুস সোবহান ফেরদৌসী বাংলানিউজকে জানান, ৫টি উপজেলায় মোট ৬৯ হাজার ৬৮৯ হোক্টর জমিতে বোরো মৌসুমে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আর চাষাবাদ হয় ৬৯ হাজার ৯ শ’ হেক্টর জমিতে। অন্যদিকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ৯০ হাজার ৫৯০ মেট্রিক টন ধান। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ হাজার মেট্রিক টন বেশি ধান উৎপাদন হয়েছে।
অন্যদিকে, বোরো মৌসুমে উৎপাদন বেশি হলেও সরকারের সংগ্রহ বা ক্রয়নীতি ও একগুঁয়েমি সিদ্ধান্তের কারণে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান সফল হচ্ছে না। গেল বোরো মৌসুমে সরকার ধান চাল সংগ্রহের জন্য দিনাজপুর, জয়পুরহাট ও নওগাঁয় যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, তিনবার তারিখ পরিবর্তনের পরও ২০ অক্টোবর পর্যন্ত তা অর্জন করতে পারেনি।
সদ্য শেষ হওয়া বোরো মৌসুমে ধান ও চাল ক্রয় করার জন্য সরকার গত ১ মে থেকে সারাদেশে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করে। ৩০ আগস্ট পর্যন্ত সংগ্রহ অভিযানের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। এই সময়ের মধ্যে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা পুরণ না হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় ৩০ সেপ্টেম্বর বাড়ানো হয়। এর পরও সংগ্রহ অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা পুরণ না হওয়ায় সর্বশেষ চলতি মাসের ৩১ তারিখ পর্যন্ত এই সংগ্রহ অভিযানের সময়সীমা বাড়ানো হয়।
দিনাজপুর, জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রকরা জানায়, সম্প্রতি শেষ হওয়া বোরো মৌসুমে দিনাজপুরে এক লাখ ১১ হাজার ৯৮০ মেট্রিক টন চাল ও ৫ হাজার ৬ শ’ ১৯ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর বিপরীতে গত ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৮১ হাজার ৪৪২ মেট্রিক টন চাল এবং ৭২৮ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করেছে সরকার।
জয়পুরহাটে ২৯ হাজার ১৫০ মেট্রিক টন চাল ও দুই হাজার ৩২৭ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর বিপরীতে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২৩ হাজার ৩৮৩ মেট্রিক টন চাল ও ৩১৬ টন ধান সংগ্রহ হয়।
নওগাঁয় ৭৬ হাজার ৩৩৩ মেট্রিক টর চাল ও ৬ হাজার ৫৮ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর বিপরীতে ৪০ হাজার ৪৯২ মেট্রিক টন চাল ও এক হাজার ৬৬২ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে।
ব্যবসায়ী, চালকলের মালিক, আড়তদার, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সরকার চলতি বছরের বোরো মৌসুমে ধান ও চালের মূল্য নির্ধারণ করেছিল কেজি প্রতি যথাক্রমে ১৭ টাকা ও ২৫ টাকা। পরে চালকল ব্যবসায়ীরা এই দামে সরকারি গুদামে চাল দিতে অস্বীকৃতি জানালে গত ১ জুলাই সরকার চালের মূল্যে ৩ টাকা ইনসেনটিভ দেওয়ার ঘোষণা দেয়।
সরকার ঘোষিত ইনসেনটিভ নিয়েও ব্যবসায়ীরা সন্তুষ্ট নয়। তারা বলছেন, এই ইনসেনটিভ পাবে তারাই যারা ঘোষণার পরে সরকারি গুদামে চাল দিতে শুরু করেছেন। কিন্তু আগে যারা চাল দিয়েছেন তারা কেজি প্রতি ওই ৩ টাকা পাবেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই তিন জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রকরা বাংলানিউজকে বলেন, সরকার যদি আগেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে ধান ও চালের মূল্য নির্ধারণ করতো, তাহলে সংগ্রহ অভিযানের এই হাল হত না। সংগ্রহ অভিযান সফলতা নিয়ে তিন জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রকরা সন্দিহান।
বাংলাদেশ সময় : ২২৩৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১০