ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান

‘সংরক্ষিত এলাকা যেখানে অরক্ষিত’

আনোয়ারুল করিম, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১০
‘সংরক্ষিত এলাকা যেখানে অরক্ষিত’

চুনারুঘাট (হবিগঞ্জ) থেকে ফিরে: বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের অন্যতম পুরনো বনভূমি ‘সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান’। ব্রিটিশ আমলেই এ বনভূমিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।

তবে নামে সংরক্ষিত হলেও অরক্ষিতই থেকে গেছে এটি। সংঘবদ্ধ চক্রের হাতে প্রতিনিয়ত উজার হচ্ছে বনভূমির বাঁশ, বেতসহ নানা বনজ সম্পদ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে টিলা ও ভূমি ধস। তবে এ সবের প্রতিকারে নেওয়া হচ্ছে না কোনো ব্যবস্থা।

সরেজমিনে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ঘুরে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও বাংলাদেশের রঘুনন্দন পার্বত্য সংরক্ষিত বনভূমির বাংলাদেশ অংশের ২৪৩ হেক্টর এলাকায় এর পরিধি। ২০০৫ সালে এটিকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়।

১৯১৪ সালে প্রথমবারের মতো রঘুনন্দন বনভূমিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে সেখানে নতুন বনায়নও করা হয়। ১৯৬২ সালে ওই বনভূমির বিশাল এলাকায় সেগুন বাগান সৃজন করা হয়। এখন এই সেগুনের দিকেই সংঘবদ্ধ চোরদের দৃষ্টি।

প্রত্যক্ষদর্শী ও সাতছড়ি বন সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন এমন সূত্রগুলো জানায়, গত পাঁচ বছরে প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যমানের গাছ ও বনজ সম্পদ এখান থেকে চুরি হয়েছে।

চুনারুঘাট উপজেলার চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির লস্কর বাংলানিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে গাছ চুরির কথা স্বীকার করে বলেন, ‘নিয়মিতই গাছ কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। ’

তিনি বলেন, ‘যখন বড় ও বেশি কাটা হয় তখনই হয়তো খবর পাওয়া যায়। ’

গাছ চোররা ‘খুবই সংগঠিত’ বলে মন্তব্য করে কাদির লস্কর বলেন, ‘এদের সম্পর্কে আমি জানি। কিন্তু এখন কিছু বলা যাবে না। সময় হলেই বলবো। ’

গত পাঁচ বছরে তিন কোটি টাকা মূল্যমানের গাছ চুরি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এভাবে তো হিসাব করিনি। তবে বাজারমূল্যের হিসেবে কয়েক কোটি টাকা তো হবেই। ’

গেল সপ্তাহেও গাছ চুরি রোধে স্থানীয়দের নিয়ে উদ্বুদ্ধকরণ সভা করা হয়েছে বলেও জানান এই চেয়ারম্যান।

স্থানীয় কয়েকটি সূত্র জানায়, গাছচোর দলের সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতা জড়িত। রেঞ্জ অফিসার ও বিটের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগসাজসে তারা এ অপকর্ম করে থাকে।

চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সাতছড়ি রেঞ্জের কর্মকর্তা লিয়াকত আলী মোল্লার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও চলছে।

উপজেলা চেয়ারম্যান কাদির লস্কর জানান, সাতছড়ি বন থেকে সর্বশেষ বড় ধরনের গাছ চুরির ঘটনা ঘটে গত ২৮ আগস্ট। সেদিন রাতে গাছ চুরির খবর পেয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ও সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা স্থানীয় থানা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে বনভূমিতে অভিযান চালায়।

তিনি বলেন, ‘কয়েকটি চালান গাছ চোররা বন থেকে বের করে নিয়ে যায়। তবে ভোরের দিকে বনের পাশের চা বাগান থেকে মূল্যবান সেগুন গাছের মাত্র ১০টি গুল উদ্ধার করা হয়। ’

অবশ্য রেঞ্জ কর্মকর্তা লিয়াকত আলী মোল্লা গাছ চুরির সঙ্গে নিজের জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, ‘এ কাজের প্রশ্নই ওঠে না। শক্তিশালী একটি চক্র অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাতে এসে গাছ কাটে। ’

সীমিত জনবল নিয়ে ‘এতো বড়’ বন সুরক্ষা দেওয়ার মতো জনবল সাতছড়ি বিটের নেই বলেও মন্তব্য করেন লিয়াকত আলী মোল্লা।

উপজেলা চেয়ারম্যান জানান, ‘সাতছড়ি বিটকে রক্ষার জন্য চলতি মাসে একজন সহকারী বন সংরক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ’

বনবিভাগ সূত্র জানায়, ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইন অনুয়ায়ী ২০০৫ সালে ২৪৩ সংরক্ষিত বনভূমিতে ‘সাতছড়ি বনাঞ্চল জাতীয় উদ্যান’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

এ বনভূমিতে ১৪৫ প্রজাতির বৃক্ষ ও উদ্ভিদ রয়েছে। এখানে কমবেশি ১৯৭ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। যার মধ্যে ১৪৯ প্রজাতির পাখি, ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৬ প্রজাতির উভচর প্রাণী থাকতে পারে। তবে এ হিসেবও প্রায় ১০ বছর আগের।  

সাতছড়ি উদ্যানের নিরাপত্তা সম্পর্কে রেঞ্জ কর্মকর্তা লিয়াকত আলী মোল্লা বলেন, ‘উদ্যানের নিরাপত্তায় ৩টি মোটর সাইকেল ও ১০ জন পুলিশের সমন্বয়ে একটি টহল দল উদ্যান এলাকায় গত বছরের নভেম্বর থেকে কাজ করছে। ’

গাছ চুরির কাজে বনের আশেপাশের এবং বনবিভাগের জমিতে বসবাসকারীরা সহায়তা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এজন্য ওইসব মানুষদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্যও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

চুনারুঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান কাদির বলেন, ‘চুনারুঘাট উপজেলার পাইকপাড়া ও দেওরগাছ এবং মাধবপুর উপজেলার শাহজাহানপুর ইউনিয়নের ১৩৫জন পুরুষ ও ১২৮ জন নারীর জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ’

তিনি বলেন, ‘এদের বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে ৫ লাখ ৬৯ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামবাসীকে গাছ চুরির সহায়তা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। ’

বনভূমির পাহাড় ও টিলা ভূমিধস ও গাছপালা উপড়ে পড়া প্রসঙ্গে রেঞ্জার লিয়াকত মোল্লা বলেন, ‘ধসে যাওয়ার পর পাশ থেকে মাটি কেটে সেখানে দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এ ধরনের কোনো বাজেট আমাদের নেই। তাই কিছু করা যাচ্ছে না। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।