ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

টিটন ‘নিশ্চুপ’, পিচ্চি হেলাল আত্মগোপনে, ইমনের খবর নেই 

আবাদুজ্জামান শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫
টিটন ‘নিশ্চুপ’, পিচ্চি হেলাল আত্মগোপনে, ইমনের খবর নেই  খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন এবং ইমামুল হাসান ওরফে পিচ্চি হেলাল

ঢাকা: জুলাই বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান। এরপর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

তারপর থেকে হাসিনার সরকারের রাজনৈতিক, হয়রানিমূলক ও গায়েবি মামলার অনেক বন্দি মুক্তি পান। আইনি এ প্রক্রিয়ায় ফাঁক গলে এ পর্যন্ত সরকারের তালিকাভুক্ত ১১ শীর্ষ সন্ত্রাসীও জামিনে মুক্তি পেয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছেন।

অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে পুলিশসহ কতিপয় বিভাগে খানিকটা স্থবিরতা দেখা যায়। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার এসব সংস্থা ও বিভাগে গতিশীলতা পুরোদমে ফেরাতে সচেষ্ট। তবে ওই স্থবিরতার সুযোগে কারাগার থেকে সন্ত্রাসীদের মুক্তি পাওয়া নিয়ে নানা মহলে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়। প্রশ্ন উঠেছে, ওই সন্ত্রাসীরা কী শর্তে জামিন পেয়েছেন, তারা এখন কোথায় আছেন, দেশে নাকি বিদেশে? কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে তারা কি নিজেদের শুধরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন, নাকি আবারও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মেতে উঠেছেন, তা নিয়ে সচেতন মহলে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

তালিকাভুক্ত ওই ১১ শীর্ষ সন্ত্রাসীর বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে বাংলানিউজ। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে আজ থাকছে খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন এবং ইমামুল হাসান ওরফে পিচ্চি হেলালের প্রসঙ্গ।

কারা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ৫ আগস্টের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন ও খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন। সেখান থেকে খোরশেদ আলম ওরফে রাসু নামে আরেক তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীও মুক্তি পান।  

অন্যদিকে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান ইমামুল হাসান ওরফে পিচ্চি হেলাল। পাশাপাশি এস এম আরমান, শেখ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, হাবিবুর রহমান তাজ, আকতার হোসেন ও মো. সোহেলও এই কারাগার থেকে মুক্ত হন।  

কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে মুক্তি পান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ‘কিলার আব্বাস’ হিসেবে পরিচিত মিরপুরের আব্বাস আলী ও শাহাজাদা সাজু।

হেলাল-ইমনের দ্বন্দ্ব ফের প্রকাশ্যে
কারাগার থেকে বেরোনোর পর রাজধানীতে তাদের অনেকের তৎপরতা দৃশ্যমান হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মোহাম্মদপুরে জোড়া খুনের ঘটনায় পিচ্চি হেলালের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়।

পরে গত জানুয়ারিতে এলিফ্যান্ট রোডে দুই ব্যবসায়ীকে কোপানোর ঘটনায় পিচ্চি হেলাল ও ইমনের মধ্যকার দ্বন্দ্বের বিষয়টি আবারো সামনে আসে।  

তবে পরিবারের দাবি, জামিনে মুক্তি পাওয়ার কদিনের মধ্যে ইমন দেশের বাইরে চলে যান। তবে পুলিশ বলছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন দেশ ত্যাগ করেছেন কি না, ইমিগ্রেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তা বের করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

১০ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখমের ঘটনা ঘটে। এতে আহত হন এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার সোসাইটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক ও সভাপতি ওয়াহিদুল হাসান দিপু।  

পরে পুলিশ ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, এর নেপথ্যে রয়েছে পিচ্চি হেলাল ও ইমনের আধিপত্য বিস্তার আর চাঁদাবাজি নিয়ে দ্বন্দ্ব।

গত বছরের ১৫ ও ১৬ আগস্ট যথাক্রমে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান ইমন ও পিচ্চি হেলাল। তারা কারাগারে থেকেই অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করতেন। কারামুক্তির পর তারা আধিপত্য বিস্তারের জন্য দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন।

তবে গত ১৮ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে ইমনের মা সুলতানা জাহান দাবি করেন, ইমন বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন, তাকে ষড়যন্ত্র করে মাল্টিপ্ল্যানের সামনের ঘটনায় ফাঁসানো হয়েছে।  

মায়ের দাবি, ছেলে ইমন আওয়ামী নেতা ও মন্ত্রীদের রোষানলে পড়ে একাধিক মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে বিনা বিচারে বছরের পর বছর জেলখানায় আটক ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইমন জামিনে মুক্তি পেয়ে ইমন বিদেশে চলে গেছেন।

তিনি বলেন, মাল্টিপ্ল্যানের সামনে হামলায় আহত ওয়াহিদুল হাসান দিপু শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের আপন বড় ভাই। গত ৫ আগস্টের পর বসিলায় জোড়া খুনের ঘটনা হেলাল নিজের হাতে ঘটিয়েছেন বলে মামলার তদন্তসূত্রে আমরা জেনেছি।  

এলিফ্যান্ট রোডের ঘটনা নিয়ে সুলতানা জাহান জানান, মাল্টিপ্ল্যান মার্কেটের সভাপতি নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মার্কেটের সভাপতি পদে বিজয়ী হন ওয়াহিদুল হাসান দিপু। মার্কেটটি নিজের দখলে রাখার জন্য হামলার ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারেন।  

ইমন-টিটন সম্পর্কে যা জানা গেল
এদিকে সম্পর্কে ‘আত্মীয়’ শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন জামিনে মুক্ত হলেও ধানমন্ডি, জিগাতলা ও হাজারীবাগ এলাকায় তাদের দেখা যায়নি বলে জানান স্থানীয়রা।

স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি তাদের পূর্ব পরিচিতরা জানান, ইমন ও টিটন জামিনে মুক্ত হয়েছেন বলে তারা পত্র-পত্রিকায় দেখেছেন। কিন্তু এলাকায় তাদের দেখতে পাননি।

নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, আশির দশকের শেষ দিকে ইমনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু হয়। আর টিটন মূলত ইমনের দাপটেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতেন। পরে টিটনের ছোট বোনকে বিয়ে করেন ইমন। তারপর থেকে তারা আত্মীয় হয়ে যান।

তারা জানান, ইমন কারাগার থেকে বেরিয়েই তার সহযোগীদের নিয়ে ধানমন্ডি এলাকায় একটি শোডাউন করেন। ইমনকে এলাকায় ‘ক্যাপ্টেন’ নামে ডাকা হয়।  

আর টিটন জামিনে বেরিয়েই রায়েরবাজারের সুলতানগঞ্জে নিজ বাড়িতে একবার গিয়েছিলেন। এরপর এলাকায় আর তার দেখা মেলেনি। স্থানীয়রা জানান, সম্ভবত টিটন তার গ্রামের বাড়ি যশোরে চলে গেছেন। তিনি নিশ্চুপ রয়েছেন।

সুলতানগঞ্জের স্থানীয় কয়েকজন দোকানি বলেন, ৩৫ থেকে ৪০ বছর আগে ইমন ও টিটন সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। এখন তাদের অনেক বয়স হয়েছে। এলাকার উঠতি বয়সের ছেলেরা তাদের চেনে না। জেলখানায় থাকা অবস্থায় ইমনের নির্দেশে যারা এলাকায় এক সময় ত্রাস সৃষ্টি করতেন তাদেরও বয়স হয়েছে। তাদেরও আর দেখা যায় না।

আর মোহাম্মদপুর এলাকায় গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারাগার থেকে বেরোনোর পরপরই পিচ্চি হেলাল তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে শোডাউন দিয়েছিলেন। তার ঘনিষ্ঠ সুমন ও স্বপন মোহাম্মদপুর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন।  

মোহাম্মদপুরের জোড়া খুন এবং এলিফ্যান্ট রোডে দুই ব্যবসায়ীর কোপানোর ঘটনায় পিচ্চি হেলালের নাম এলে সুমন ও স্বপনের উৎপাত অনেকটা কমে যায়। এখন মোহাম্মদপুর এলাকায় তাদের দেখা নেই বললেই চলে। পিচ্চি হেলালকেও আর দেখা যায় না। পুলিশ জানায়, তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।

যা বলছে পুলিশ
৫ আগস্টের পর কারাগার থেকে বের হওয়া সন্ত্রাসীরা কে কোথায়, কী করছেন, জানতে চাওয়া হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা প্রধান রেজাউল করিম মল্লিকের কাছে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, জামিনে কারাগার থেকে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কে কোথায়, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্তদের গ্রেপ্তারে নিয়মিত অভিযান চলছে।

তিনি বলেন, কারাগার থেকে জামিনে বেরোনোর পর পিচ্চি হেলাল-ইমনসহ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নতুন করে অপকর্মে জড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। কারো কারো বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টাসহ চাঁদাবাজির মামলাও হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, পিচ্চি হেলাল বা ইমনসহ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রুপে যারাই থাকুক, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এরইমধ্যে এসব গ্রুপের কয়েকজন সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অবস্থান এখনো শনাক্ত করতে পারিনি। তবে আমাদের শতভাগ চেষ্টা চলছে।  

আরেক প্রশ্নের জবাবে রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন দেশের বাইরে চলে গেছে কি না, এখনো গোয়েন্দা পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি। তবে ইমিগ্রেশন থেকে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।

নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহসীন উদ্দিন বলেন, মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনের দুই কম্পিউটার ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করার ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনসহ বেশ কয়েকজনের নামে মামলা হয়। ইমনকে ধরার জন্য অভিযান চলছে।

আর জোড়া খুনের ঘটনা নিয়ে মোহাম্মদপুর থানার ওসি (তদন্ত) হাফিজুর রহমান বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান চলছে। থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশও তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে। তবে তিনি আত্মগোপনে আছেন।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫
এজেডএস/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।