ঢাকা: দেশে ওষুধের দাম প্রায়ই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। সবশেষ কয়েকমাসে বেড়েছে প্রায় ৩০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত।
দায়িত্বশীল সূত্র মতে, দেশের তিন শতাধিক কোম্পানি অ্যালোপ্যাথি ওষুধ তৈরি করে। দেড় হাজারেরও বেশি জরুরি ওষুধের মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় রয়েছে ২১৯টি। এর মধ্যে ১১৭টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। অন্য সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে কোম্পানিগুলোই।
ওষুধের দরদামের বিষয়ে সম্প্রতি বাংলানিউজকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশের (এএইচআরবি) আহ্বায়ক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তার অভিমত, বাজার নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের ওষুধের দাম ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে সরকারকে।
বাংলানিউজ: ওষুধের দাম হঠাৎ কেন বাড়ে, দাম নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে?
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ: ওষুধ একটি বাণিজ্যিক পণ্য। সুতরাং ওষু্ধের মূল্য কখনোই স্থির থাকবে না এবং সেই সুযোগও নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওষু্ধের দাম বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। দাম স্থির রাখতে হলে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে, তবে সরকারের সেই সক্ষমতা নেই। দেশের জনগণকেও মেনে নিতে হবে, ওষু্ধের দাম বাড়বে। তবে দাম বাড়ার বিষয়টা যেন নিয়ন্ত্রিত হয়, লাফ দিয়ে যেন না বাড়ে। দেখা যাচ্ছে ৫০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ ওষু্ধের দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু এটা যদি প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর দুই-চার শতাংশ করে বাড়তো, তাহলে মানুষ সহজেই অ্যাডজাস্ট (মানিয়ে নেওয়া) করতে পারতো।
ওষুধের দাম নির্ধারণের জন্য সরকারের একটি কমিটি আছে। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি অনুযায়ী ১১৭টি ওষুধের মূল্য সরকারের যে কমিটি আছে, সেই কমিটির মাধ্যমে ফর্মুলার ভিত্তিতে (উৎপাদন খরচ ও লাভের অংশসহ হিসাব করে) মূল্য নির্ধারণ করার কথা। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেই কমিটি নিয়মিত সভা করে ওষুধের দাম পুনর্নির্ধারণ করে না। কোনো রাজনৈতিক সরকারই ওষুধের দাম বাড়ানোর সাহস পায় না। ফলে উল্লিখিত (১১৭) ওষুধগুলো কোম্পানি এখন আর উৎপাদন করে না। তারা সেই ক্যাটাগরি থেকে বেরিয়ে এসে লাভজনক ওষুধ উৎপাদন করে।
ওষুধ তৈরিতে অ্যাকটিভ এবং প্যাসিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট (উপাদান) ব্যবহার করা হয়। প্যাসিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট ওষুধের গুণাগুণের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এটা প্রিজারভেটিভ, কালার কিংবা সুইটনেস বাড়ানো-কমানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। ওষুধ কোম্পানিগুলো প্যাসিভ ইনগ্রেডিয়েন্টগুলো পরিবর্তন করে সেই ক্যাটাগরি থেকে বেরিয়ে এসে ওষুধ তৈরি করে। অর্থাৎ সরকার যদি এই ১১৭টি ওষুধের দাম দুই বছর অন্তর অন্তর পুনর্নির্ধারণ বা যুগোপযোগী করতো, তাহলে এমন পরিস্থিতি হতো না। কোনো কোম্পানি যদি অনবরত লোকসানে থাকে তাহলে সে সেটা তৈরি করবে না। দামটা পুনর্নির্ধারণ করা হয় না বলেই ওষুধ কোম্পানিগুলো সেগুলো উৎপাদন করে না। খেয়াল করে দেখবেন ১১৭টি ওষুধের দাম খুবই কম।
বাংলানিউজ: ওষুধের যৌক্তিক দাম নির্ধারণে করণীয় কী?
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ: ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে না। অধিদপ্তরের সেই সক্ষমতা নেই এবং তাদের সেটা করাও উচিত নয়। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কাজ হচ্ছে, ওষুধের অনুমোদন এবং গুণগত মান রক্ষা করা। ওষুধের যৌক্তিক মূল্যে নির্ধারণের জন্য একটি ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি তৈরি করতে হবে। যেমনটা ভারতে রয়েছে। তারা স্বতন্ত্রভাবে প্রতি দুই তিন বছর অন্তর অন্তর ওষুধের দাম নির্ধারণ করে। ওষুধের দাম নির্ধারণের জন্য অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হয়। কোন কোম্পানি কী ধরনের কাঁচামাল কোন দেশ থেকে ক্রয় করে, কত পরিমাণ ক্রয় করে এবং উৎপাদন ব্যবহার করে, এই সমস্ত জিনিস ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে হয়। ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে অথেনটিক উপায়ে তথ্যগুলো নিয়ে, সেটাকে অ্যানালাইসিস (বিশ্লেষণ) করে তারপর ওষুধের দাম পুনর্নির্ধারণ করতে হয়।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে এখন যে কমিটি রয়েছে, সেই কমিটির এসব তথ্য অ্যানালাইসিস করার সামর্থ্য নেই। কন্টিনিউয়াসলি (অবিরত) এই কাজগুলো করতে দক্ষ লোকের প্রয়োজন হয়। কমিটিতে সেই দক্ষ লোক নেই। ফলে তারা সেটা করতে পারে না। আবার সরকার রাজনৈতিকভাবেও ওষুধের দাম বৃদ্ধির সাহস পায় না।
আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, সব প্রকার ওষুধের দাম সরকার কর্তৃক ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারিত হতে হবে। সেক্ষেত্রে ফর্মুলা এবং মার্কআপ (উৎপাদন খরচে যোগ হওয়া অংক) যদি পরিবর্তন বা যুগোপযোগী করতে হয়, করতে হবে। ওষুধ কোম্পানি এবং জনগণ উভয়ের স্বার্থ যেন রক্ষা হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এই সমস্ত কাজগুলো করার জন্য ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইস ইন অথরিটি লাগবে। প্রতি দুই বছর পর পর এই অথরিটি ওষুধের দাম রিভাইস (পুনর্বিবেচনা) করবে। রিভাইস করে ৫ শতাংশ কিংবা ১০ শতাংশ যৌক্তিকভাবে বাড়াবে। এটা নিয়মিত করলে, যে ওষুধের দাম ১০০ টাকা ছিল, সেটা যদি ১০৫ কিংবা ১১০ টাকা হয় তাহলে মানুষের খুব বেশি সমস্যা হবে না। কিন্তু ১০০ টাকার ওষুধ যদি ১৭৫ কিংকা ২০০ টাকা হয়ে যায় তখন সেটা আমাদের জন্য কষ্টকর হয়ে যায়। যেটা এখন হয়েছে।
বাংলানিউজ: ওষুধ কোম্পানির পক্ষ থেকে ডাক্তারদের বিভিন্ন ধরনের উপহার এবং টাকা পয়সা দেওয়া হয়ে থাকে। এতেও ওষুধের দাম বাড়ে। এই উপঢৌকনের প্রবণতা কীভাবে বন্ধ হবে?
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ: আমরা এটাকে অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং বলি। ওষুধের দাম যদি সরকারের ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, তাহলে কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত মূল্য নেওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। অতিরিক্ত মূল্য যখন নিতে পারবে না, তখন যদি অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং করতে হয়, তাহলে ওষুধ কোম্পানির সারপ্লাস থেকে এই খরচ বহন করতে হবে। ফলে কোম্পানিগুলো অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং করতে পারবে না।
এখন যেহেতু কোম্পানি নিজেরাই দাম নির্ধারণ করে, তাই ওষুধের দাম ১০ টাকা বাড়িয়ে সেখান থেকে ডাক্তারদের আট টাকা দিতে তাদের তেমন কোনো সমস্যা হয় না। দাম যখন সরকারের কোন অথরিটি বাড়াবে, তখন এই ধরনের কাজ করলে ওষুধ কোম্পানির উদ্বৃত্ত থেকে টাকাটা যাবে। যেহেতু প্রাইসিং ফর্মুলা সব কোম্পানির জন্য প্রযোজ্য, তাই কোনো কোম্পানি ইচ্ছা করলেই দাম বাড়াতে পারবে না। সবদিক রক্ষার জন্য একমাত্র উপায় হচ্ছে সমস্ত প্রকার ওষুধের দাম ফর্মুলার ভিত্তিতে হতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৫
আরকেআর/এইচএ/