ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৮ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

১৬ বছরের ‘সাংস্কৃতিক কারাগার’ থেকে বেরিয়ে আসছেন শিল্পীরা

পিংকি আক্তার, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৫
১৬ বছরের ‘সাংস্কৃতিক কারাগার’ থেকে বেরিয়ে আসছেন শিল্পীরা

ঢাকা: ‘তুমি বঙ্গবন্ধুর রক্তে আগুন জ্বলা জ্বালাময়ী সে ভাষণ, তুমি ধানের শীষে মিশে থাকা শহীদ জিয়ার স্বপন। ’ প্রিন্স মাহমুদের লেখা গানটি দরদ দিয়ে গেয়েছিলেন রকস্টার জেমস।

এতে উঠে আসে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথা, উঠে আসে স্বাধীনতার কারিগরদের কথা, উঠে আসে মাতৃভূমির প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রেমের কথা।

গানটি ছড়িয়ে পড়ে ছেলে থেকে বুড়ো সব বয়সী মানুষের মুখে। জেমসের গাওয়া এ গান যেন হয়ে ওঠে দেশপ্রেমের এক অনন্য ভাষা। কিন্তু আওয়ামী সরকারের কানে লেগেছিল শুধু ‘ধানের শীষে মিশে থাকা শহীদ জিয়ার স্বপন’ লাইনটিই। আর সে কারণেই অঘোষিতভাবে সরকারি সব অনুষ্ঠান ও চ্যানেলে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর একমতো ‘নিষিদ্ধ’ ছিল জেমসের গাওয়া ওই গান। শুধু ওই একটি লাইনের জন্য শেখ হাসিনা সরকারের বিরাগভাজন হয়ে যান তিনি।

সংস্কৃতি চর্চায় ভিন্নমতের হলেই আওয়ামী আগ্রাসনের শিকার

আওয়ামী সরকারের সাংস্কৃতিক বিরাগভাজন তালিকা ছিল বেশ দীর্ঘ। অর্থাৎ কোনো শিল্পী যদি ভিন্ন দল বা ভিন্ন মতের হতেন, কিংবা তার সংস্কৃতি চর্চায় যদি কোনোরকম প্রতিবাদী ভাষা ফুটে উঠত, তাহলে তিনিই শিকার হতেন আওয়ামী আগ্রাসনের।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ‘অঞ্জনা’ খ্যাত সংগীতশিল্পী মনির খানের কথা। দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর গাইতে পারেননি বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন কিংবা কোনো বেসরকারি চ্যানেলে। বিএনপি মতাদর্শের এই গায়ক আওয়ামী সরকারের আমলে অঘোষিতভাবেই নিষিদ্ধ ছিলেন।

শেখ হাসিনার পতনের পর সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় পর মনির খান বাংলাদেশ বেতারে প্রবেশ করে নিজের গান রেকর্ডিং করার সুযোগ পান। বাংলানিউজ কথা বলেছে জনপ্রিয় এই শিল্পীর সঙ্গে।

জানতে চাইলে মনির খান বলেন, ‘আমরা গানের মানুষ। আর এই গান শুধু মানুষের বিনোদনই নয়, মানুষের শক্তিও। আমরাই সেই শক্তির যোগানদাতা। শুধু ভিন্নমতের হওয়ার কারণে দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর বোবার মতো থাকতে হয়েছে। এটি একজন শিল্পীর জন্য যন্ত্রণার। তবে হ্যাঁ, আমি আমার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে ভক্তদের কাছে নিজের গান পৌঁছে দিতে পেরেছি কিছুটা হলেও। ’

তিনি আরও বলেন, ‘আজ এত বছর পর এই যে গাইতে পারছি, এই যে কথা বলতে পারছি, আমরা ঠিক এমনটাই চেয়েছিলাম, যেখানে গলা ছেড়ে গাইতে পারা যায়।  গানের মাধ্যমে ফুটে ওঠে মানুষের মনের ভাব। আর সেখানে যখন শিকল পরানো হয় তখন সেটি ফাঁসির সমতুল্য হয়ে যায়। ’

২০২৫ সালের শুরুতে মনির খানের ‘স্বৈরাচারী অঞ্জনা’ গানটি প্রকাশ পায়। প্রকাশের পর থেকেই গানটি নিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের কাছ থেকে দারুণ সাড়া পাচ্ছেন বলে জানান শিল্পী নিজেই। গানটি লেখেন মিল্টন খন্দকার, সংগীতায়োজনে ছিলেন বিনোদ রায়।

আওয়ামী শাসনের সময়ে মনির খানের মতো অঘোষিত নিষিদ্ধের তালিকায় ছিলেন আসিফ আকবর, বেবি নাজনীন, কনকচাঁপা, নাজমুন মুনিরা ন্যান্সি, ইথুন বাবু, মৌসুমী চৌধুরীসহ গানের দুনিয়ার অনেকে। তারা সবাই ভিন্ন দল-মতের ছিলেন।

একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রয়াত শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ ও বশির আহমেদও আওয়ামী ফ্যাসিজমের অবহেলার শিকার ছিলেন।

ইথুন বাবুকে শুরুর দিকে শিল্পী হিসেবেই শ্রোতারা চিনতেন। পরে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলা গানের জগতে অন্যতম জনপ্রিয় গীতিকার ও সুরকার। তার লেখা অসংখ্য গান বিভিন্ন সময়ে আলোড়ন তুলেছে দেশব্যাপী। ২০০১ সালে তার কথা, সুর ও সংগীতায়োজনে প্রকাশ পায় ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’— নামের জনপ্রিয় এক অ্যালবাম। ওই এক অ্যালবামেই তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন শিল্পী আসিফ আকবর।

তবে হাসিনা সরকারের শাসনকালে বিএনপি মতাদর্শের হওয়ায় এই দুই তারকাই ছিলেন বঞ্চিত, গাইতে দেওয়া হয়নি কোথাও, যেতে পারেননি বাংলাদেশ টেলিভিশনেও। যদিও গানের মাধ্যমে নিজের প্রতিবাদী ভাষা জারি রেখেছিলেন ইথুন বাবু। তবে সেজন্য বারবার হয়রানির শিকারও হতে হয়েছিল তাকে।

ইথুন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা— জাসাসে সক্রিয়। কথা হলে তিনি বলেন, ‘গত এক যুগেরও বেশি সময় ছিল আমাদের সাংস্কৃতিক কারাবাস। স্বাধীন দেশে আমরা শিল্পী ও কলাকুশলীরা ভিন্নমতের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছি। ’

‘আমি উচ্চ পর্যায়ের সংগীত পরিচালক ও সুরকার হলেও ১৬ বছর কাজ করতে পারিনি, যা আমাকে অবাক করে। আমাকে কালো তালিকায় রাখার জন্য ইন্ডাস্ট্রির লোকজন জড়িত ছিলেন। কেন এত বছর আমার বিটিভির পথ বন্ধ ছিল, তাদের কাছে প্রশ্ন রইল’, বলেন ইথুন।

ইথুন বাবুর ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি’ গানটি গত বছরের আন্দোলনে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তিনি বলেন, এই গানের জন্য আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। মৌসুমীকে (গানে কণ্ঠ দেওয়া মৌসুমী চৌধুরী) ধরার জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ’

আওয়ামী শাসনের সময়ে অনেক অভিনেতা ভিন্নমতের হওয়ার কারণে কাজ করতে পারেননি। তাদের একজন বাংলা সিনেমায় খল চরিত্রে অভিনয় করা শিবা সানু।

‘সিনেমা একটি দেশের পরিচয় বহন করে। কিন্তু সেখানেও অবাধে দলীয়করণ চলেছে। এ কারণে হারিয়ে গেছে অনেক মেধাবী মুখ। বাংলাদেশের সিনেমার যে পর্যায়ে অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল, তা শুধু আওয়ামী শাসনের কারণেই হয়নি’ বলছিলেন তিনি।

একটি সিনেমা থেকে বাদ পড়ার ঘটনা স্মরণ করে এই অভিনেতা বলেন, ‘ভারতের নায়ক দেবের প্রডাকশন হাউস ও বাংলাদেশের শাপলা মিডিয়ার যৌথ পরিচালনায় একটি সিনেমায় আমি শুটিং করছিলাম। পরে হঠাৎ আমাকে বাদ দেওয়া হয়। পরে ওই সিনেমা থেকে সরে যান নায়ক দেবও। গত ১৬ বছরে আমার সঙ্গে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটে, সব বলে শেষ করা যাবে না। ’

এই অভিনেতার কথায়, ‘তদবির, দলীয়করণ কিংবা তোষামোদী দিয়ে কখনো সাংস্কৃতিক অঙ্গন চলতে পারে না। এখানে মেধা দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংস্কৃতির বিকাশ হতে দিতে হবে। ’

কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা

টানা প্রায় ১৬ বছরে সংস্কৃতি অঙ্গনে আওয়ামী রাজনীতির বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এই পুরোটা সময়ে মেধার বিকাশ ঠিকঠাক ঘটেনি। কোনো শাখা তেমন অগ্রসর হতে পারেনি, বরং পিছিয়েছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংস্কৃতির সব শাখা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল আওয়ামী সরকার। গান, সিনেমা, সাহিত্য চর্চা কিংবা কবিতা, সবখানেই ছিল শেখ পরিবারের বন্দনা। এর বাইরে দেশ ও জাতি তেমন কিছুই পায়নি, বলছিলেন নজরুল ইনস্টিটিউটের পরিচালক লতিফুল ইসলাম শিবলী। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘সংস্কৃতি চর্চায় এই দীর্ঘ বছর মেধা বিকাশের সুযোগ কম ছিল। উল্টো আমরা ৫০ বছর পিছিয়ে পড়েছি। ’ 

শিবলী মনে করেন, আওয়ামী শাসনের সময়ে ‘ভারতীয় সংস্কৃতি আর সরকারের মোসাহেবি করা লোকেরাই সুযোগ পেয়েছিলেন। আর এতে করে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সংস্কৃতি তেমনভাবে পৌঁছাতে পারেনি।

দেশের সংস্কৃতি বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে সবাইকে দলমত নির্বিশেষে কাজ করার পরামর্শ এই সংস্কৃতিকর্মীর।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সাংস্কৃতিক সম্পাদক, ঢাকাই সিনেমার এক সময়ের মেগাস্টার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল বলেন, ‘সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর শিল্পী সমাজের অধিকারও কেড়ে নিয়েছিল ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। বাকশালী কায়দায় মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি শিল্পীদেরও কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। ’

জ্যেষ্ঠ এই শিল্পী বলেন, ‘শুধুমাত্র ভিন্ন মতাদর্শের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকার কারণে গত প্রায় ১৬ বছর শিল্পীদের সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। এমনটি এর আগে কোনো সরকার করেনি। দেশের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম নির্যাতনের পাশাপাশি ভিন্নমতের অনেক শিল্পীকে কাজ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। ’

‘স্বৈরাচারের দুঃশাসনে শিল্পীদের অনেকে দেশান্তরী হয়েছেন, আবার অনেকে ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। একজন শিল্পী হিসেবে সব কিছুর আগে আমি শিল্পীদের অধিকারকে প্রাধান্য দেব। ফ্যাসিবাদ পরবর্তী বাংলাদেশে শিল্পীরা যেন তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পান, সেটিই আমার প্রত্যাশা’, বলেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০২০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৫
আরএইচ/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।