ঢাকা: মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট দেওয়ার যোগ্য, কিন্তু দেন না। কোনো না কোনো উপায় বের করে রাজস্ব দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
এনবিআর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বার্ষিক ৩০ লাখ টাকা টার্নওভার বা লেনদেন আছে, এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা ইউনিটকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে চায় রাজস্ব আহরণের এ প্রতিষ্ঠান। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ লাখের কিছু বেশি বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (বিন) ছিল। যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই ভ্যাট আদায়সহ রিটার্ন দাখিল করে আসছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আসার পর ভ্যাট আদায় বাড়াতে নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে জোরদার কার্যক্রম শুরু করে। এরই মধ্যে বিন ছয় লাখে পৌঁছে গিয়েছে। মার্চ নাগাদ এ সংখ্যা আট লাখে পৌঁছে যাবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।
সক্ষম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের আওতায় আনার এ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, রাজস্ব বৃদ্ধিতে এনবিআরের ভালো উদ্যোগ এটি। ব্যবসা করতে হলে ব্যবসা রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান করযোগ্য তারা কর দেবে, যারা করযোগ্য না তারা দেবে না।
এদিকে ভ্যাট আদায়ে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অটোমেশনে জোর দিয়েছেন কর পেশাদাররা। তারা বলছেন, ভ্যাট আদায়ে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো পেশাদারিত্বের সঙ্গে করতে হবে। তা না হলে উদ্যোগ উদ্যোগই থেকে যাবে, সরকারের ঘরে রাজস্ব উঠবে না। এজন্য পেশাদারিত্বের পাশাপাশি কার্যকর অটোমেশন করতে হবে।
এ বিষয়ে এসএমএসি অ্যাডভাইজারি সার্ভিসেস লিমিটেডের পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া বাংলানিউজকে বলেন, এনবিআরের নিবন্ধন কার্যক্রমের ফলে নিবন্ধিত ভ্যাট প্রদানকারীর সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু ভ্যাট আদায় কি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে? অধিকাংশ ব্যবসায়ী নগদে লেনদেন করেন, যা সহজে যাচাই-বাছাই করা যায় না। যে সমস্ত খুচরা দোকানদার ভ্যাট পরিশোধ করতেন না, এখন যদি নতুন নিয়মে তাদের ভ্যাট ও অন্যান্য খরচ দিতে হয় তাহলে তারা পরিবেশকদের নিকট হতে আরও অধিক কমিশন দাবি করবেন। তখন এসব পণ্যের উৎপাদনকারী বা আমদানিকারক পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
সেজন্য এনবিআরের উদ্যোগকে সফল করতে অটোমেশনে জোর দেন এই ভ্যাট প্র্যাকটিশনার। তিনি বলেন, ক্যাশলেস সিস্টেম চালু করা গেলে লেনদেন শনাক্ত করা যেতো। তখন একজন ব্যবসায়ী ভ্যাটের সীমা অতিক্রম করলে সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত হতো এবং নিকটস্থ ভ্যাট অফিসকে নোটিফিকেশন পাঠাতো। নিবন্ধিত ব্যক্তির নিকট থেকে ঝামেলাহীনভাবে সঠিক ভ্যাট আদায় হতো এবং অনৈতিক লেনদেনে জড়ানোর পরিবেশ তৈরি হতো না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা এক কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪টি। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫টি। এ হিসাবে ১০ বছরে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ৪০ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯৯টি বা ৫১.৯১ শতাংশ বেড়েছে। এসব অর্থনৈতিক ইউনিটের কথা মাথায় রেখে নিবন্ধন কার্যক্রমে এগোচ্ছে এনবিআর।
ব্যবসায়ী সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, ভ্যাট দিতে সক্ষম ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৬০ লাখের ওপরে রয়েছে। অবশ্য যে ব্যবসায়ীরা গত কয়েক বছরে ধরে ভালো করছেন তারা এনবিআরের নিবন্ধনের আওতায় আসছেন এবং বিন পাচ্ছেন। যদিও বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আগে থেকেই নিবন্ধিত এবং নিয়মিত ভ্যাট দেয়। গত জুলাই-আগস্টে অভ্যুত্থানের সময় কিছু ব্যবসায়ী ভ্যাট দেওয়ার সক্ষমতা হারান। এর মধ্যে আবার নতুন করে কিছু ব্যবসায়ী সক্ষম হয়েছেন। ফলে এনবিআরের রাজস্ব আদায় বাড়বে।
এনবিআর সূত্রের তথ্য মতে, সংস্থাটি যে রাজস্ব আদায় করে—আয়কর, আমদানি-রপ্তানি শুল্ক ও ভ্যাট—এর মধ্যে তুলনামূলক ভ্যাট বেশি। যদিও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে অর্থাৎ ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা তেমন পূরণ হয়নি। মোট রাজস্বে ভ্যাটের হারও কিছুটা কমেছে। উল্লিখিত ছয় মাসে ভ্যাট আদায়ের পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার ১৮১ কোটি টাকা, যা মোট রাজস্বের ৩৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। আগের বছরগুলোতে এ হার ছিল যথাক্রমে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ; ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৬ দশমিক ১১ শতাংশ; ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৬ শতাংশ।
বছর হিসাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত আট বছরে ভ্যাট আহরণ ছিল যথাক্রমে ৬৩ হাজার ৫৬২ কোটি; ৭৮ হাজার ৬৯৪ কোটি; ৮৭ হাজার ১৭৯ কোটি; ৮৪ হাজার ৪৬৭ কোটি; ৯৭ হাজার ৫০৭ কোটি; এক লাখ ৮ হাজার ৪১৮ কোটি; এক লাখ ২৫ হাজার ৪২৩ কোটি এবং এক লাখ ৫০ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা।
এনবিআর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের নিবন্ধনের পাশাপাশি আদায় প্রক্রিয়াও অটোমেশনের আওতায় আসছে। এ লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের জন্য এরই মধ্যে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) চালু করেছে এনবিআর। ঢাকা ও চট্টগ্রামে নয় হাজার ইএফডি মেশিন দেয় এনবিআর। এসব মেশিনের ছয় হাজার কার্যকর আছে, বাকি তিন হাজার পড়েছিল। এগুলো জুয়েলারি খাতের ব্যবসায়ীদের দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অন্যান্য ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও এটা সরবরাহ হচ্ছে। ইতোমধ্যে জরিপ শুরু হয়েছে। জরিপ শেষ হলে পর্যায়ক্রমে নতুন-পুরনো নিবন্ধিত ব্যবসায়ীদের ইএফডি দেওয়া হবে।
অটোমেশন প্রক্রিয়ায় ই-ইনভয়েস সিস্টেমও চালু হচ্ছে। ক্রেতা কোনো পণ্য কেনার সঙ্গে সঙ্গে সেটা চলে যাবে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সিস্টেমে। প্রথমে এ ই-ইনভয়েস সিস্টেমে যাবেন বড় ব্যবসায়ীরা, এরপর যাবেন তুলনামূলক মাঝারি ও ছোট্ট ব্যবসায়ীরা।
এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, ই-ইনভয়েস চালুর জন্য টেন্ডারিংয়ের কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। দ্রুতই অপারেশনে যাবে ই-ইনভয়েস।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০২৫
জেডএ/এইচএ/