ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ ফাল্গুন ১৪৩১, ০৬ মার্চ ২০২৫, ০৫ রমজান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

যুবক হয়ে উঠছে গ্যাংয়ের কিশোররা, ফ্যাসিস্টের অর্থায়নে বাড়ছে অপরাধ 

মিরাজ মাহবুব ইফতি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২২ ঘণ্টা, মার্চ ৪, ২০২৫
যুবক হয়ে উঠছে গ্যাংয়ের কিশোররা, ফ্যাসিস্টের অর্থায়নে বাড়ছে অপরাধ 

ঢাকা: রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আকস্মিকভাবে বেড়ে গেছে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন, যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধ কর্মকাণ্ড। অভিযোগ রয়েছে, পেশাদার কিছু অপরাধী এসব কর্মকাণ্ডের কিয়দাংশ করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রশ্রয়-উসকানি-অর্থায়ন রয়েছে।

অপরাধমূলক এসব কার্যকলাপে নাম আসছে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের। তাদের বেপরোয়া উৎপাত সমাজে তৈরি করছে অস্থিরতা, ছড়াচ্ছে আতঙ্ক।  

রাজধানীর উত্তরায় ২০১৭ সালে স্কুল শিক্ষার্থী আদনান খুনের ঘটনায় প্রথমবারের মতো ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে ‘কিশোর গ্যাং’ সংস্কৃতি। ‘রাতের ভোট’ আর ‘ডামি নির্বাচন’ আয়োজনে ‘কিশোর গ্যাং’ ব্যবহারের জন্য তাদের রাজনৈতিকভাবে প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি ছিল সবার জানা। যদিও একটা সময় এসব ‘কিশোর গ্যাং’ সেই প্রশ্রয়দাতাদেরই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। রাজধানীতে তাদের হাতে একের পর এক ঘটতে থাকে ছিনতাই, খুন, অপহরণসহ নানা অপরাধ।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পতন হলে কিছুদিন পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে অপরাধীরা। তারা কখনো ডাকাতরূপে, কখনো ছিনতাইকারীরূপে আবির্ভূত হয়। এই পরিস্থিতিতে তখন রাজধানীজুড়ে সতর্ক পাহারা বসায় ছাত্র-জনতা। সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতায় অপরাধ কর্মকাণ্ড খানিকটা কমে আসে। কিন্তু কিছুদিন ধরে আবার ছিনতাই, চুরির মতো ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায়ও অন্যান্য অপরাধ চক্রের সঙ্গে জড়াচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। কিছু ক্ষেত্রে তাদের উৎপাত সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে নগরবাসীর। এদের পেছনে বড় অপরাধী ও পলাতক আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রশ্রয়-উসকানি আছে বলে সরকারের সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নামে ‘কিশোর গ্যাং’ হলেও চক্রের ৮০ শতাংশ সদস্য কিশোর নন। তারা তরুণ। কিশোরদের নিয়ে তারা দল তৈরি করেন। আছে নিজস্ব অপরাধ চক্রও। স্থানীয় প্রভাবশালী, স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরা তাদের দিক-নির্দেশনা দেন। কাউকে খুন; কারও জমি দখল; কোনো ব্যক্তিকে পঙ্গু করে দিতে হলে এসব গ্যাং দিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকেন তারা। রাজনৈতিক নেতাসহ শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও এদের ইন্ধন দিয়ে থাকেন।  

‘কোড’ আছে কিশোর গ্যাংয়ের, চুলের ছাঁটও আলাদা
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের ৪০ শতাংশই কিশোর। দেশে বর্তমানে প্রায় আড়াইশর বেশি কিশোর-তরুণ গ্যাং রয়েছে। পাঁচ হাজারেরও বেশি সদস্য রয়েছে এসব গ্যাংয়ে। চক্রের সদস্যদের গড় বয়স ১৮ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। সঙ্গে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সীরা রয়েছে। প্রতিটি গ্যাং বা দলের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আছে চক্রের নাম, কোড, স্টাইল। চক্রের সদস্যরা নিজেদের জন্য চুলের ছাঁট বেছে নেয়, নিজস্ব ড্রেস কোড ব্যবহার করে। চালচলনেও তাদের রয়েছে আলাদা ভাব। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের স্কুলকলেজ পড়ুয়া বা ড্রপ আউট (ঝরে পড়া) ছাত্র এসব চক্রের সদস্য। আছে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ও লেখাপড়া না জানা কিশোর-তরুণরাও।

রাজধানীর বিশেষ কিছু অপরাধীও এসব কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ফলে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে গ্যাং সদস্যরা অপরাধীর তালিকায় চলে আসে। পার পেয়ে যায় মূল অপরাধী। পুলিশের কয়েকজন সদস্য জানিয়েছেন, ‘কিশোর গ্যাং’ শব্দটি মূলত অপরাধীদের তৈরি একটি টার্ম। সাংকেতিকভাবে এটি ব্যবহৃত হয়। কেননা, অপরাধীরা জেনে গেছে, কেউ কোনো অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের আদালতে তোলা হলে বিচারক যখন জানবেন এরা কিশোর, তাদের রিমান্ড নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়।

কিশোরদের ঢাল বানিয়ে কার্যসিদ্ধি করে বড় অপরাধীরা
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কয়েকজন সদস্য জানিয়েছেন, কিশোর-তরুণদের বখে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ মাদক। কোনো না কোনোভাবে এই শ্রেণিটি মাদকের সংস্পর্শে চলে আসে। নানা ধরনের মাদক গ্রহণ করতে করতে তাদের মানসিক পরিস্থিতি এতটাই বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে- যেকোনো ধরনের অপরাধ সংঘটনে তারা কোনো বাছ-বিচার করে না। কিশোরদের ঢাল বানিয়ে বড় বড় অপরাধীরা তাদের কার্যসিদ্ধি করছে। আবার যারা পারিবারিক বেখেয়ালির কারণে অপরাধে জড়ায় তারাও ছিনতাই, চাঁদাবাজি, হত্যা-ধর্ষণের মতো অপরাধ করছে। তারা গ্রেপ্তার হয়, কিন্তু ‘কিশোর’ ট্যাগ থাকা কোনো না কোনোভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। এভাবে সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি হচ্ছে।  

আইনজীবীরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। দীর্ঘদিন তারা কারাগারে থাকলেও অতীত ভুলে গেছেন বা অপরাধ থেকে সরে এসেছেন বলা কষ্টকর। কেননা, বর্তমানে যে ধরনের অপরাধ রাজধানীসহ সারা দেশে সংঘটিত হচ্ছে— পুরনো অনেক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে। এসব শীর্ষ সন্ত্রাসী নিজেদের ছত্রছায়ায় বখে যাওয়া কিশোর-তরুণদের নিয়ে আসছে অর্থ ও মাদকের প্রলোভন দেখিয়ে। তাদের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে তারা অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।  

অপরাধবিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি কিশোর অপরাধের মাত্রা যেভাবে বাড়ছে তা নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। কিশোর অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবস্থায় কিছুটা ঘাটতি আছে। এ ঘাটতি সমাজব্যবস্থায়ও রয়েছে। কিশোর অপরাধীদের শাস্তির চেয়ে সংশোধনের বিষয়ে গুরুত্ব বেশি দিতে হবে। কিশোর অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে অপরাধী প্রকৃত অর্থেই কিশোর কিনা নিশ্চিত হতে হবে। কিশোর গ্যাং কালচার নির্মূলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও অভিভাবকদের এগিয়ে আসতে হবে। এতে কিশোর অপরাধ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

ঢাকায় কিশোর অপরাধের সিংহভাগ ঘটে থাকে মোহাম্মদপুর এলাকায়। এ ছাড়া মিরপুর, বংশাল, লালবাগ, উত্তরা, গাজীপুরেও নানা আকারের কিশোর অপরাধ চক্র রয়েছে। মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকার আলিফ হাউজিং, শ্যামলী হাউজিং, শেখের টেক ও ঢাকা উদ্যান এলাকার সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে কিশোর গ্যাং জড়িত, এমন তথ্য রয়েছে পুলিশের হাতে। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প মাদকের স্বর্গরাজ্য। প্রতিনিয়ত এই এলাকায় বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয়। এ ছাড়া ধানমন্ডি, মিরপুরের বিহারি ক্যাম্প, কালশী বস্তি, পল্লবী ঝিলপাড়, রূপনগর; পুরান ঢাকার বংশাল, লালবাগে কিশোর অপরাধের প্রবণতা বেশি। পুলিশ জানিয়েছে, আদাবর, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের প্রায় তিন হাজার সদস্য রয়েছে।  

কিশোর গ্যাংয়ের নামের ধরন
রাজধানীর কিশোর গ্যাংগুলোর নানা ধরনের নাম রয়েছে। মোহাম্মদপুরে রয়েছে ডাইল্লা গ্রুপ, এলেক্স গ্রুপ, ইমন গ্রুপ, আনোয়ার ওরফে শুটার আনোয়ার গ্রুপ, আকাশ গ্রুপ, দ্য কিং অব লও ঠেলা গ্রুপ, ডায়মন্ড গ্রুপ, আই ডোন্ট কেয়ার (আইডিসি), মুরগি গ্রুপ, সাব্বির গ্রুপ, শাওন গ্রুপ, ফিল্ম ঝিরঝির, স্টার বন্ড, গ্রুপ টোয়েন্টি ফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, কোপাইয়া দে গ্রুপ।  

ধানমন্ডিতে আছে একে ৪৭, নাইন এম এম ও ফাইভ স্টার বন্ড। মিরপুর এলাকায় আছে সুমন গ্যাং, আশিক গ্যাং, পিচ্চি বাবু, বিহারি রাসেল, বিচ্চু বাহিনী, সাইফুল গ্যাং, বাবু রাজন, রিপন গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, নয়ন গ্যাং ও মোবারক গ্যাং।  

পুরান ঢাকার বংশালে রয়েছে জুম্মন গ্যাং, তেজগাঁওয়ে মাঈনুদ্দিন গ্যাং, মুগদায় চান জাদু, ডেভিড কিং ফল পার্টি, ভলিউম টু ও ভাণ্ডারি। শাঁখারীবাজার, কলতাবাজার, পানিটোলা, লালকুঠি, শ্যামবাজার, ইসলামপুর, বাবুবাজারসহ সদরঘাটের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ফেরদৌস গ্রুপ, সাজু গ্রুপ, সিনিয়র গ্রুপ, জুনিয়র গ্রুপ, টাইগার গ্রুপ, চিতা গ্রুপ নামে সক্রিয় কিশোর গ্যাং।

উত্তরা এলাকার গ্যাংগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইন স্টার, পাওয়ার বয়েজ, বিল বস, নাইন এম এম বয়েজ, সুজন ফাইটার, ক্যাসল বয়েজ, আলতাফ জিরো, ভাইপার ও তুফান গ্রুপ।  

সাম্প্রতিক আলোচিত ঘটনা
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে রাজধানীর উত্তরায় মোটরসাইকেল আরোহীকে কোপানোর ঘটনার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, কিশোর গ্যাংয়ের কয়েকজন সদস্য এক নারী ও পুরুষকে এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছে। ভুক্তভোগী নারী তার পুরুষ সঙ্গীকে রক্ষায় ঢাল হয়ে দাঁড়ান। ওই নারীর নাম নাসরিন আক্তার ইপ্তি। তিনি যাকে রক্ষার চেষ্টা করছিলেন তার নাম মেহেবুল হাসান। তিনি ৭ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাসার সামনে এক রিকশায় কিশোর গ্যাংয়ের বেপরোয়া গতির মোটরসাইকেলের ধাক্কার প্রতিবাদ করেছিলেন। পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে মো. আলফাজ মিয়া ওরফে শিশির, সজীব ও মেহেদী হাসান সাইফসহ আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।

একই দিন সন্ধ্যায় আদাবর থানার শেখেরটেক পিসিকালচার হাউজিংয়ের ১/১ নম্বর রোডে অস্ত্র হাতে কিশোর গ্যাংয়ের গণছিনতাইয়ের একটি ঘটনা ভাইরাল হয়। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, মুখে মাস্ক ও গায়ে কালো পোশাক পরিহিত ৮-১০ জন কিশোরের হাতে ধারালো চাপাতিসহ দেশীয় অস্ত্র। তারা প্রথমেই ১ নম্বর সড়কের পাশে একটি মোটরসাইকেলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চারজনকে টার্গেট করে তাদের ওপর অতর্কিত হামলা করে। হামলা থেকে দুজন দৌড়ে বাঁচলেও বাকি দুজনকে চাপাতির উল্টো পাশ দিয়ে মারধর করা হয়। অস্ত্রের মুখে দুজনের মোবাইল ফোন ও টাকাপয়সা কেড়ে নেওয়া হয়।

রাজধানীর ইস্কাটনের দিলু রোড এলাকায় ১৩ ফেব্রুয়ারি ভোর পৌনে ৫টার দিকে একটি মোটরসাইকেলে করে মাস্ক পরিহিত তিনজন যুবক এসে থামে। ঠিক কয়েক সেকেন্ড পর পেছন থেকে একটি রিকশায় করে আসছিলেন দুই যাত্রী। মুহূর্তেই তারা চাপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই যাত্রীর ওপর। প্রাণভয়ে রিকশা ফেলে দৌড় দেন চালক। যাত্রীদের কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে ফ্লাইওভারের নিচের ক্রসিং দিয়ে ইউটার্ন করে চলে যায় দুর্বৃত্তরা।  

এর আগে গত ৬ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর আদাবর ১৬ নম্বর রোডের একটি বাসায় লকার ভেঙে ৪৫ ভরি সোনা লুটের ঘটনা ঘটে। পুলিশ এ ঘটনায় দুই কিশোরকে আটক করে। এ ঘটনায় জড়িত আরও অনেক কিশোর-তরুণ এখনো আটক হয়নি। গত ১৬ জানুয়ারি রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় এক পথশিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে রায়হান নামের এক তরুণকে আটক করে পুলিশ।  

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে বনশ্রী ডি-ব্লক ৭ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাড়ির সামনে আনোয়ার হোসেন নামে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে স্বর্ণ ও টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়ায়। এতে দেখা যায়, আনোয়ারকে টার্গেট করে আসা তিনটি মোটরসাইকেল প্রথমে পথরোধ করে। এরপর তার কাছ থেকে স্বর্ণ নিতে টানা-হেঁচড়া করে। এক পর্যায়ে স্বর্ণ না দিতে চাইলে তারা ব্যবসায়ীকে গুলি করে। এরপর স্বর্ণ ও টাকা নিয়ে দুর্বৃত্তরা মোটরসাইকেলে উঠে এলাকা থেকে পালিয়ে যায়।

হটস্পট মোহাম্মদপুর
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে মোহাম্মদপুর এলাকায় কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের মহড়া, গণছিনতাইয়ের মতো ঘটনা বেশি ঘটেছে। গত ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মেহেদীবাগ, আদাবর বাজার এলাকায় দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় কিশোর-তরুণ গ্যাং সদস্যরা। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ দিয়েছে। পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানিয়েছে।  

মোহাম্মদপুরের স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ শুরু হয় কিশোর গ্যাং সদস্যদের উৎপাত। দিন নেই, রাত নেই তারা নানা অপরাধ করছে। প্রতিবাদ করতে হলে হামলা, লাঞ্ছনার মতো ঘটনা ঘটে। তাদের হাতে এমনসব অস্ত্র থাকে সন্ধ্যার পর বাইরে বের হতে ভয় লাগে।

আদাবর থানার (ওসি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম জাকারিয়ার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি জানান, আদাবর এলাকায় কিশোর গ্যাং রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অভিযান চলছে।  

মোহাম্মদপুর থানার (ওসি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলী ইফতেখার হাসান বাংলানিউজকে বলেন, মোহাম্মদপুর এলাকার কিশোররা এখন যুবক হয়ে গেছে। তারা কিশোর নেই। আমি সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার করি। সাধারণত আমি কিশোর গ্রেপ্তার করি না। দুয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও কিশোর আইনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জানুয়ারি মাসে বিভিন্ন অপরাধে ৪২৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। গত পাঁচ মাসে গ্রেপ্তার হয়েছে প্রায় ২০০০ অপরাধী।  

মোহাম্মদপুর এলাকায় কিশোর গ্যাং আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলে, কিশোররা যুবক হয়ে গেছে। ২০২৪ সালেও মোহাম্মদপুর এলাকায় ১০০-১৫০ জনের মহড়া দিত। গত পাঁচ মাসে সংখ্যা কমেছে। এখন মহড়া হলে ১০ থেকে ১২ জনের হয়। গ্রুপ ছোট হয়ে এসেছে। বর্তমানে মোহাম্মদপুর এলাকায় ৪ থেকে ৫ জনের গ্রুপে ছিনতাই করে।  

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত পাঁচ মাসে সারা দেশে প্রায় এক হাজার কিশোর-তরুণ অপরাধীচক্রের সদস্য আটক ও গ্রেপ্তার করা হয়। এখনো এই অপরাধীচক্রের কয়েক হাজার সদস্য নজরদারিতে রয়েছে। তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রতিনিয়ত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ মাসে ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন ১৬ জন। ডিএমপির হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসে ৮টি ডাকাতি, ৫৪টি ছিনতাই, ৩৬টি খুন এবং ১৪৬টি চুরির ঘটনা ঘটেছে।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় কত মামলা হয়েছে তার সঠিক তথ্য নেই। অনেক ক্ষেত্রে চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ নিয়ে যান না। ফলে শুধু মামলার পরিসংখ্যান দিয়ে অপরাধের প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না।  

অপরাধ চক্রের নেপথ্যে কারা?
আকস্মিক অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে নানা আলোচনা তৈরি হয়েছে নাগরিকদের মধ্যে। কেউ কেউ বলছেন, এসব ঘটনায় পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের লোকজনের ইন্ধন ও উসকানি আছে। কারণ এ সংক্রান্ত একটি অডিওবার্তা ফাঁস হয়েছে, যেখানে আওয়ামী লীগের নেতা গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্যে ঢাকা ও এর আশপাশের জেলার পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা এবং আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটানোর চক্রান্ত প্রকাশ পায়। তাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের কথা স্পষ্ট, যেই রাজধানীতে আমাদের মানুষ দিনে শান্তিপূর্ণভাবে ঘুরতে পারবে না, চলতে পারবে না। সেই রাজধানীর মানুষ রাতে ঘুমাতে পারবে না। আমাদের চূড়ান্ত ডিসিশন, যেই রাজধানীতে আমরা দিনে থাকতে পারব না, সেই রাজধানীর মানুষের ঘুম আল্লাহ দিবে না, আমরা সেইভাবে নিজেদের তৈরি করে নিয়েছি। ’

২৩ ফেব্রুয়ারি বনশ্রীতে ছিনতাইয়ের ঘটনার পর মধ্যরাতে বারিধারার ডিওএইচএসের বাসায় সংবাদ সম্মেলন ডাকেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি সেদিন বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে আওয়ামী লীগ কলকাঠি নাড়ছে বলে অভিযোগ করেন। উপদেষ্টা বলেন, ‘আওয়ামী দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করছে। যেহেতু তারা প্রচুর টাকা দেশ থেকে স্থানান্তরিত করেছে। ওই টাকা ব্যবহার করেই তারা দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করছে। এটা আমরা কোনো অবস্থাতেই করতে দেব না। যে ভাবেই হোক, এটা প্রতিহত করব। দিনে-রাতে যেখানে আমাদের বাহিনী প্রয়োজন হবে, সেখানেই যাবে। প্রতিহত করবে। ’

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ডিএমপি এলাকায় যেকোনো অপরাধ হলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। গ্রেপ্তার করছি। গ্যাং কালচারের তথ্য পেলে আমরা যাচাই-বাছাই করে নির্মূলে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের অভিযান চলমান।

পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) এনামুল হক সাগর বলেন, মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি। দ্রুতই কিশোর-তরুণদের অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে। তবে অপরাধীকে কোনো বয়সে চিহ্নিত না করে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করাই ভালো।

সম্প্রতি র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি এ কে এম শহিদুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, সব মেট্রোপলিটন শহর ও গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরগুলোয় যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফোর্স রিজার্ভ রাখা হয়েছে। এছাড়া সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাসহ যেকোনো ধরনের নাশকতা ও সহিংসতা প্রতিরোধে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য কর্তৃক খুন, হত্যাচেষ্টা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার এবং চাঞ্চল্যকর সৃষ্টিকারী বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়। এসব গ্রুপের সন্ত্রাসীরা নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে এক গ্রুপ অপর গ্রুপের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে মারামারি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে জখম করার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়।  

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, মোহাম্মদপুরের আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী কবজি কাটা গ্রুপের প্রধান মো. আনোয়ার ওরফে শুটার আনোয়ার ওরফে কবজি কাটা আনোয়ার, জেনেভা ক্যাম্পের শীর্ষ সন্ত্রাসী বুনিয়া সোহেল এবং জেনেভা ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক কারবারি সেলিম আশরাফি ওরফে চুয়া সেলিমসহ তাদের সহযোগীদেরকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, তরুণ-কিশোররাই সাধারণত অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। তারা চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির মতো অপরাধে জড়াচ্ছে। যদিও তারা এসব অপরাধে আগেও জড়িত ছিল। তবে বর্তমানে কৌশল পরিবর্তন করছে। কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবস্থায় ঘাটতি আছে। কিশোর অপরাধীদের ক্ষেত্রে শাস্তির চেয়ে সংশোধনের বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৮ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০২৫
এমএমআই/এমজে/এইচএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বাংলানিউজ স্পেশাল এর সর্বশেষ