ঢাকা: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের কাজ করছে। জনদাবি অনুসারে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে রাজনৈতিক শক্তির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরেরও আলাপ করছে তারা।
দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি চাচ্ছে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হোক। জামায়াতে ইসলামীও আগামী রমজানের আগেই নির্বাচন চায়। এছাড়া বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন করার দাবি তুলেছে। বামপন্থী দলগুলোও দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠকদের নিয়ে গঠিত নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) বলছে, ফ্যাসিবাদের নেত্রী শেখ হাসিনার বিচারসহ তাদের দাবি পূরণ হলে যে কোনো সময় নির্বাচনে তারা রাজি।
অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, নির্বাচন হবে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস থেকে শুরু করে অন্য উপদেষ্টাদের মুখেও এমনই কথা উঠে আসছে। যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিএনপি মনে করছে, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে আগস্টে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স প্রায় নয় মাস পার হতে চললেও এখনো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে জনমনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে এবং নানা প্রশ্ন উঠছে।
যদিও নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর চাহিদার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। কিন্তু সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না দেওয়ায় সরকারের কথায় আশ্বস্ত হতে পারছে না বিএনপিসহ অন্যরা।
নির্বাচন বিলম্বিত হলে ষড়যন্ত্রের সুযোগ পাবে পতিত ফ্যাসিবাদ
বিএনপি নেতাদের যুক্তি, রোডম্যাপ না দেওয়ায় নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নির্বাচন বিলম্বিত হলে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির শঙ্কা বাড়বে এবং রাষ্ট্র পতিত ফ্যাসিবাদের ষড়যন্ত্রের কবলে পড়বে। এ কারণে বিএনপি ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায়। জুনের মধ্যে নির্বাচনের যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, বিএনপি সেটাকে মনে করছে নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল। এ কারণে গত ১৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে দলটি আবারও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছে।
কিন্তু সরকারও আগের অবস্থান জানিয়েছে অর্থাৎ চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন হবে। এর ফলে নির্বাচন কবে হবে এ রকম একটা প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে এবং এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছে বিএনপি। এ কারণে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে সব দলের ঐকমত্য গড়ে তুলে সরকারের ওপর চাপ তৈরির চেষ্টা করছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনাও শুরু করেছে দলটি।
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ ঘোষণা না করায় নির্বাচনের সময় নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায়, নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, গত ১৫ বছর আমরা লড়াই-সংগ্রাম করেছি। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের অবসানের পর জনগণের প্রয়োজনেই নির্বাচন জরুরি। দেরিতে নির্বাচন হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা আরও তীব্র হবে, জনগণ হতাশ হবে।
তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের দিকে যাওয়ার অভিপ্রায় আমাদের ছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, গেল আট মাসে সংস্কার প্রক্রিয়া যেভাবে এগোনোর কথা ছিল, সেভাবে এগোয়নি। এটিকে দীর্ঘসূত্রিতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
ফেব্রুয়ারির পর থেকেই ছুটির ফাঁদ, আবহাওয়ার চ্যালেঞ্জ
রাষ্ট্রের নিয়মিত কার্যক্রম, ক্যালেন্ডার আর আবহাওয়ার গতিবিধি অনুসারে, চলতি বছরের ডিসেম্বরে যদি নির্বাচন না হয় তাহলে আগামী বছর নির্বাচন করতে গেলে বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।
আগামী বছরের রমজান শুরু হবে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে। চলবে মধ্য মার্চ পর্যন্ত। এরপর থাকবে ঈদুল ফিতরের ছুটি। এপ্রিলে এসএসসি পরীক্ষা হওয়ার কথা আছে। এই সময় নির্বাচন হলে পরীক্ষা পেছাতে হবে, যা স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যাহত করবে। এপ্রিলের পর মে মাসে আবার ঈদুল আজহা। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ঈদে কোরবানির পশুর হাটকেন্দ্রিক ব্যস্ততা, এরপরে ঈদের আনুষ্ঠানিকতা ও ছুটি থাকছে।
তাছাড়া এ সময় তীব্র গরম থাকে। জুন থেকে আবহাওয়া আরও খারাপ হতে থাকে, এরপর আছে বর্ষাকাল। আবহাওয়া আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে নভেম্বর-ডিসেম্বর সময় লেগে যাবে।
এসব চ্যালেঞ্জ বিশ্লেষণে বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন, নির্বাচন এতদিন বিলম্বিত হলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
রাজনৈতিক ঐক্যগড়ে সরকারের ওপর চাপ তৈরির চিন্তাভাবনা
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি করে আসছে। কিন্তু সরকার বিষয়টিকে বা বিএনপির দাবিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বলে নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন। বরং নির্বাচনের সঙ্গে সংস্কারের শর্ত জুড়ে দিচ্ছে সরকার। এতে নির্বাচন নিয়ে কালক্ষেপণের মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। এ কারণেই নির্বাচন নিয়ে দলটির শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এ আশঙ্কা থেকেই ডিসেম্বরে নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য গড়ে সরকারের ওপর চাপ তৈরির চিন্তাভাবনা করছে দলটি।
এই ইস্যুটি নিয়ে সমমনা বিভিন্ন দল, বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোসহ বিগত সরকারের বিরুদ্ধে যেসব দল আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে তারা। দ্রুতই এ প্রক্রিয়া শেষ হবে। এরই অংশ হিসেবে শনিবার (১৯ এপ্রিল) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলগুলোর সঙ্গে এ আলোচনা শুরু হয়েছে। এদিন ১২ দলীয় জোট ও এলডিপির সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে বিএনপি।
সংস্কার প্রশ্নে সরকার ও বিএনপির অবস্থান
দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকার যেসব সংস্কার কাজে হাত দিয়েছে, তাতে শুরু থেকে সমর্থন আছে বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোর। সরকার বলছে, রাজনৈতিক দলগুলো ছোট পরিসরে সংস্কার চাইলে নির্বাচন ডিসেম্বরে হতে পারে, তবে বৃহত্তর পরিসরে হলে আগামী বছরের জুনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর বিএনপিসহ দলগুলো নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষেই ভোট আয়োজনের কথা বলে আসছে। বিএনপির হাইকমান্ড বলছে, নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন তা দ্রুত করে ফেলা সম্ভব। ফলে নির্বাচনও দ্রুত করা সম্ভব। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচিত সরকার সংস্কারগুলো সম্পন্ন করবে।
বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা গত মঙ্গলবার গাইবান্ধায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ যত অপরাধ করেছে, আগামী ১০০ বছর ধরে বিচারকার্য চালিয়ে গেলেও তা শেষ হবে না। তাই সংস্কার আর বিচার শেষ করার চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, সব সমস্যার সমাধান অন্তর্বর্তী সরকার করতে পারবে না। সব সংস্কার করার সমর্থনও এ সরকারের নেই। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যে সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলো অতিদ্রুত শেষ করে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া, এটি অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০২৫
এসকে/টিএ/এইচএ/