‘পদ্মার ঢেউ রে —মোর শূন্য হৃদয়–পদ্ম নিয়ে যা, যা রে। ’ একসময় পদ্মানদী থেকে মাঝির কণ্ঠে এভাবেই ভেসে আসতো ভাটিয়ালি গানের সুর।
অথচ কী দিন ছিল এই পদ্মার আর তার পাড়ের বাসিন্দাদের। ‘১৯৮০ সাল থেকে আমার দাদায় এখানে নৌকা বাইত, এরপর আমার বাপ আর তারপর আমি, বাবা- দাদার লগে যখন নৌকা বাইতাম এই পদ্মা তখন পানিতে থৈ থৈ করতো, এখন তো মইরাই গেল কওয়া যায়’, আক্ষেপ আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন পদ্মাপাড়ের বাসিন্দা রাজশাহীর শ্রীরামপুরের মিলন মাঝি। তিনি অবশ্য এখন আর মাঝি নন, পরের জমিতে কাজ করেন, সেই আয়েই চলে সংসার।
পদ্মার এই হাল হয়েছে উজানে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের কারণে। পদ্মা ওপারে গঙ্গা বলে পরিচিত। আন্তর্জাতিক আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে গোপনে ও অতি চতুরতার মাধ্যমে বাঁধটি নির্মাণের পর গঙ্গার পানির ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ভারত সরকার। ফলে শুকনো মৌসুমে যখন পদ্মায় পানির প্রবাহ বেশি দরকার, তখন ওপাশে পানি আটকে দেওয়া হতে থাকে। তাতে নদীতে জাগতে থাকে চর, নষ্ট হতে থাকে স্রোতধারা। আবার প্রবল বর্ষণে ভারতে পানি বেড়ে গেলে আকস্মিক বাঁধের গেট খুলে দেওয়া হতে থাকে, তাতে নদীর ভাটি অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়, তৈরি হয় মানবিক বিপর্যয়।
বাংলাদেশের মানুষের পানির অধিকার বিনষ্টে এই ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সোচ্চার এদেশের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে নানা অঙ্গনের মানুষ। বাংলাদেশের স্বার্থ ও মানুষের মৌলিক অধিকারবিরোধী এই বাঁধের বিরুদ্ধে প্রথম বড়সড় আন্দোলন হয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে। ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লং মার্চ কর্মসূচির ডাক দেন তিনি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট হাই স্কুল মাঠে লং মার্চের সমাবেশ হয়, সেখানে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পদ্মা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দাবি করেন মওলানা ভাসানী। ওই আন্দোলন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলে। পদ্মা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের আন্দোলনের অংশ হিসেবে প্রতি বছরের ১৬ মে পালিত হয়ে আসছে ফারাক্কা দিবস।
ফারাক্কা বাঁধের কষাঘাতে যেভাবে শেষ হলো পদ্মা
ফারাক্কা বাঁধের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গায়। এই সমস্যার সূত্রপাত ঘটে ’৫০ দশকের গোড়ার দিকে। গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগের খবর জেনে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তাদের প্রতিবাদের উত্তরে ভারত ১৯৫২ সালে জানিয়েছিল যে, গঙ্গার বাঁধ নির্মাণ এখনো অনুসন্ধান পর্যায়েই রয়েছে। ১৯৬০ সালে ভারত প্রথম এ ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে বৈঠকে বসে। এ প্রক্রিয়া চলা অবস্থায়ই ১৯৬১-৬২ সালে ভারত গোপনে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে। এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পূর্বেই ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ করে ফেলে ভারত।
কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধের সব ফিডার ক্যানেল চালুর কথা বলে ভারত। যদিও ওই ৪১ দিন আর শেষ হয়নি, পেরিয়ে গেছে ৫০ বছর।
এই বাঁধই কাল হয়ে দাঁড়ায় পদ্মার জন্য। ভারত শুকনো মৌসুমে ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি তাদের অন্য ভূমিতে সরিয়ে নেওয়ার কারণে পাঁচ দশকে বাংলাদেশের পদ্মায় চর জেগেছে, শুকিয়ে মরে গেছে পদ্মার উৎস থেকে সৃষ্ট বেশকিছু নদ-নদী। বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে পড়েছে মারাত্মক প্রভাব। সেইসঙ্গে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতিও গুনে যেতে হচ্ছে বাংলাদেশ ও এর জনগণকে।
আবার বর্ষাকালে সেই ফারাক্কারই সব গেট খুলে দেওয়ার কারণে প্রায় প্রতিবছরই গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বন্যা ও ভাঙনের সমস্যা হয়ে পড়েছে নৈমিত্তিক বিষয়। এতেও প্রতি বছরে বিপুল সংখ্যক মানুষকে শিকার হতে হচ্ছে মানবিক ও আর্থিক ক্ষতির।
যেসব নদ-নদীর মৃত্যু ঘটিয়েছে ফারাক্কা
‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে’ গানের সুরের মতোই বাংলাদেশের পরিচয়ে আসে পদ্মা নদীর নাম। পদ্মা শুধু নিজেই নয়, একদা ছিল অনেক স্রোতস্বিণীরও উৎসধারা। কিন্তু এর উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে পদ্মার পানিপ্রবাহ তো কমেছেই, মরেছে অনেক শাখা নদীও।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গবেষণা সূত্র বলছে, চলতি বছর পদ্মানদীর প্রবাহ একেবারেই নেই। প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা এখন বালুচর। পদ্মার পানি এবার এতটাই কমে গেছে যে, নগরীর তালাইমারীর জাহাজঘাট এলাকায় মানুষ হেঁটেই পার হচ্ছে।
নদী ও পানি বিষয়ক নাগরিক সংগঠন রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন বলছিলেন, উজানে ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগের সময়ের তুলনায় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী পদ্মার পানি প্রবাহ কমে গেছে ৮০ শতাংশ।
তিনি জানান, এই বাঁধের কারণে যেসব নদীর ওপর সরাসরি প্রভাব পড়ছে তার মধ্যে পদ্মার প্রধান শাখা নদী গড়াই, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা দিয়ে প্রবাহিত মাথাভাঙ্গা; দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার খুলনা বিভাগের কুমার নদ ও কপোতাক্ষ নদ; চুয়াডাঙ্গা জেলার ভৈরব নদ, নবগঙ্গা নদী, রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার চন্দনা নদী, কুষ্টিয়ার হিসনা নদী, মানিকগঞ্জের কালিগঙ্গা নদী উল্লেখযোগ্য। এসব নদীর উপশাখাগুলোও মারা যাচ্ছে। নদ-নদীগুলো হারাচ্ছে নিজস্ব মোহনা।
পানি সংকটের কারণে পদ্মার যে শাখা নদীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত তার অন্যতম বড়াল। রাজশাহীর চারঘাটে বড়াল নদীর উৎসমুখ। এখন বড়ালের উৎসমুখে বিশাল চর জেগেছে, সেখানে পানির প্রবাহ নেই। পদ্মা থেকে রাজশাহী, নাটোর হয়ে বড়াল নদীর গতিপথ যমুনা পর্যন্ত বিস্তৃত।
পদ্মাপাড়ের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব জয়নাল মিয়া বাংলানিউজকে বলছিলেন, ‘একটা সময় ছিল যখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গিপুর থেকে নৌকা অথবা জাহাজে মালভর্তি করে সরাসরি রাজশাহীর গোদাগাড়ীর রেলবাজার বন্দরে আসতো। আবার রেলবাজার বন্দর থেকে মালামাল নিয়ে নৌকা ও জাহাজগুলো রওনা হতো ভারতের উদ্দেশ্যে। কিন্তু নদীর এই দূরবস্থার কারণে রেলবাজার বন্দরটি অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যায়। ’
পরিবেশ বিজ্ঞানী ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান বাংলানিউজকে বলেন, ‘পদ্মার এ অবস্থা চলমান থাকলে এক সময় পুরো নদীই বালুচরে পরিণত হবে। বাংলাদেশে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। যার লক্ষণ এরই মধ্যে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। আবহাওয়া, প্রকৃতি ও ঋতুবৈচিত্র্যে নেতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। শুষ্ক মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। ’
তিনি বলেন, ‘রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক এলাকায় এখন অগভীর নলকূপে এখন পানি ওঠে না। তাই সংকট উত্তরণে চুক্তি অনুযায়ী পদ্মায় পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জোর দিতে হবে। ’
চৌধুরী সারওয়ার জাহান এজন্য সরকারের যথাযথ ভূমিকাও কামনা করেন। তিনি আশা করেন, ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তি নবায়ন নিয়ে শিগগির বৈরিতা শেষ হবে। সারওয়ার জাহানের অভিমত, ‘শুধু কাগুজে ৩৫ হাজার কিউসেক পানিতে সন্তুষ্ট থাকলে হবে না। চুক্তি নবায়ন করা হলে পানি চাইতে হবে। যেন নদীতে সারা বছরই পানির প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে। ’
পানি চুক্তি কখনো মানেনি ভারত
ফারাক্কা বাঁধ চালু হয় রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ও আন্তর্জাতিক চাপে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একাধিক পানি চুক্তি করেছে বটে, কিন্তু তারা কোনোদিনই সেই চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশকে পানি দেয়নি।
বাংলাদেশের কোনো আহ্বানেই ভারত সাড়া দিচ্ছিল না বিধায় ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ফারাক্কার বিষয়টি উত্থাপন করেন। ফলে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হয় ভারত। এরই ফলে ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকায় ফারাক্কা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পাঁচ বছর মেয়াদী এ চুক্তিতে বাংলাদেশের ন্যূনতম পানি প্রাপ্তির জন্য ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ রাখা হয়।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপনের ফলে পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে যে অর্জন আসে পরে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে সমঝোতার মাধ্যমে সে অর্জনকে দুর্বল করে ফেলা হয়। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯২ সালের মে মাসে নয়াদিল্লিতে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের এক বৈঠকে গঙ্গা ও তিস্তাসহ অন্যান্য প্রধান নদীর পানি প্রবাহ বণ্টনের জন্য সমতাভিত্তিক ও দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা গ্রহণ করার ব্যাপারে উভয়পক্ষ সম্মত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, ফারাক্কায় গঙ্গার পানি প্রবাহ সমতার ভিত্তিতে বণ্টনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পানি সমস্যা এড়ানোর জন্য সব প্রচেষ্টা চালানো হবে।
কিন্তু পরে ভারতের পক্ষ থেকে এ চুক্তির ব্যাপারে আর কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। ফলে ১৯৯৩ সালের ১ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪৮তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার ভাষণে ফারাক্কা প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। ১৯৯৫ সালের মে মাসে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত সার্ক সম্মেলনে খালেদা জিয়া বিষয়টি আবারও উত্থাপন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। কিন্তু তাতেও কোনো ফল মেলেনি।
১৯৯৫ সালের ২৩ অক্টোবর জাতিসংঘের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ফারাক্কা প্রসঙ্গ পুনরায় তুলে ধরে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষ গঙ্গার পানির ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু ভারত একতরফাভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় তা অবর্ণনীয় দুর্দশায় পতিত হয়েছে। তিনি এই সংকট সমাধানের সহায়তা করার জন্য জাতিসংঘে সমবেত বিশ্ব নেতাদের নিকট এ আহ্বান জানান।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গঙ্গার পানি ইস্যু নিয়ে ৩০ বছরের একটি দীর্ঘমেয়াদী দুর্বল চুক্তি করেন। কিন্তু তিন মাসের মধ্যেই সে চুক্তি ভারত অকার্যকর করে দেয়। ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশ মাত্র ৬ হাজার ৪৫৭ কিউসেক পানি পায়, যা ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর সর্বনিম্ন প্রবাহ ছিল। অথচ চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের পানি পাওয়ার কথা ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক। চুক্তির শর্ত অনুসারে, ফারাক্কা পয়েন্টে সর্বনিম্ন ৭০ হাজার কিউসেক পানি থেকে বাংলাদেশকে ভারত ৫০ হাজার কিউসেকের সমানভাবে অর্ধেক (২৫ হাজার কিউসেক) দেওয়ার কথা এবং বাকি ২০ হাজার কিউসেক ৭ নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য ব্যবহার হওয়ার কথা।
১৯৭৭ সালের পানি চুক্তিতে ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ ছিল। কিন্তু হাসিনার স্বাক্ষরিত চুক্তিতে তা না থাকায় ভারত বাংলাদেশকে তার ন্যায্য হিস্যা দিতে বাধ্য ছিল না। এছাড়া চুক্তিটিতে আন্তর্জাতিক সালিশিতে যাওয়ারও কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। অথচ নেপালের সঙ্গে মহাকালী নদীর পানি চুক্তিতে ভারত আন্তর্জাতিক আর্বিট্রেশন মেনে নিয়েছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ফারাক্কা বাঁধের ভূমিকা
বাংলাদেশের সঙ্গে ৫৩টি নদী প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এর মধ্য বিভিন্ন জায়গায় নানা কারণে ৬৮টি বাঁধ দেওয়া হয়েছে। আর সবচাইতে বড় ও ক্ষতিকারক বাঁধই হচ্ছে ফারাক্কা।
পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলছিলেন, ‘এই বাঁধের কারণে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, আর এই নদী শুকানোর কারণে বাড়ছে তাপমাত্রাও। আগে নদীতে যখন পানির প্রবাহ ছিল, তখন তাপমাত্রাটা পানি শোষণ করে নিতো, আর এখন ধুধু বালুর কারণে তাপমাত্রা বালুর ওপর পড়ে। সেজন্য তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে বৈশ্বিক জলবায়ুতেও ফারাক্কাবাঁধ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ’
নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে বালু উত্তোলনের প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম-সম্পাদক ফরিদুল ইসলাম ফরিদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘নদীর মৃত্যু ঘটায় সেখানে বালু উত্তোলনের যে ব্যবসা হচ্ছে এতে করে প্রকৃতি আরেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বালু উত্তোলনে ড্রেজিংয়ের কারণে বায়ুদূষণ বাড়ছে। আর এটি জনস্বাস্থ্যও হুমকির মুখে ফেলছে। ’
উপকূলে লবণাক্ততা দুর্দশার অন্যতম কারণ ফারাক্কা
ফারাক্কা বাঁধের কারণে কেবল পদ্মার নিকটবর্তী জনপদই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছে দূরবর্তী উপকূল অঞ্চলও।
‘রিভারাইন পিপল’র মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, ‘জোয়ারের সময় সমুদ্রের লোনা পানি দেশের অভ্যন্তরভাগে প্রবেশ করলে নদীর পানি ঠেলে সেই লোনা পানিকে সমুদ্রে ফেরত পাঠায়। কিন্তু ফারাক্কার কারণে নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ছে। আর এই লোনা পানি এখন উপকূলে মরণ দশা সৃষ্টি করছে, কারণ হয়েছে উপকূলীয় মানুষের চোখের নোনাজলের। বাংলাদেশে সবচাইতে বেশি ভুক্তভোগী এখন এই উপকূলের মানুষরা। ’
তিনি বলেন, ‘লবণাক্ততা বাড়ায় মিষ্টি পানিনির্ভর সুন্দরবনে বৃক্ষের পরিমাণ কমছে, গাছে আগামরা রোগ দেখা যাচ্ছে। যার কারণ লবণাক্ত পানি, এতে সুন্দরী গাছও কমে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমায় পলি সুন্দরবনের ভেতরে জমা হচ্ছে। এছাড়া জোয়ারের পানি বনের ভেতরে প্রবেশ করতে বাধা পাচ্ছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এবং সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে বাংলাদেশের এই সেফগার্ড ধ্বংসের ঝুঁকিতে পড়বে, যা বাংলাদেশের ধ্বংস ডেকে আনবে। ’
কৃষিজ উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব
পদ্মা নদী বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিকাজে পানির যোগানদাতা। উজানে যখন ফারাক্কায় এই নদীর পানি আটকে রাখা হয় তখন বরেন্দ্র জনপদের মানুষ ভীষণ ক্ষতির মুখে পড়ে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সম্পাদক ফরিদুল ইসলাম ফরিদ বলছিলেন, ‘এ কারণে মাটির আর্দ্রতা কমে যাচ্ছে আর এটির প্রভাব ফসলি জমিতে পড়ছে। একই কারণে পদ্মার অববাহিকাতে বাড়ছে নদী ভাঙন প্রবণতা। আর নদী ভাঙনের কারণে কৃষক তার ফসলি জমিও হারাচ্ছে। এটি দেশের উৎপাদনেও প্রভাব ফেলছে। এছাড়া বাঁধের কারণে বন্যার পানি কমে যাওয়ায় মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে।
গবেষণা সংস্থা ‘চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ’র প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘যত বেশি দিন যাচ্ছে গ্রাউন্ডওয়াটার অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ পানি ততই কমে যাচ্ছে। এখন ৪০০ ফিট নিচেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রাউন্ডওয়াটার উত্তোলনের খরচ বাড়ায় ইরিগেশন খরচও বেড়ে গিয়েছে, যেটি কৃষকের ঘাড়ে বোঝা। সেজন্য আগে যারা ধান উৎপাদন করতো তারা এখন গম-যব উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। কেননা ধান উৎপাদনে বেশি পানির প্রয়োজন হয়। ’
বাংলার মানুষ হারিয়েছে পদ্মার ইলিশের স্বাদ
ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মায় পানি সংকটে ইলিশের প্রজননও ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। ফরিদুল ইসলাম ফরিদ বলছিলেন, ‘আগে পাশের বাড়িতে ইলিশ রান্না হলে সেই ঘ্রাণ আশপাশের বাড়ি পর্যন্ত চলে যেত, আর এখন ইলিশে নেই সেই ঘ্রাণ, সেই স্বাদ।
‘ইলিশ বাংলাদেশে যেভাবে আসার কথা সেটা ব্যাহত হচ্ছে। যে কারণে এখন আর পদ্মায় নেই বললেই চলে, বরং যমুনাতে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। তিস্তাতেও ইলিশ পাওয়া গিয়েছে। এ কারণে ইলিশের স্বাদ আর আগের মতো নেই’, বলেন তিনি।
হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য
ফারাক্কা বাঁধের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যেও। বিশেষ করে সুন্দরবনের প্রাণীদের ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ বাংলানিউজকে বলেন, ‘সুন্দরবনে যে মিঠা পানিটা গঙ্গা নদী থেকে আমরা পাওয়ার কথা তা কমে যাচ্ছে, যে কারণে এসব অঞ্চলে ক্রমশ লবণাক্ততা বেড়েই চলেছে। পদ্মার সঙ্গে সংযোগ নদীগুলো মরে গেছে, আর এর বিরূপ প্রভাব পূর্ব সুন্দরবনের তুলনায় পশ্চিমে দৃশ্যমান। এসব কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। ইতোমধ্যেই অনেক প্রাণী বিপন্ন হয়ে গিয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি আগের তুলনায় এখন সুন্দরবন বিশেষ করে কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা এলাকায় হরিণের সংখ্যা কমে গিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এটি লবণাক্ত জলের কারণে। হরিণের সঙ্গে আবার বাঘ কমে যাওয়া বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও যুক্ত। এসব এলাকায় নদীগুলোতে মৎস্য প্রজননেও প্রভাব পড়ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি রিভার ডলফিন এখন নেই বললেই চলে। ’
আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার পেতে যা করতে হবে
ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার পেতে আন্তর্জাতিক নদীর পানিপ্রবাহ সংক্রান্ত কনভেনশনে সই করার পরামর্শ দেন ‘চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ’র প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন।
তিনি বলেন, “ফারাক্কা বাঁধের ৮০টি গেটই কাজ করছে না। যেখানে নদী জীবন্ত সত্তা, তাই নদী বেঁচে থাকার জন্য পানি লাগে। জীবন্ত সত্তাকে বাদ দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, আর ‘ইটস ক্রাইম অ্যাগেইনস্ট নেচার, প্রকৃতিবিরোধী অপরাধ। আন্তর্জাতিক কোর্টের বিচার পেতে হলে আমাদের আগে আন্তর্জাতিক নদীর পানিপ্রবাহ সংক্রান্ত কনভেনশনে র্যাটিফাই করা উচিৎ, এটি কেন দশ মাসে এই সরকার করতে পারল না!’
ভারত, চীন, নেপালের সঙ্গে জিবিএম বেসিন কমিশন করা উচিৎ বলেও মনে করছেন তিনি। গঙ্গা পানি চুক্তির বড় দুর্বলতা এর কোনো ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ না থাকা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানে শুষ্ক মৌসুমে কতুটুকু পরিমাণ পানি পাব সেটি উল্লেখ নেই। চুক্তিতে ডাটা শেয়ারিংয়ে ম্যাকানিজম ছিল না, যে কারণে মনিটর করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া আরও বড় বিষয় হল, দুই পক্ষের অর্থাৎ চুক্তি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ হলে তা কার মাধ্যমে মীমাংসা হবে সেটির উল্লেখ নেই। ’
জাকির হোসেন বলেন, ‘নদীর প্রাকৃতিক যে ল বা নিয়ম এটার সঙ্গে রাষ্ট্রের আইনের কোনো মিল নেই। আর এই যে বাঁধ দিয়ে নদীকে মেরে ফেলা হচ্ছে, এটি প্রকৃতির ওপর অন্যায়, ক্রাইম, এটি ন্যাচার রাইটস হরণ করা। রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, ন্যায্যতার ভিত্তিতে না গিয়ে। ’
কত মাশুল গুনবে বাংলাদেশ?
জানা যায়, ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তির পর পদ্মার রাজশাহী অংশে পানিপ্রবাহের কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। তবে চুক্তি অনুযায়ী বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ মে পর্যন্ত পানিপ্রবাহ ৭০ হাজার কিউসেক অথবা তার নিচে হলে দুই দেশ সমান পানি পাওয়ার কথা। আর প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের নিচে নামলে উভয় দেশ আলোচনার মাধ্যমে পানি বণ্টন করবে। কিন্তু ভারত এ ক্ষেত্রে একতরফাভাবে পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশে পানির পরিমাণ কমেই চলেছে। ভারতের দীর্ঘ অনাগ্রহের কারণেই যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক আর নিয়মিত হয় না। হলেও তার ফল হয় শূন্য। ফলে এর মাশুল দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
এইচএ/