ঢাকা, শনিবার, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ৩১ মে ২০২৫, ০৩ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

হাঁটতে হয় নাক চেপে, বিষাক্ত জলাশয় হাতিরঝিল

পিংকি আক্তার, সিনিয়র রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:০২, মে ৩০, ২০২৫
হাঁটতে হয় নাক চেপে, বিষাক্ত জলাশয় হাতিরঝিল হাতিরঝিলের পানিতে দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ছবি: বাংলানিউজ

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে নির্মল বাতাসে প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার জায়গার বেশ অভাব। সেই অভাবের জায়গা কিছুটা হলেও পূরণ করছিল পানি আর সবুজে মেশা হাতিরঝিল।

রাজধানীর এই জলাশয়ের পানিতে দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। পানির দুর্গন্ধে আশপাশে টেকা দায়।

রাস্তার দুধারে সবুজ গাছের ছায়ায় দুদণ্ড শান্তি খুঁজতে অনেকেই ছুটে আসেন হাতির ঝিলে। ছুটির দিনে ঘুরতে আসেন পরিবারসহ। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর হাতিরঝিলের কৃত্রিম আলোর ঝলকানিও নগরের মানুষের কাছে অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র। তবে এখানে দর্শনার্থী, পথচারী কিংবা আশপাশের বাসিন্দা, সবারই চলাচল করতে হয় নাক চেপে।

৩০২ একর আয়তনের হাতিরঝিল এফডিসি থেকে গুলশান পর্যন্ত সংযুক্ত। এই জলাশয়ের পানি দুর্গন্ধমুক্ত রাখতে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ থাকলেও দায়িত্ব পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কারণে সেটি দৃশ্যমান নয়। ঝিলের পানি পরিষ্কার রাখতে দুই বছরের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেহজাবিন এন্টারপ্রাইজকে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অগ্রগতির তেমন কোনো প্রমাণ নেই।

মধুবাগ এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা শাওন আহমেদ। চলতি পথে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, এই হাতিরঝিলে আর প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার উপায় নেই। আগে রোজ সকালে বাচ্চাদের দিয়ে হাঁটতে বের হতাম। এখন এমনই অবস্থা, নিজের ঠিকানা না হলে আমি এই এলাকা ছেড়ে যেতাম। প্রকট দুর্গন্ধে হাতিরঝিল এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। এখানে বিশুদ্ধ বাতাস বা নির্মল পরিবেশ আর নেই।  

কথা হয় স্থানীয় রফিকুল নামে আরেকজনের সঙ্গে। তিনি বলেন, হাতিরঝিল প্রকল্পের শুরুর দিকে যখন ওয়াটার ট্যাক্সিতে চড়ে গন্তব্যে ফিরতাম, অন্যরকম একটা সতেজতা অনুভব হতো। আর এখন এই পথে চলাই অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে।

‘আগে বাচ্চারা সারা দিন এই লেকের পাশে বইসা খেলত। কিন্তু অহন এমন গন্ধ আর পচা পানি, পোলাপান আসতেই চায় না’, বলেন হাতিরঝিল এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী হাসনা।  

এই ঝিলের ধারেই ঝালমুড়ি বিক্রি করেন হাসান মিয়া। তিনি বলেন, আগের চেয়ে এখন মানুষ হাতিরঝিলে কম আসে। দূষণ আর দুর্গন্ধে এলাকাবাসীর পাশাপাশি আমরাও অস্বস্তিতে আছি।

২০১৩ সালে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় হাতিরঝিল প্রকল্প। তখন এর পানি বেশ পরিষ্কার ছিল ছিল। কিন্তু পরিশোধনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় পানির গুণগত মান খারাপ হতে হতে প্রকট আকার ধারণ করেছে। পয়োবর্জ্য, ময়লা, আবর্জনা ও ড্রেনের পানি ঢুকে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে ঝিলের পানি। বাতাসে ভাসছে উৎকট গন্ধ। আশপাশ ঘুরে এমনটি দেখেছেন এই প্রতিবেদক।  

হাতিরঝিল ঘুরে দেখা গেছে, ঝিলের প্রায় সব অংশ থেকেই পানির দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। পানিতে নানা বর্জ্য-পলিথিন-প্লাস্টিকের পাইপও ভাসতে দেখা গেছে। কারওয়ান বাজারের প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে বর্জ্যের মাত্রা এত বেশি যে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ থেকেও দুর্গন্ধ টের পাওয়া যায়।  

ঝিলে মৃত মাছও ভাসতে দেখা যায়। পানির ওপরে বর্জ্যের ওপর একটি পুরু স্তর তৈরি হয়েছে, যা ওয়াটার ট্যাক্সিতে চলার সময় স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। হাতির ঝিলের পানি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য হুমকি বলছেন পরিবেশবিদরা।

রাজউকের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রায় ৭০০টি নর্দমার পানি হাতিরঝিলের পানিতে মিশে যায়। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মানুষ আবর্জনা, পলিথিন এমনকি শিল্প বর্জ্য ফেলছে ঝিলের পানিতে। ফলে পানি দূষিত হচ্ছে। ময়লা-আবর্জনা পচে মিথেন গ্যাস সৃষ্টি হচ্ছে, আর সে কারণেই দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।  

রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) সাব্বির বিন তাহের বাংলানিউজকে বলেন, হাতিরঝিলের চারপাশে প্রায় ৬৮০টি নর্দমা গর্ত রয়েছে। প্রতি ছয় মাসে একবার সেগুলো পরিষ্কার করা হয়। কঠিন বর্জ্য গর্তের পেছনে জমা হয় এবং তারপরে লেকের পানিতে ভেসে যায়। রামপুরা এবং কাঁঠালবাগানে দুটি স্লুইস গেট রয়েছে, তবে বর্ষাকালে এগুলো খুলতে হয়, যার ফলে কঠিন বর্জ্য প্রবেশ করে।

তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর রক্ষণাবেক্ষণের বরাদ্দের বড় অংশই বিদ্যুৎ খাতে যায়। পানি পরিশোধনের জন্য বরাদ্দ রাসায়নিক প্রায় এক বছর আগে শেষ হয়ে যায়। ২০২১ সালের আগের অবশিষ্ট রাসায়নিক এখন অল্প পরিমাণে ব্যবহার করা হচ্ছে। বছরে মাত্র একবার।

২০২২ সালে হাতিরঝিল থেকে সংগৃহীত নমুনায় ক্ষতিকর রাসায়নিক পিএফওএ (পারফ্লুরোঅকটানোয়িক অ্যাসিড) এবং পিএফওএস (পারফ্লুরোঅকটেনসালফোনিক অ্যাসিড) উভয়ই ছিল, যা দীর্ঘমেয়াদি বিষাক্ততার জন্য দায়ী। পিএফওএসের স্তর পরামর্শমূলক স্তরের চেয়ে ১৮৫ গুণ বেশি মাত্রায় পাওয়া গেছে।

বিভিন্ন সময় গবেষণায় হাতিরঝিলে পানি দূষণের বিষয়টি উঠে এসেছে। কিন্তু এরপরও কেন এই পানি দূষণ রোধ করা যাচ্ছে না— এ নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেছে রাজউক কর্তৃপক্ষ। লেকের নির্বাহী তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) সাব্বির বিন তাহের জানান, হাতিরঝিল লেকে ময়লা এরইমধ্যে তিনটি বিলে মেহজাবিন এন্টারপ্রাইজকে ৫২ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।  

তবে বিল পরিশোধ করা হলেও ঠিকাদার কোম্পানি মেহজাবিনের কাজ দেখা যায়নি সরেজমিনে। হাতিরঝিলের পানি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে বসানো হয়েছে বেশ কয়েকটি স্পেশাল স্যুয়ারেজ ডাইভারশন স্ট্রাকচার (এসএসডিএস) স্ক্রিনিং মেশিন। এই মেশিন অপারেটর হিসেবে ১০ জন থাকার কথা। কিন্তু কাজ করছেন ছয়জন। তাদের বেতন দেওয়া হয় ১০ হাজার টাকা করে।  

এসএসডিএস-১ হোটেল সোনারগাঁও এলাকায় কাজ করেন জাহিদ হাসান ও গোলাপ। এসএসডিএস-২ মগবাজার সংলগ্ন এলাকায় কাজ করেন সেলিম। এসএসডিএস-৩ মধুবাগ এলাকায় কাজ করেন মামুন। এসএসডিএস-১০ নিকেতন এলাকায় কাজ করেন ওহিদ ও শহিদ।  

এ ছাড়া এসএসডিএস ম্যানুয়াল সাতটি মেশিন আছে, এগুলোর কাজের জন্য চারজন শ্রমিক থাকার কথা, যারা ম্যানুয়ালি কাজ করবেন, কিন্তু সরেজমিনে একজনকেও পাওয়া যায়নি। এমনকি অন্য অপারেটরদের কাছে জানতে চাইলে তারা জানান, ম্যানুয়াল মেশিনে কোনো কর্মচারীই নেই।

এসএসডিএসের সব বর্জ্য সরানোর শ্রমিক, গাড়ি ও লেবার নেই। সপ্তাহে দুই-একদিন কারওয়ান বাজার থেকে গাড়ি ভাড়া করে এবং দুই-তিনজন শ্রমিক ভাড়া নিয়ে কাজটি করা হয় বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী।  

শুরুতে জলাশয় পরিষ্কার করার জন্য চারজন ডুবুরি ছিলেন, যারা এখন আর নেই।  

এসব বিষয় জানতে চাইলে রাজউক প্রকৌশলী সাব্বির বিন তাহের তেমন কিছু জানাতে পারেননি। এমনকি সরেজমিনে পাওয়া কর্মচারীর সংখ্যার সঙ্গে তার দেওয়া সংখ্যার তথ্যেরও অমিল পাওয়া যায়।

কথা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেহজাবিন এন্টারপ্রাইজের মালিক জাকির হোসেনের সঙ্গে। নিজের অধীনে থাকা কর্মীর ছবি দেখে তিনি তার নামই বলতে পারেননি। এক পর্যায়ে তিনি সুপারভাইজারকে ফোন দিয়ে নাম জানতে চান। কাজের চিত্র সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলেও কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। তার কথা থেকেই স্পষ্ট হয়, কাজ নিলেও লেকের ময়লা পরিষ্কারে অগ্রগতি নেই।

বরাদ্দের খরচ কোথায় যায়, জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঠিকাদার কোম্পানির এক কর্মচারী বলেন, বিভিন্ন নামে টাকা তোলা হলেও নিজের সহকর্মীদের তিনি এখনো দেখেননি। অর্থাৎ বিভিন্ন কর্মচারীর নাম দিয়ে বিল তৈরি করে টাকা তোলা হয় ঠিকই, কিন্তু সেই পদে কোনো নিয়োগই নেই।  

রাজউক চেয়ার‌ম্যান রিয়াজুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, এসব দুর্নীতি-অনিয়ম তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের প্রতিবেদন অনুযায়ী দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

দূষণে কী ক্ষতি হচ্ছে
পরিবেশবিদ আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ৪০টি পিলারই সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে, যা হাতিরঝিল সংলগ্ন এলাকা। আর তাই সুয়ারেজ সিস্টেম ব্যাহত হচ্ছে। মাটি দিয়ে ঝিল ভরাটের কারণেও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে মাছ মরে ভেসে উঠছে।

এ ছাড়া ঝিলের সামগ্রিক জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে, যা শহরের প্রতিবেশ ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে, বলেন কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, ঝিলে নেই আগের মতো ব্যাঙ, সাপ। বিলীন হয়ে যাচ্ছে উপকারী ক্ষুদ্র পোকামাকড়ও, যা নগরের মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

পানি পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে যেটুকু বরাদ্দ রাখা হয়েছে, সেটুকুও যদি ঠিকঠাক কার্যকর করা হতো তাহলে হাতিরঝিলের পানির এই দুর্দশা হত না। আর নগরের মানুষও স্বস্তি পেত। বড় কথা, এই দুর্নীতির কারণে পরিবেশে যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, তা রাজধানীর মানুষের স্বাস্থ্যকে চরম ঝুঁকিতে ফেলছে, বলেন কামরুজ্জামান।

পিএ/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।