ঢাকা, শনিবার, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৭ জুন ২০২৫, ১০ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ-আহত-বেওয়ারিশদের প্রকৃত তালিকা হয়নি আজও

রেজাউল করিম রাজা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:২৩, জুন ৬, ২০২৫
জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ-আহত-বেওয়ারিশদের প্রকৃত তালিকা হয়নি আজও

ঢাকা: জুলাই অভ্যুত্থানের প্রায় ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও সরকার এখনও শহীদ ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারেনি। বিভিন্ন উৎস থেকে ভিন্ন ভিন্ন পরিসংখ্যান এলেও কোনো চূড়ান্ত হিসাব নেই।

শহীদদের মধ্যে অনেকেই বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়েছেন, কিন্তু তাদের শনাক্তে দৃশ্যমান কোনো সরকারি উদ্যোগ নেই। আহতদের তালিকা অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর, যার ফলে সরকারি সহায়তা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সহায়তা ও পুনর্বাসনে অসংখ্য অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও স্পষ্টতা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্ভুল ও চূড়ান্ত তালিকা ছাড়া এই শহীদদের সম্মান এবং ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ সহায়তা সম্ভব নয়।

এই আন্দোলনের সূচনা হয় গত বছরের ১৫ জুলাই। এরপর কয়েক সপ্তাহ জুড়ে ঢাকা থেকে শুরু করে সারাদেশে রাস্তায় নামে ছাত্র-জনতা। ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও সরকার চরম দমনপীড়নের পথ বেছে নেয়। আন্দোলনের সময় নিহত, নিখোঁজ কিংবা আহত ব্যক্তিদের একটি নিশ্চিত পরিসংখ্যানের অভাবে এখনও ধোঁয়াশা রয়ে গেছে— জনমনে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, কত মানুষ রাষ্ট্রীয় দমননীতির শিকার হয়েছেন? অভ্যুত্থানে শহীদ এবং আহতদের প্রকৃত সংখ্যা কত?

২০২৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আন্দোলনের সমন্বয়ক ও স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্যসচিব তারেকুল ইসলাম জানান, সরকারি ও বেসরকারি নানা উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে তারা ১ হাজার ৪২৩ জন শহীদের একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করতে পেরেছেন। আহতের সংখ্যা সেখানে দেখানো হয় ২২ হাজারের বেশি। ৫৮৭ জন অঙ্গহানি ঘটিয়েছেন, ৬৮৫ জন দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, এমনকি ৯২ জনের দুই চোখই নষ্ট হয়ে গেছে গুলিতে।

তিনি বলেন, এসব তথ্যে সংযোজন-বিয়োজন হবে। আমরা ভেরিফিকেশন ও ভ্যালিডেশনের কাজটি করছি। আমরা একটি সঠিক তালিকা প্রকাশ করতে সক্ষম হবো।

একই বছর ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি অডিটোরিয়ামে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটি ও নাগরিক কমিটির যৌথ প্রচেষ্টায় তৈরি তালিকায় ১ হাজার ৫৮১ জন শহীদের নাম পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন ৩১ হাজারের বেশি ছাত্র-জনতা। তবে এই তালিকা এখনো চূড়ান্ত নয়।

সরকারি নথিবদ্ধ তথ্য ও বেসরকারি সূত্রের পাশাপাশি অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, বিক্ষোভ চলাকালে এক হাজার ৪০০ জনের মতো মানুষ নিহত হয়ে থাকতে পারে। যাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবহৃত সামরিক রাইফেল এবং লোড করা শটগানের প্রাণঘাতী গুলিতে নিহত হন। আরও হাজার হাজার মানুষ গুরুতর আহত হয়েছেন। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী হতাহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নিহতদের মধ্যে প্রায় ১২–১৩ শতাংশ শিশু। পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী শিশুদের হত্যার লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।

অভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকা চূড়ান্ত করতে গত ডিসেম্বরে সরকার গঠন করে ‘গণঅভ্যুত্থান-সংক্রান্ত বিশেষ সেল’। গত বছরের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে আন্দোলনে নিহত বা নিখোঁজ, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু কিংবা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকে কোনোভাবে মারা গেছেন, এমন বাদ পড়াদের নাম তালিকাভুক্ত করার কথা গণঅভ্যুত্থান-সংক্রান্ত এই বিশেষ সেলের। ২১ ডিসেম্বর সেলটি তাদের প্রথম ধাপের খসড়া তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে শহীদ সংখ্যা ৮৫৮ জন এবং আহত ১১ হাজার ৫৫১ জন।

তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শহীদদের মধ্যে শিক্ষার্থী ছিলেন ১৯৯ জন, তবে ১৩৪ জনের কোনো পেশা উল্লেখ করা হয়নি। আহতদের মধ্যেও রয়েছে বহু সংকট—দৃষ্টি হারানো ১ হাজার ৩৪ জন, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন ২১ জন। তালিকার বাইরেও অনেকের নাম বাদ পড়ে গেছে। আহতদের মধ্যে অনেকে একমাত্র উপার্জনক্ষম হওয়ায় অভাব-অনটন দেখা দিয়েছে তাদের পরিবারে।

এরপর, ১৫ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রথম গেজেট প্রকাশ করে, যেখানে ৮৩৪ জন শহীদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। মার্চের ৪ ও ৫ তারিখে তারা আহতদের তিন ক্যাটাগরিতে শ্রেণিবিন্যাস করে দ্বিতীয় গেজেট প্রকাশ করে: ক (অতি গুরুতর), খ (গুরুতর), গ (আহত)। বিভাগভিত্তিক হিসেবেও সেখানে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়। তবে এই ক্যাটাগরি ভিত্তিক তালিকা নিয়েও অভিযোগ রয়েছে আহতদের।

দ্বিতীয় গেজেটের ‘ক’ শ্রেণিতে অতি গুরুতর আহতের তালিকায় আছেন মোট ৪৯৩ জন; ‘খ’ শ্রেণিতে গুরুতর আহত আছেন ৯০৮ জন; ‘গ’ শ্রেণিতে আহতদের তালিকায় আছেন ঢাকা বিভাগে ৩,০৯৮, চট্টগ্রাম বিভাগে ১,৯২৭, খুলনায় ১,১৯৫, বরিশালে ৭৭২, রংপুরে ১,৩১৫, রাজশাহীতে ১,০৯১, ময়মনসিংহে ৫৩৪ ও সিলেটে ৭০৮ জন।

অভ্যুত্থানের পর আন্দোলনে নিহতদের পরিবারকে সহায়তা, আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর সরকার গঠন করে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’। ফাউন্ডেশনের একটি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৫ হাজার ৪৩৭ জন আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা সহায়তা বাবদ দেওয়া হয়েছে ৫৪ কোটি ৭১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। ৮৫২ জন শহীদ পরিবারের মধ্যে ৭৫৯ জনকে পাঁচ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে, মোট ৩৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ১০১ কোটি টাকার বেশি সহায়তা পৌঁছেছে মাত্র ৬ হাজার ১৯৬ জনের হাতে।

তবে সহায়তা কার্যক্রম এখনও আংশিকই রয়ে গেছে— এমনটাই দাবি করছেন আহতরা। হাসপাতালের শয্যায় থাকা অনেকেই জানাচ্ছেন, সুচিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের অনিশ্চয়তা তাদের ভবিষ্যৎকে ধোঁয়াশায় ঠেলে দিয়েছে। কেউ কেউ একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন পরিবারে, আজ তারাই পরিবারের বোঝা।

পূর্ণাঙ্গ তালিকা না হওয়ায় সহায়তা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসাইন বলেন, তালিকা বলতে একটা হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) ভ্যারিফায়েড, আরেকটা গেজেটভুক্ত তালিকা। গেজেটভুক্ত নয় কিন্তু এমআইএস ভ্যারিফায়েড রয়েছে— এই সংখ্যাও মোটামুটি অনেক। আমরা অভ্যুত্থান সেলের সঙ্গে যখন এই বিষয়ে কথা বলেছি, তখন সেল থেকে বলা হয়েছে, পরবর্তী গেজেটে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। নতুন করে যাদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাদেরকেও পরবর্তী গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

কবে নাগাদ পূর্ণাঙ্গ তালিকা হবে জানতে চাইলে গণঅভ্যুত্থান-সংক্রান্ত বিশেষ সেলের দলনেতা (যুগ্মসচিব) মো. মশিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আমরা তালিকাটি খুব দ্রুত শেষ করতে চাই। এখানে কিছু জাতীয় সিদ্ধান্তের বিষয় আছে। শহীদের তালিকার একটি গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। এতে ৮৩৪ জন শহীদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। এর সঙ্গে কিছু সংযোজন-বিয়োজন হবে। শহীদ তালিকায় আপত্তি খুবই সামান্য, এটা ৮৫০ জনের মধ্যেই থাকবে আশা করি।

আহতদের তালিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আহতদের তালিকার বেশ বড় সংকট আছে। ক, খ এবং গ এই তিন ক্যাটাগরি করা হয়েছে, এখনও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস-এ ওই সময়েরই দুই হাজারের বেশি পেন্ডিং আছে। এটা কীভাবে সুরাহা হবে, সেই সিদ্ধান্ত হয়নি।

তিনি আরও বলেন, গত ৩১ জানুয়ারি এমআইএসে অন্তর্ভুক্তির শেষ তারিখ ছিল। এখনও অনেকে আমাদের কাছে এসে বলছে, ‘আন্দোলনে ছিলাম, আহত হয়েছি’। সরকার চায় না যেন মুক্তিযুদ্ধের মতো ৫৪ বছর ধরে যাচাই-বাছাই চলে। যখনই হোক, নির্ভুল এবং পূর্ণাঙ্গ তালিকা যেন আমরা পাই।

বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা শহীদদের শনাক্তে কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের প্রয়োজন আছে। যদি প্রকৃত শহীদ হন, তিনি বেওয়ারিশ হিসেবে থাকবেন—এটা তো হতে পারে না। তাড়াতাড়ি এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখনও কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ শুরু হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহীদ ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ছাড়া সঠিক সহায়তা কার্যক্রম গড়ে তোলা অসম্ভব। পাশাপাশি, রাষ্ট্র যদি ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ যথার্থ মর্যাদা না দেয়, তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ হয়তো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস পাবে না।

তারা আরও বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের চূড়ান্ত তালিকা না হওয়ায় আর্থিক সহায়তা, উন্নত চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে—এমন অনেক অভিযোগ উঠেছে। চূড়ান্ত ও সঠিক তালিকা হলে অভ্যুত্থানে শহীদ এবং আহতদের সার্বিক সহায়তা কার্যক্রমে গতি ফিরবে। একই সঙ্গে দেশবাসীও শহীদ ও আহতদের প্রকৃত সংখ্যা জানতে পারবে।

আরকেআর/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।