ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২, ০৮ জুলাই ২০২৫, ১২ মহররম ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

কেন জাতীয় পার্টিতে ভাঙন?

সাগর আনোয়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২:০৪, জুলাই ৮, ২০২৫
কেন জাতীয় পার্টিতে ভাঙন?

একদিকে নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে, আর অন্যদিকে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) বাজছে ভাঙনের সুর। দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে বহিষ্কারের পর অনেকেই মনে করছেন, দলটির ভাঙন এখন অনেকটাই চূড়ান্ত।

বহিষ্কৃত নেতারা দলের ভাঙনের দায় চাপাচ্ছেন দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ওপর। সদ্য বহিষ্কৃত নেতা আনিসুল ইসলাম বলেন, আমরা ভাঙন চাইনি, জি এম কাদেরই দলকে ভাঙনের দিকে ঠেলে দিলেন।

আর বহিষ্কৃত নেতা এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, জি এম কাদের আত্মঘাতী একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি নিজেই একা হয়ে গেলেন।  

তিনি বলেন, আগামীকাল পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ গুলশানের হাওলাদার কমপ্লেক্সে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করবেন, যেখানে তিনি সবকিছু বিস্তারিত তুলে ধরবেন।

এর আগে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের দাবি করেছিলেন, একটি বড় দলের সহযোগিতায় জাতীয় পার্টিকে ভাঙার ষড়যন্ত্র চলছে।  

তিনি বলেন, তারা নির্বাচনে দুই-চারটি আসনের জন্য দলের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এবং কর্মীদের বিভ্রান্ত করছে। সেই দল জানে, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ না নিলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না।

কথা হলে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সোমবার রাতে বাংলানিউজকে বলেন, আসলে জি এম কাদের দলের মনোনয়ন ফর্ম বিক্রির কয়েক কোটি টাকা নিজের কাছে রেখেছেন। মহিলা এমপিদের দেওয়া ডোনেশনের টাকাও নিজের কাছে রেখেছেন। আমরা যখন এসবের হিসাব চাচ্ছি, তখন তিনি অবান্তর কথা বলছেন। সামনে আরও অনেক কিছু বলব। একটু অপেক্ষা করুন।  

তিনি আরও বলেন, পার্টির কাউন্সিলের তারিখ নির্ধারিত হওয়ার পর কাউকে ইনক্লুড বা এক্সক্লুড করার সুযোগ নেই। কাউন্সিলের আগে পার্টির চেয়ারম্যান মহাসচিবকে বহিষ্কার করতে পারেন না, আমাদেরও বহিষ্কার করতে পারেন না। এটি অ-গঠনতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক সিদ্ধান্ত। চুন্নু এখনও পার্টির মহাসচিব, আমি এবং রুহুল আমিন হাওলাদার এখনও কো-চেয়ারম্যান।

দলের চেয়ারম্যানের এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আইনের আশ্রয় নেব। ওই লোক (জি এম কাদের) পার্টির চেয়ারম্যান থাকার যোগ্য নন। যে লোক ভারত থেকে এসে বলেন, ভারতের অনুমতি ছাড়া কিছু বলব না, তার এই দলের প্রধান থাকার কোনো অধিকারই নেই।

জাতীয় পার্টির বিগত ২৫ বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি নির্বাচনের আগে সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া দলটি একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়েছে। তবে এবার বিভক্তির ধরন কিছুটা ভিন্ন।  

বহিষ্কৃত কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার দাবি করেছেন, দলটির বড় একটি অংশ জি এম কাদেরকে বাদ দিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জাতীয় পার্টি সবসময়ই জনগণের মতামতকে সম্মান করে। আমরা সবসময়ই নির্বাচনমুখী দল।  

তিনি বলেন, আমরা জাতীয় পার্টিকে ভালোবাসি। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের মায়ের হাতে আমি ভাত খেয়েছি, তাই এই পার্টি আমরা ছাড়তে পারি না। আমরা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এই পার্টি থেকেই নির্বাচনে অংশ নেব।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, আমরা যখন পার্টিকে সু-সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলাম, তখন তিনি (জি এম কাদের) এমন সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি চান না সবাই পার্টিতে আসুক। তিনি নিজের খেয়ালখুশি মতো যাকে খুশি দলে নিচ্ছেন, আবার বহিষ্কার করছেন।  

তিনি বলেন, এসব গণতান্ত্রিক দলে চলতে পারে না। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে যে পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেখানে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি, তাহলে দেশের জন্য অনেক কিছু করার সুযোগ আছে।

তাহলে কি জি এম কাদেরকে বাদ দিয়েই নির্বাচন করবেন? জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন তো অনেক দূরে। আসলেই ওই লোকের এই দলে থাকার যোগ্যতা নেই। হি ইজ টোটালি আনফিট ফর দিস পার্টি।  

জানা গেছে, ১৪ জুলাই জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বড় ধরনের শো-ডাউন করতে যাচ্ছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর নেতৃত্বাধীন অংশ।  

গুলশানের একটি কমিউনিটি সেন্টারে স্মরণসভা আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত ও দলত্যাগী নেতাদেরও এই সভায় আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।

দলটির দুই-তৃতীয়াংশ প্রেসিডিয়াম সদস্য, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা এবং ঢাকা মহানগরের অধিকাংশ নেতাই এই অংশে শামিল হচ্ছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে জি এম কাদেরকে ত্যাগ করা ঢাকা মহানগর জাতীয় পার্টির নেতা কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, শফিকুল ইসলাম সেন্টুসহ অন্যান্য নেতারাও তাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন।

দলের এই ভাঙন প্রসঙ্গে জি এম কাদের অংশের প্রেসিডিয়ামের এক নেতা বাংলানিউজকে বলেন, সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে, এমন মডারেট ইসলামপন্থী একটি দলের এক নেতা জি এম কাদেরকে বিএনপি-বিরোধী জোটে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আসন ও নেতৃত্বের ভারসাম্য ঠিক না থাকায় জি এম কাদের কিছুটা পিছুটান দেন এবং সময় নেন।  

কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, জি এম কাদের এখনও নিশ্চিত নন আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি না। বিষয়টি জানাজানি হলে ২০২৪ সালের আওয়ামী লীগের সঙ্গে মনোনয়ন সংক্রান্ত দেন-দরবারের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতেই আনিস-হাওলাদার-চুন্নু গোষ্ঠী তার একক ক্ষমতা কমানোর পরিকল্পনা নেন। কারণ, ২০ (১) ক ধারা বহাল থাকলে যেকোনো সময় জি এম কাদের যাকে খুশি বহিষ্কার করতে পারেন।  

এই নেতা আরও দাবি করেন, জোট গঠনের উদ্যোগে যুক্ত মডারেট ইসলামপন্থী ও সরকারের ঘনিষ্ঠ নেতারা জাতীয় পার্টির সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। তাদের ধারণা, রংপুরে জাতীয় পার্টির শক্ত অবস্থান এখনও রয়েছে। কিন্তু জি এম কাদের মনে করছেন, নির্বাচন নাও হতে পারে বা বিলম্বিত হতে পারে।  

তিনি বলেন, জি এম কাদের তাদের বিশ্বাসও করতে পারছেন না। এ অবস্থায় জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে নিতে এবং আসন সমঝোতার জন্য সামনে আনা হয়েছে আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে। দলে নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেই জি এম কাদের বহিষ্কার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।

নির্বাচনী জোট প্রসঙ্গে এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, আমরা তো জি এম কাদেরকে সঙ্গেই রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি এমন এক সিদ্ধান্ত নিলেন যা আমাদের সংগঠনকে অস্থিতিশীল করে দিল। এখন আমাদের পুনর্গঠিত হতে কিছুটা সময় লাগবে। আমরা আপনাদের জানাব।

এ বিষয়ে জি এম কাদের নিযুক্ত নতুন মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী বাংলানিউজকে বলেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। কিন্তু তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থেকে সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করেছেন।  

তিনি বলেন, যারা পার্টির গঠনতন্ত্র নিয়ে কথা বলছেন, তারা তো ফোরামেই বলতে পারতেন। গণমাধ্যমে কিংবা নেতা-কর্মীদের নিয়ে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কথা বলা গণতান্ত্রিক আচরণ হতে পারে না।  

দলে ভাঙন ঘটছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্নজন বিভিন্ন নামে সভা-সমাবেশ করতেই পারে। আমরা তো কাউকে বাধা দিতে পারি না।

জি এম কাদের আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবকিছু বিবেচনা করে, আন্তর্জাতিক চাপ, সবার সমান সুযোগ তৈরি হলে তখন বিষয়টি দেখা যাবে। এখনই নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানোর সময় আসেনি। আমরা এখন সারা দেশে পার্টির নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করার কাজ করছি।

এ বিষয়ে সদ্য বহিষ্কৃত মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বাংলানিউজকে বলেন, আমরা চেয়ারম্যানকে বলেছিলাম, আপনি ২০ (১) ক ধারা সংশোধন করুন, তাহলে আমরা আপনার সঙ্গে আছি। না হলে আমরা আপনার সঙ্গে থাকব না।

জি এম কাদেরকে বাদ দিয়ে জাতীয় পার্টি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে—এ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা যারা বলেন, তারাই বলতে পারবেন। আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না।

জি এম কাদের অংশের প্রেসিডিয়ামের একাধিক নেতা জানান, আরও প্রায় ১০ জনের বহিষ্কারের চিঠি প্রস্তুত রয়েছে। যেকোনো সময় তাদের বহিষ্কার করা হতে পারে।

এর আগে চলতি বছরের ২০ মে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে ২৮ জুন দলটির কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত হয়। সম্মেলনের জন্য মিলনায়তন না পাওয়ার কথা উল্লেখ করে ১৬ জুন জি এম কাদের সম্মেলন স্থগিত করেন। ওই কাউন্সিলে চেয়ারম্যান ও মহাসচিব প্রার্থী ছিলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার।

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।