ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

গ্রামবাসীর প্রতিবাদ

মহুয়ার ধর্ষকের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়নি কেউ

জেসমিন পাঁপড়ি ও সুলতানা ইয়াসমিন মিলি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৩
মহুয়ার ধর্ষকের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়নি কেউ

সিরাজগঞ্জ থেকে ফিরে: পালা গান শুনে নদের চাঁদের মহুয়া সুন্দরীর নামে মেয়ের নাম রেখেছিলেন বাবা আব্দুল মমিন। তেমনি শান্ত স্বভাবের মিষ্টি হয়েছিল মহুয়া (৮)।

আর এমন স্বভাবের জন্য সে ছিল গ্রামের সকলের প্রিয়।

মায়ের ছোট সন্তান হওয়ায় এ বয়সেও চুরি করে মায়ের বুকের দুধ খেত মহুয়া। একমাত্র মেয়েকে কিছুতেই বাধা দিতে পারতেন না মা জেবুন্নেছা। মহুয়ার এ ছেলেমানুষি গ্রামের সবাই জানত। সবাই ধরে নিয়েছিল মেয়েটা এখনো বয়সের তুলনায় কিছুটা অবুঝ।

আর তাই অবুঝ, ছেলেমানুষ, দুধের শিশুটার এমন নির্মম মৃত্যু মেনে নিতে পারে নি গ্রামের কোনো মানুষই। মহুয়ার পক্ষে তাই অনেকে সাক্ষ্য দিলেও  আসামি শাহেদুলের (একই গ্রামের) পক্ষে কেউ সাফাই সাক্ষ্য দিতে রাজি হয় নি। ফলে আসামিপক্ষ আদালতে কোনো সাক্ষী উপস্থাপন করতে পারে নি।

এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবু ছিদ্দিক খান বলেন, “মহুয়া আমার স্কুলের ছাত্রী ছিল। খুব মিষ্টি মেয়ে ছিল সে। ছাত্রীও ভালো ছিল। ছোট্ট মেয়েটার এমন পরিণতি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। সেদিনের কথা ভাবলে এখনও গা শিউরে ওঠে। ”

তিনি বলেন, “শাহেদুল বখাটে ছেলে। মাঝে মাঝে তাঁতের কাজ করত শুনেছি। তবে বেশিরভাগ সময় দলবল নিয়ে চলা ফেরা করত। ”

মহুয়া হত্যামামলার রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তিনি বলেন, “মহুয়ার প্রতি যে অন্যায় শাহেদুল করেছে তার উপযুক্ত বিচার হয়েছে। এ জাতীয় কর্মকাণ্ডে এ বয়সের ছেলেরা বেশি জড়িত। এ ধরনের সাজা না হলে সামাজিক অপরাধ আরো বাড়বে। মহুয়া হত্যামামলার রায় কার্যকর করলে অপরাধীরা এমন নৃশংস কর্মকাণ্ড করতে ভয় পাবে। ”

এ গ্রামের এক দোকানদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “সবাই আমদের প্রতিবেশী। মেয়েটার জন্যও কষ্ট হয়, আবার ছেলেটার ফাঁসির খবরেও খারাপ লাগে। কিন্তু অপরাধ করলে শাস্তি পাবে এটাই স্বাভাবিক। মেয়েটার কথা ভাবলে শাহেদুলের পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো শক্তি পাই না। ”

তবে ছেলের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে দিয়ে শাহেদুলের মা আনিছা বেগম বলেন, “আমার ছেলে নির্দোষ। সে কোনো অন্যায় করে নি। তাকে জোর করে ফাঁসানো হয়েছে। ”

চালাকি করে তার ছেলের পক্ষে কোনো সাক্ষী নিতে দেওয়া হয়নি অভিযোগ করে তিনি বলেন, “পুলিশ কাক কয়, সাংবাদিক কাক কয় আমরা বুঝতাম না। সেই সুযোগে ওরা আমাগো পক্ষে সাক্ষী নিতে দেয় নি। তাছাড়া আমরা কামলা মানুষ টাকা দিতে পারি নি বলেই সাক্ষী পাই নি। ”

তবে আনিছা বেগমের এমন অভিযোগ পাত্তা না দিয়ে মহুয়ার চাচা ইবনুল হাসান খান বলেন, “তাদের এমন অভিযোগ সত্য নয়। এখানে টাকার কোনো প্রশ্ন নেই। আমরা আইনের আশ্রয় নিয়েছি। তাছাড়া গ্রামবাসী যেমন রক্তাক্ত মহুয়ার নিথর দেহ দেখেছে, তেমনি  কাদা পায়ে তারা ঘর থেকে শাহেদুলকে ধরে নিয়ে এসেছে। আর গ্রামবাসীর কাছেই সে অপরাধ স্বীকার করে মাফ চেয়েছে বারবার। এত কিছুর পর কোনো বিবেকবান লোক আসামির পক্ষে সাফাই দেবে না এটাই স্বাভাবিক। ”

ছেলের অপরাধের কথা স্বীকার না করলেও তার বিষয়ে মা আনিছা আরো বলেন, “ছেলেরে স্কুলে পাঠালেও সেখানে সে থাকত না। এজন্য তার বাপের সঙ্গে মাঠে পাঠাতাম। কিন্তু সে কাজে মন দেয়নি শাহেদুল। সঙ্গ দোষে খানিকটা খারাপ হয়ে যায় সে। ”

সাফাই সাক্ষীর ব্যাপারে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামসুল হক বাংলানিউজকে বলেন, “আমাদের পক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষি ছিল না, একথা সত্য। ”

কেন ছিল না এমন প্রশের জবাবে তিনি বলেন, “সব সময় সাফাই সাক্ষী দিলে উপকার পাওয়া যায় এমন নয়।   অনেক ক্ষেত্রে সাফাই সাক্ষীর কারণে মামলা নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়। কারণ, সাক্ষ্য দেওয়ার পর তাদের আবার জেরার সম্মুখীন হতে হয়। ”

এক্ষেত্রে বাদীপক্ষের শক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ ছিল দাবি করে সিরাজগঞ্জ নারী শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের এপিপি অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন বলেন, “এ মামলার ডিফেন্সে অনেক বড় অ্যাডভোকেট থাকলেও আমাদের হাতে প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিল। মহুয়াকে শাহেদুল ডেকে নিয়ে যাচ্ছে তা দেখেছে এমন দুইজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাছাড়া মেডিকেল রিপোর্টে দেখা যায় শিশুটিকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। ”

তিনি বলেন, “আসামিপক্ষ কোনো সাক্ষী উপস্থাপন করতে পারে নি। অর্থাৎ এলাকার মানুষ এমন ঘৃণ্য কাজে সমর্থন  দেয় নি। দেশের সব অঞ্চলের মানুষকে এমন প্রতিবাদী হয়ে উঠতে হবে। তাহলেই দেশে এমন অপরাধ কমে আসবে। ”

তিনি  আরো বলেন, “প্রসিকিউটর হিসেবে মামলার রায়ে আমরা খুব সার্থক। এ ঘটনার বিচার এ অঞ্চল শুধু নয় সারা দেশে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ”

জানা যায়, এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে আসামিপক্ষ। ইতিমধ্যে সিরাজগঞ্জ আদালত থেকে মামলার সকল নথি ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

তবে আপিল বিভাগের রায়েও এ শাস্তি বহাল থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন অ্যাডভোকেট দেলোয়ার।

মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে ধর্ষক শাহেদুল একটি মোবাইলফোনের লোভে মহুয়াকে ফুঁসলে নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। পরে তাকে খুন করে লাশ ফেলে সেটটি নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পরপরই লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এছাড়া মোবাইলফোন সেটের সূত্র ধরে পুলিশ শাহেদুলকেও গ্রেফতার করে জেল-হাজতে পাঠায়। মহুয়ার মা জেবুন্নেছা বেগম সদর থানায় বাদী হয়ে এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেন।

গত ২ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোঃ আকবর হোসেন মৃধা জনাকীর্ণ আদালতকক্ষে শাহেদুলের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৩
আরআর; সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।