রাজশাহী থেকে: উত্তরবঙ্গের কৃষকদের কাছে ‘বেশ পরিচিত’ একটি নাম নর্থবেঙ্গল গ্যাস্টার কোম্পানি। মূলত ভেজাল সার আর কীটনাশকের জন্যই কোম্পানিটির এই পরিচিতি।
অবশ্য প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের কারখানা বন্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বেশ ক’বার এ কারখানার মালামালসহ মেশিনপত্র জব্দ ও উৎপাদন কর্মীও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ভিন্ন মত দিয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। প্রতিবাদ, বিক্ষোভ সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে গ্যাস্টারের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না- এমন অভিযোগ খোদ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, গ্যাস্টারের ভেজাল সার ও কীটনাশক জমিতে ব্যবহার করে কোনো কাজই হয় না। বরং ওই সার-কীটনাশক ব্যবহারের কারণে জমির উর্বরতা শক্তি বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ভেজাল সার ও তৈরির উপকরণসহ গ্রেপ্তার হয়ে মোহনপুর থানায় রয়েছেন কারখানার কেয়ারটেকার আমজাদ আলী।
তিনি জানান, নর্থ বেঙ্গল গ্যাস্টার কোম্পানির বিভিন্ন সার মূলত লবন দিয়েই তৈরি হয়। এ সার জমিতে ব্যবহার করলে প্রথমবার খুব একটা ক্ষতি না হলেও পরের বছরই লবনের প্রতিক্রিয়া টের পাওয়া যায়। তখন জমিতে ফসল উৎপাদন অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসে।
কিন্তু ভূয়া কোম্পানির ভেজাল সার কেন কিনে ব্যবহার করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বড়গাছি এলাকার কৃষক আজিম, জোনাব আলী, কালু, সাজ্জাদসহ কয়েকজন বাংলানিউজকে জানান, কৃষি বিভাগের ব্লক সুপারভাইজাররা গ্যাস্টারের মাঠ কর্মীদের এনে পরিচয় করে দেন এবং তাদের সার কিনে জমিতে ব্যবহারের জন্যও বলেন।
আজিম মিয়া (৪৮) বলেন, ‘ব্লক সুপারভাইজারের পরামর্শ শুনে নিজেদের জমির সর্বনাশ নিজেরাই করেছি। ’
তিগ্রস্ত কৃষকরা ভেজাল সার-কীটনাশক বাজারজাতের েেত্র স্থানীয় পর্যায়ের কতিপয় কৃষি কর্মকর্তাকে দায়ী করে জানান, মূলত তাদের যোগসাজসেই উত্তরবঙ্গ জুড়ে ভেজাল সারের প্রতারণা বাণিজ্য রমরমা হয়ে ওঠেছে।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে দেখা যায়, হাট-বাজার পর্যায়ের সার ডিলাররা সরকারের সরবরাহকৃত সারের চেয়ে নকল কারখানার ভেজাল সার বিক্রির ব্যাপারেই বেশি উৎসাহী। সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ডিলারের সাথে আলাপ করে জানা যায়, এলাকা পর্যায়ে চাহিদার তুলনায় সরকারি ভাবে খুবই সীমিত পরিমাণ সারের সরবরাহ পাওয়া যায়। তাছাড়া নর্থবেঙ্গল গ্যাস্টারের সার-কীটনাশক বিক্রি করে লাভ হয় দ্বিগুণেরও বেশি। এ কারণে অধিক মুনাফা লুটতেই একশ্রেণীর ডিলার নকল কারখানার ভেজাল সার বেচাকেনার সিন্ডিকেটে যুক্ত হয়।
দুর্গাপুর থানার রামচন্দ্রপুর বাজারের একজন ডিলার নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গ্যাস্টারের ভেজাল সার দোকানে তুলতে ডিলারদের কোনো পুঁজি লাগে না। গ্যাস্টারের বিক্রয় কর্মিরা আগাম টাকা ছাড়াই তাদের সার-কীটনাশক দোকানে পৌঁছে দেন এবং বিক্রি শেষে পাওনা বুঝে নেন। লাভের উদাহরণ দিয়ে রামচন্দ্রপুর বাজারের ওই ডিলার জানান, গ্যাস্টারের উৎপাদিত মিলি সালফার প্রতি কার্টন মাত্র সাড়ে ৪’শ থেকে ৫শ’ টাকায় কারখানা থেকে সরবরাহ পান। অথচ তা কৃষকদের কাছে তা বিক্রি করা হয় ১৮শ’ থেকে ২ হাজার টাকায়।
প্রতিটি পণ্যেই এমন কয়েকগুণ লাভ করা যায় বলেই ডিলাররা নকল সার জেনেও বেচাকেনা করেন।
জানতে চাইলে নওহাটা বাজারের ডিলার সমসের আলী বলেন, ‘সার আসল কী নকল-তা যাচাই করবে প্রশাসন, আমাদের কাজ শুধু বেচাকেনা করা। ’
তিনি বলেন, ‘নর্থ বেঙ্গলের সব জায়গাতেই খোলামেলাভাবে গ্যাস্টারের পণ্য বিক্রি হচ্ছে, প্রশাসনের কেউ তো বাধা দিচ্ছে না। তাহলে আমাদের কি করার আছে ?’
যেভাবে গড়ে উঠে ভেজাল সার কারখানা
গ্যাস্টারের ভেজাল সার কারখানাটির সর্বেসর্বা হচ্ছেন নজরুল ইসলাম রহমত (৬২) নামের এক ব্যক্তি। বাগমারা থানার ঝিকরা গ্রামে তার বাড়ি। অভিযোগ রয়েছে, সমাজবিরোধী নানা কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ায় এলাকা থেকে তাকে স্বপরিবারে বিতাড়িত করা হয়। ১৯৮৬ সালে রাজশাহী মহানগরের বিসিক শিল্প এলাকায় আশ্রয় নেন তিনি। পরবর্তীতে বাংলাদেশ হার্ডওয়ারের মালিক মৃত আলহাজ্ব আব্দুস সামাদের মেয়ে শাহনাজ বেগমের পরিত্যক্ত জায়গায় বস্তি সাদৃশ্য খুপরি ঘর তুলে কোনমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় তার পরিবারের। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, প্রথমদিকে রহমত মিয়া নকল ডিটারজেন্ট পাউডার, মুক্তা পাউডারসহ নানা কসমেটিক্স সামগ্রী বানিয়ে ফেরি করে বিক্রি করতেন। কিন্তু কসমেটিক সামগ্রী বিক্রি করে তেমন সুবিধা করতে না পেরে তিনি ১৯৮৮ সাল থেকে ভেজাল সার প্রস্তুত করার কাজে নামেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা আরও জানান, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিা না থাকলেও নজরুল ইসলাম রহমত নিজেকে ‘কেমিক্যাল বিজ্ঞানী’ বলে পরিচয় দেন। তিনি নিজেই কথিত গ্যাস্টার কারখানার বিজ্ঞানী, সারের উদ্ভাবক, মার্কেটিং ম্যানেজার, সর্বোপরি মালিকও। আর রহমতের ২ স্ত্রী, চার ছেলে ও তাদের স্ত্রীরা কারখানাটির বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। রহমতের বড় ছেলে আব্দুল কুদ্দুস হচ্ছেন এ কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রোজ ৫০/৬০ টাকা মজুরির শ্রমিক দিয়েই প্রস্তুত করা হয় টন টন ভেজাল সার। ভারতীয় বিভিন্ন সার, শুকনো মাটি, পাথরকুচি, লবন, রঙ আর পাউডার মিশিয়েই রাত-দিন শুধু প্যাকেটজাত করার কাজ চলে গ্যাস্টার কোম্পানির ঝুপরি-বস্তির কারখানায়।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, এ কারখানায় যারাই একবার শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তারাই রাতারাতি সার কারখানার মালিক বনে যান। খুব সহজ পদ্ধতিতে ভেজাল সার উৎপাদন করতে পারায় ৫০ টাকা রোজের শ্রমিকও ২/৪ মাস পর নিজের বাড়িতেই আরেকটি সার কারখানা বসান এবং একই স্টাইলে বাজারজাত শুরু করেন।
সার প্রস্তুতকারী শ্রমিক থেকে রাতারাতি সার কারখানার মালিক বনে যাওয়া আজগর, রফিক ও নূরুল আমিন বাংলানিউজকে জানান, গ্যাস্টার কোম্পানির ভেজাল সারে লবন আর মাটির পরিমাণই থাকে বেশি। সামান্য পুঁজি খাটিয়েই কয়েক গুণ মুনাফা অর্জনের ব্যবসা তারা আর কোথাও দেখেননি।
(ভেজাল কারখানা: কৃষি কর্মকর্তা ও কারখানা মালিকরা যা বললেন... তৃতীয় কিস্তি পড়ুন)
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১০